নতুন বছরের প্রত্যাশা:প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত হোক!!!

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 29 August 2012, 08:21 AM
Updated : 29 August 2012, 08:21 AM

২০১০ সালের ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জের ঘাতক স্বামী কর্তৃক স্ত্রী ঝুমা দে'কে পুড়িয়ে হত্যা করার সংবাদে ভারাক্রান্ত হয়ে আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা হ্রাসের প্রত্যাশা নিয়ে ২০১১ সালে প্রবেশ করেছিলাম। কিন্তু নতুন বছরের দ্বিতীয় দিনেই রাজধানীর কল্যাণপুরে পাষণ্ড স্বামীর নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়েছিল স্ত্রী সোনিয়াকে। সেই থেকে ২০১১ সালে আর থামেনি নারী ও শিশু নির্যাতনের দানবীয় ট্রেনটি। বছরটি শেষ করেছি বিদেশ ফেরৎ স্বামীর মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার শিক্ষানুরাগী কিশোরী হাওয়া আক্তার জুঁই এর ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুল কেটে নেয়ার খবর দিয়ে। সবচেয়ে নিরাপদ স্থান ঘরেই কেবল নয়, বাইরেও নারীর নিরাপত্তা শোচনীয়। কোচিং ব্যবসা আর শিক্ষকতার ছদ্মবেশে লাম্পট্য আবির্ভূত হয়েছে নতুন উপদ্রপ হিসেবে। এতে নারীর শিক্ষা অধিকার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে মাদ্রাসা ছাত্রী মুন্নী সহ অনেকে।

সংখ্যা দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। অসংখ্য নির্যাতন আর সহিংসতার খবর আদালত, সংবাদ মাধ্যম বা আমাদের মত আইনী সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাতো দূরের কথা নির্যাতিতের ঠুঁট গলিয়ে বাড়ির উঠুন পর্যন্ত পৌছেনা।

২০১১ সালের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক রুমানা মনজুর স্বামীর হায়েনাত্মক আক্রমনের শিকার হয়ে দুটো চোখেরই দৃষ্টি হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। এই ঘটনায় চরম অনিশ্চয়তায় নিপতিত হয়েছে এ দম্পতির নিষ্পাপ শিশুটিও। জুঁই এর কথা আমরা শুরুতেই বলেছি। নির্যাতনের প্রকৃতির দিক থেকে এ দু'টো ঘটনাই তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা বোধহয় মধ্যযুগীয় বর্বরতার দিকেই ফিরে যাচ্ছি, যা আমাদের জাতির জন্যই দু:সংবাদ ও লজ্জাস্কর।

২০১১ সালের ২৩ শে জুন রংপুরের বদরগঞ্জে গ্রাম্য সালিশে স্বামী হাসেমের আত্মহত্যার জন্য স্ত্রী হাফিজা বেগম হ্যাপিকে দায়ী করে এবং প্রতিবেশী কাওসারা বেগমকে চরিত্রহীনা অপবাদ দিয়ে সালিশকারদের নির্দেশে নির্মমভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়।

কলেজ পড়–য়া মেয়েকে উক্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ এবং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করায় গত ২৫ নভেম্বর, ২০১১ ইং তারিখে বখাটে যুবক রুপম ও তার সহকর্মীরা এ ওয়াহেদ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলীকে বরিশালের সাগরদী বাজার হইতে বাড়ী ফেরার পথে রুপাতলী চান্দু মার্কেটের নিকট কুপিয়ে হত্যা করেছে।

৯ জুলাই, ২০১১ তারিখে দিবাগত রাত্রে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার শিমলা দীঘি পাড়ায় মরিয়ম মূর্মূ (৪৮) নামে একজন বিধবা আদিবাসী নারী খুন হয়েছে। তার শরীরের ও যৌনাঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেছে বলে কাকনহাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ আতাউর রহমান জানান।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট বাজার কালিবাড়ী পূজা মন্ডপে ০৫ অক্টোবর, ২০১১ ইং তারিখে রাতে ইভ টিজিংয়ে বাধা দেওয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় ২ সাংবাদিক সহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়।

২০১০ সালে মোট ২৭৫৭ জন নারী ও শিশু বিভিন্ন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়, যার মধ্যে ১১৮০ জন নিহত হয়। ঐ বছর ৬৭৪ জন পাবলিক ভায়োলেন্স, ৫২১ জন পাচার, ৪০২ জন পারিবারিক নির্যাতন, ৩৭৪ জন যৌন হয়রানী ও ৩৮৬ জন ধর্ষণের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়। অর্থাৎ আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ এর চেয়ে ২০১১ সালে নারী নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৫%। নির্যাতনের প্রত্যেকটি ধরনে এই হার ঊর্ধ্বমুখী। পারিবারিক নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুনেরও বেশি (১১৩.১৮%)। নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার মহামারির আকার ধারন করেছে।

নারী অধিকারের যে চিত্র আপনাদের সামনে তোলে ধরেছি তা কেবল নারীর দৈহিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত। মানবাধিকারের অন্যান্য ক্ষেত্রে এই চিত্র আরো ভয়াবহ । বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক অধিকার পরিস্থিতি খুবই নাজুক। উত্তরাধিকারে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীরা পুরোপুরিই বঞ্চিত, এ প্রশ্নে মুসলমান সম্প্রদায়ে নারী হল পুরুষের অর্ধেক। পারিবারিক ও ধর্মীয় আইনের উদ্দেশ্যই যেন নারীকে দুর্বল করে রাখা। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল এসব ক্ষেত্রে বৈষম্য বিলোপ করে সম-অধিকার দাবী করাতো দূরের কথা আমরা খুব সহজে এইসব অধিকার লংঘনের কথাটিও বলতে পারিনা। আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ তে উত্তরাধিকারে সমতা নয় বরং নারী নিজে যে সম্পদ অর্জন বা আয় করবে কেবল তার উপর নারীর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উল্লেখ থাকাতেই হরতালসহ কি ধরনের সহিংসতা প্রদর্শন করেছিল একটি মহল। নিজের আত্ম-মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী করতে না পারার যে পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে সে পরিস্থিতিটাই মানবাধিকার লংঘনের মধ্যে পড়ে। অথচ আমাদের সংবিধান ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

নারীর প্রতি সহিংস আচরন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে আশির দশক থেকেই বিশেষ আইন প্রণয়ন করে আসছে বিভিন্ন সরকার। শিশু অধিকার নিশ্চিত করার অভিপ্রায়ে ১৯৭৪ সালেই শিশু আইন প্রণীত হয়েছিল। বর্তমান সরকারও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট প্রত্যয়ী। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০, উত্ত্যক্তকরণ (ইভ টিজিং) প্রতিরোধে ভ্রাম্যমান আদালত আইন সংশোধন, মানব পাচার (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) অধ্যাদেশ ২০১১ এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রণয়ন করেছে এ সরকার। নারী নির্যাতন দমন ও নারী অধিকার বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক থাকা সত্বেও পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক কোন পরিবর্তন তো নয়ই, বরং অবনতি হচ্ছে লাগামহীনভাবে। কেন প্রচেষ্টাগুলো বিফলে যাচ্ছে?

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে পারিবারিক সহিংসতাসহ নারীর প্রতি যেকোন ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জনগনকে সচেতন করে তোলতে হবে। আর এসব কিছুতেই গনমাধ্যমের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। শহীদ সাংবাদিক কন্যা শারমিন রিমার হত্যাকারী স্বামী মুনীরের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর তার স্বজনরা সংবাদকর্মীদের খুনি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ সংবাদকর্মীদের আপোসহীন সংবাদ পরিবেশনের জন্যই সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে রিমা হত্যার ন্যায়বিচার সম্ভব হয়েছিল। আজকের সাংবাদিকতা আরো বিকশিত ও সাহসী। ২০১১ তেও রুমানার ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের লাগাতার সত্য পরিবেশনের কারনেই ঘাতকের বিরুদ্ধে পুলিশ সঠিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিল।

দিনাজপুরের নিরাপত্তা হেফাজতে ইয়াসমিন হত্যার ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার হওয়ায় পুলিশের হেফাজতে নারী নির্যাতনের ঘটনা হ্রাস পেলেও আমরা ২০১১ সালে প্রত্যক্ষ করেছি প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নারী ও শিশু নির্যাতিত হতে। রাষ্ট্রের নিকট থেকে আমরা গুড প্রাকটিস প্রত্যাশাই কেবল করিনা, এটা আমাদের অধিকার। মানবাধিকার বিশেষত: নারী ও শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের গাফিলতি কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা দেশে কেবল অশান্তি আর অরাজকতায় ডেকে আনবে। আমরা চাই দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিত হোক।