হরিজনরা কি আজীবন হরিজনই থেকে যাবে! কখনো কি মানুষের মর্যাদা পাবে না!!!

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 17 July 2012, 06:03 AM
Updated : 17 July 2012, 06:03 AM

হরিজন! মহাত্মা গান্ধী সম্মান করে যাদের নাম দিয়ে ছিলেন হরি অর্থাৎ ঈশ্বরের পুত্র। সেই দলিত শ্রেনীর অন্তর্গত হরিজন জনগোষ্ঠী আমাদের দেশের বৈচিত্র্যময় পেশা, ভাষার, জাতিসত্ত্বার উল্লেখযোগ্য অংশ। হরিজনরা হিন্দুধর্মের অনুসারী হলেও এরা নিম্ন বার্নের হিন্দু। নিম্ন বর্ণের হওয়ার কারণে সমাজের সকল নিচু মানের কাজগুলো ভারতীয় সমাজে ঐতিহাসিকভাবে তাদেরই করতে হত। খুব সম্ভবত বৈদিক যুগের শেষ দিকে কিংবা তারো কিছু আগে হরিজনরা সমাজের নিচু মানের কাজের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য হয় এবং সমাজে হিন্দু বর্ণ প্রথায় নিম্ন বর্ণের হিন্দু হিসেবে পরিচিত হয়। তারা যে ধর্মের অনুসারী খোদ সে ধর্মেই এখন পর্যন্ত তার নিম্ন জাতের মানুষ হিসেবে সমাজে অস্পৃশ্য, অচ্ছুত হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে থাকে।আধুনিক নগর জীবনে যেসব ময়লা আবর্জনার স্তুপ জমা হয় হরিজন সম্প্রদায়ের সংস্পর্শ ছাড়া তা দূর হয় না।প্রতিনিয়ত তারা এই সব ময়লা, আবর্জনা পরিষ্কার করে শহরকে স্বাস্থ্য সম্মত বা বসবাস উপযোগী করে তোলে।

তৎকালীন সময়ে হিন্দু আধিপত্যশীল অবস্থায় থাকলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসন আমলেও নিম্ন বর্ণের মানুষদের সে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতেও হরিজনরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা হতে বের হতে পেরেছে তা কিন্তু বলা যায় না। এমনকি ভারতের এলাহাবাদ থেকে আজ হতে প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে আগমন করলেও তারা ঝাঁড়ুদার, মেথর, ড্রাইক্লিনারে, মুচি, গার্ড প্রভৃতি ৪র্থ শ্রেনীর পেশার সাথেই সংশ্লিষ্ট রয়ে গেছে। বিগত ১৫০ বছরে অনেকের অনেক ধরনের উন্নযন সাধিত হলেও হরিজনদের উন্নয়ন বলতে তেমন কিচু হয়নি। বরং তারা মৌলিক অধিকার বঞ্চিত আত্মমর্যাদাহীন হয়ে রয়েছেন।

বাংলাদেশ সংবিধানে সকল নাগরিকদের মধ্যকার সকল প্রকার বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষত ১৯ নং অনুচ্ছেদের ১ ও ২ দফা এবং ২৭, ২৮, ও ২৯ নং অনুচ্ছেদের কথা বিশেষভাবে বলা যায়। যেগুলোর মূল বক্তব্য হল রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সবায় সকল ক্ষেত্রে সমান সুযোগ লাভের অধিকারী হবে এবং সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকার যদি কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহন করে তাহলে তা হতে কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, মূলধারার জনগোষ্ঠীর একজন সাধারণ নাগরিক যে সব সুযোগ সুবিধা লাভ করে থাকেন হরিজন সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি তার সমান সুযোগ সুবিধা কখনোই পায় না।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজই যেন তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র পেশাগত কারণেই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় তাদের যে পরিচয় বিনির্মিত হয়েছে আজ পেশা পরিবর্তন করলেও তা সহজে মোচন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এমনকি পেশা পরিবর্তন ও অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। মুল ধারার জনগোষ্ঠী মনে করে হরিজনরা পূর্বে যে পেশায় জড়িত ছিল সেটা তাদের জন্মগত পেশা। যার ফলশ্রুতিতে তারা স্বভাবতই সমাজ জীবনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যার সম্মুখীন হয়।

সমস্যাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্চে আবাসন, পেশাগত, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাব, জনসাধারনের জন্য উম্মুক্ত সাধারণ সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রসহ চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি। হরিজনরা খুবই অল্প পরিমান জায়গায় মাত্র ১ টি বা ২ টি ঘরে একই গৃহস্থালীর বিভিন্ন প্রজন্মের ১০-১২ জন পর্যন্ত সদস্য এক সংগে বাস করে বা বাস করতে বাধ্য হয়, যা তাদের মানবেতর জীবন যাপনকে নির্দেশ করে। নতুনভাবে ঘর তৈরি করবে বা অন্য কোন জায়গায় তারা জমি ক্রয় করবে সেই সামর্থও তাদের নেই। দেড়শত বচর দেশ সেবা করেও খাস জমিতে তারা ব্যক্তি মালিকানা পায়নি।

পেশাগত ক্ষেত্রে তারা সমাজের হীন কাজগুলোর সংগেই যুক্ত এবং প্রথম শ্রেনীর চাকুরীতে তো দূরে থাক দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর চাকুরীর সাথে যুক্ত আছে বলেও জানা যায় না। সরকারি বিভিন্ন ছুটির সময় অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনের ছুটি ভোগ করার সুযোগ থাকলেও তাদের ভাগ্যে সেই সুযোগটুকুও মিলে না। পেশাগত কারণে বা অন্য কোন কারণে বাড়ীর বাহিরে থাকলে রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিচু রেস্তোরায় তারা প্রবেশের সুযোগ পেলেও অধিকাংশ রেস্তোরায় তারা প্রবেশের সুযোগ পান না। এই ধরনের আচরন তারা মূলধারার জনগোষ্ঠী মুলমানদের কাছ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেয়ে থাকেন, শুধু তাই নয় তারা যে যে ধর্মের অনুসারী সেই ধর্মের উচ্চ বর্ণের লোকজনও তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখে-যার প্রমাণ আমারা দেখতে পাই ধর্মীয় আচার পালনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা হরিজনদের প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়।

চিকিৎসা, শিক্ষা, মাদক প্রভৃতি সমস্যার পাশাপাশি তারা সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তারা অনেকটাই অরক্ষিত, যেকারণে সেই সমাজে নারীদের শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিছু লোক ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের এলাকায় মাদক ব্যবসার পসার খোলে যা হরিজন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। হরিজনদের অধঃস্তন অবস্থা থেকে উত্তোরনের জন্য সরাসরি সরকারী উদ্যোগ নেই বললেই চলে। তবে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান এ ব্যপারে এগিয়ে এলেও তা প্রয়োজনের তুলনাই অপ্রতুল। তাই তো হরিজনরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম হরিজনই থেকে যাছে, মানুষের মর্যাদা পাচ্ছে না।