পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা!!!

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 10 Sept 2012, 05:10 PM
Updated : 10 Sept 2012, 05:10 PM


পারিবারিক সহিংসতা – প্রেক্ষিত বাংলাদেশঃ

বিশ্বের প্রায় সব দেশে পারিবারিক সহিংসতামূলক ঘটনা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসলেও একবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে বিষয়টি বৈশ্বিক পর্যায়ে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংগঠনসমূহের বিবেচনায় আসে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে যত রকম সহিংসতার ঘটনা ঘটে তার বেশী ভাগই পারিবারিক সহিংসতা। এর প্রত্যক্ষ শিকার নারী এবং পরোক্ষ শিকার শিশু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের ৫৩% নারী ও গ্রামাঞ্চলের ৬২% নারী পরিবারে তাদের স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজন দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি পরিচালিত ২০০৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে ৪৩% নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার। এর মধ্যে ১১% যৌতুক বিষয়ক নির্যাতন। দেশের জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র সমূহ থেকে সংকলিত সমিতির তথ্য অনুযায়ী ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১ পর্যন্ত যৌতুকসহ অন্যান্য পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৬০২টি। তবে মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা আরও নাজুক। পরিবারে শিশু নির্যাতনের হার ক্রমশঃ বেড়েই চলছে তা সে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যেভাবেই হোক। এটি সর্বজন বিদিত যে, পারিবারিক নির্যাতনে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাবে তাদের মধ্যকার ক্ষত দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। এতে একদিকে তারা মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তাদের জীবনের নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে বেড়ে ওঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় এ আইনের প্রয়োজন:

শুধু নিম্নবিত্ত ই নয়, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত নাগরিক সমাজের চার দেয়ালের মধ্যেও পারিবারিক সহিংসতার শিকার নিষ্পেষিত নারীর কান্না গুমড়ে ওঠে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে, প্রকাশ্যে কিংবা লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত এসব নির্যাতনের ঘটনা এখনো ব্যক্তিগত বিষয় বলে বিবেচিত হয়। এমনকি আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানসমূহও বিষয়টি পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচনায় নেয়। ফলে নির্যাতনের শিকার নারী পুলিশ ষ্টেশন বা আদালতে যেতে তেমন ভরসা পায় না। কেননা সেখানেও তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি বা পুনরায় নির্যাতনের শিকার হন। এ ছাড়া সামাজিকভাবেও তারা বিভিন্নরকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন।

বাংলাদেশ সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে নারীর সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু নারীর অনগ্রসরতা বিবেচনায় ২৮ (৪) অনুচ্ছেদে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন আইন বা নীতি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ । কেননা প্রচলিত আইনসমূহে পারিবারিক সহিংসতা গুরুত্ব পায়নি এবং কোনভাবেই এর প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া দন্ডবিধি আইন বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সরাসরি শাস্তি পেতে হয়। ফলে সমঝোতার আগেই পরিবারগুলো ভেঙে যায়। যা পরিবার এবং সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ পর্যায়ে এমন একটি আইনের প্রয়োজন দেখা দেয় যে আইনের মাধ্যমে পরিবারে নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং নারীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রেক্ষিতে প্রণীত হয় পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০। বর্তমানে এ আইনটি বাস্তবায়নে বিধিমালা চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে।

এ আইন বাস্তবায়নে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা কী কী:

এই আইন বাস্তবায়নের পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিবন্ধকতা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে:
• পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ একটি নতুন বিধান। তাই অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক সুরক্ষা আইন সম্পর্কে অবহিত নয়;
• আইনটি শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য, তাই এটা খুবই স্পর্শকাতর;
• সকল স্থানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা যথাযথভাবে পাওয়া নাও যেতে পারে;
• প্রচলিত আইন এবং সমাজ ব্যবস্থায় তৈরী পুরাতন এবং প্রচলিত মানসিকতা;
• পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা;
• নারীর ক্ষমতায়নে বাঁধাগ্রস্ততা ইত্যাদি ।

এ আইন বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ সমূহ গ্রহণ করা জরুরীঃ

• পারিবারিক পরিমণ্ডলে নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে, যেমন পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার;
• পারিবারিক সুরক্ষা আইন ২০১০ এর উপর সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দিতে হবে (আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সাধারণ জণগণ) যেন এই আইন বাস্তবায়নে এবং পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে তেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
• কমিউনিটিকে নারী ও শিশু অধিকার সম্পর্কে অবহিত করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান এবং পারিবারিক নির্যাতনবিরোধী আইনগুলোর বাস্তবায়ন মনিটর করা।

পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০ বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের ভুমিকাঃ

আলোচ্য আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সুশীল সমাজ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের পারিবারিক সহিংসতার শিকার সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। এ ধরণের ঘটনার শিকার নারী ও শিশুরা, যারা আইনের আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন, এমনকি ঘটনা পারিবারিক পরিমণ্ডলে সংঘটিত হওয়ায় এবং এ আইনটি সম্পর্কে ধারনা না থাকায় অনেকেই আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহী নয়। তাই আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিতদের জেন্ডার সংবেদনশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। তাছাড়া পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০১০ এ যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষার পাশাপাশি আদালত কর্তৃক আশ্রয় প্রদানের মাধ্যমে ভিকটিমের আস্থার জায়গাটি সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা রয়েছে এবং দ্রুততার সাথে আইনি সহায়তা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে ।

এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, 'সুশীল সমাজ' সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এ আইনের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে, এমন সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের সাথে সমন্বয় রক্ষা করে আলোচ্য আইনটির পাশাপাশি অপরাপর আইনের মাধ্যমে প্রতিকারের উপায় সমূহ জানিয়ে দেয়া। সর্বোপরি, এ আইনের প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখার মাধ্যমে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণে আইনের বাস্তবায়নে আরও সহজ সরল কোন নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা।

শেষ কথা:

নারীর ক্ষমতায়ন ও ক্ষমতার মূল স্রোতধারায় নারীদের অংশগ্রহণ তখনই সম্ভব হবে যখন সমাজে নারী ও শিশুর উপর সহিংসতার মাত্রা কমে যাবে এবং নারীদের অবস্থানের উন্নতি হবে। একইসাথে জাতীয় জীবনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমঅধিকার এবং সমান অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।