র‍্যাবের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, এত সহজ?

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 16 June 2014, 07:13 AM
Updated : 16 June 2014, 07:13 AM

সাধারণ আদালতে র‍্যাবের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা কোনটি তা হয়ত অনেকেই জানেন না।

মামলাটি করেছিল শরিয়তপুর জেলার পালং থানা নিবাসী অবসর প্রাপ্ত সেনা সদস্য আব্দুর রহমান খান তার একমাত্র পুত্র ফল ব্যবসায়ী আফজাল হোসেনকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে। শরিয়তপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (ভারপ্রাপ্ত) অশোক কুমার অভিযোগটি আমলে নিয়ে বিষয়টি এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে পালং থানাকে থানাকে নির্দেশ দিয়েছিল। মামলাটি হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ শে মে। এএসপি মর্যাদা সম্পন্ন র‍্যাবের একজন কর্মকর্তাসহ সাত র‍্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।

দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য বুঝতে পারছি না, একজন মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে মামলাটি দায়ের ও পরিচালনায় সার্বিক, সহযোগিতা, তত্বাবধায়ন ও তদারকি করার দায়িত্ব পালন করেছি আমি। আর তা পালন করতে গিয়ে র‍্যাবের হয়রানীর শিকারও হতে হয়েছিল অনেক বার। এমন কি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতারের হুমকি, হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল আমাকে। যা শুরু হয়েছিল শরিয়তপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করে বের হওয়ার পর থেকেই।

শুধু আমাকে নয় মামলার বাদীকে জোড়পূর্বক র‍্যাব ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাদের মত কিছু নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষের প্রচেষ্টার তিনি র‍্যাবের ক্যাম্প থেকে জীবিত ফিরে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন।

যদিও মামলা দায়েরের খবরটি প্রথম আলোসহ দেশের সকল জাতীয় পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু মামলা দায়ের পরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলো পত্রিকাগুলোর নিকট তেমন গুরুত্ব পায় নি।

যাহোক, মামলাটি পালং থানা এজাহার হিসেবে নথিবদ্ধ না করে একই বিষয়ে পুর্বেই একটি ইউডি মামলা হয়েছে মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত থানা কর্তৃক পেরিত প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে ভিক্টিমের বাবা কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা ও ইউডি মামলাকে এক করে এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত করতে থানাকে নির্দেশ দিয়েছিল।

যদিও পরবর্তীতে থানা ঘটনার সাথে র‍্যাব সদস্যরা জড়িত না মর্মে মিথ্যা তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল এবং বিষয়টি উচ্চ আদালত হয়ে এখনো ন্যায় বিচারের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে।

মামলাটির মুল ঘটনায় দেখা যায়, ২০০৮ সালের ১৮ই মার্চ বিকেল আনুমানিক ৫.০০ ঘটিকার সময় মামলার ভিক্টিম আফজাল শরিয়তপুর জেলার পালং থানাধীন মাহমুদপুর বাজারে অবস্থান করাকালীন ৪ জন র‌্যাব সদস্য তাকে গ্রেফতার করেন এবং পিস্তলের বাট, গজারী লাঠি, লোহার রড, পায়ের বুট দিয়ে জনসম্মূখে তাকে বেদম প্রহার করে রক্তাক্ত, ছেচা, ফোলা, যখম করে।

অতঃপর, তার হাত-পা শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে তাকে পার্শ্ববর্তী বিনোদপুর চরেরকান্দি বিএম আইডিয়াল কলেজ মাঠে নিয়ে যায় এবং সেখানে অবস্থানরত পুলিশের সহকারী সুপার (এএসপি) কাউসার আহমেদসহ অপরাপর র‌্যাব সদস্যরা মিলে তারা ভিক্টিম আফজালকে বেদম প্রহার করে। পরবর্তীতে, তারা ভিক্টিম আফজালকে শরিয়তপুর জেলা পুলিশ লাইনে নিয়ে গিয়ে এ এস পি কাউসার আহমেদের নির্দেশে ভিক্টিমের পায়ের রগ কেটে ফেলে।

এ সময় পালং থানার এস আই আবির হোসেন ভিক্টিমের মুখের ভিতর লোহার রড ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে। অতঃপর ভিক্টিম আফজালের মৃর্ত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়ে আসামীগণ তাদের দায় এড়ানোর জন্য ভিক্টিমকে শরিয়তপুর সদর হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যায়।

শরিয়তপুর সদর হাসপাতালে ভিক্টিমের শারীরিক অবস্থার মারাত্বক অবনতি ঘটলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভিক্টিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পালং থানা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ প্রদান করেন। ভিক্টিমের পিতা খবর পেয়ে পরদিন ১৯ মার্চ ২০০৮ ইং তারিখে পুলিশের সহায়তায় ভিক্টিম আফজালকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করালেও সকল প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ করে ভিক্টিম ২০ মার্চ, ২০০৮ ইং তারিখে দুপুর আনুমানিক ১.১৫ ঘটিকার সময় মৃর্ত্যু বরণ করেন।

পরবর্তীতে, ভিক্টিমের মোঃ আব্দুর রহমান খান অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষনা দিয়ে প্রস্তুতি গ্রহন করলে অভিযুক্ত আসামীগণ তাকে কিছু টাকা পয়সার বিনিময়ে মামলা না করার পরামর্শ প্রদান করেন। কিন্তু ভিক্টিমের পিতা অত্র মামলার বাদী তাতে রাজি না হলে বাদীকেও তার ছেলের মত হত্যা করা হবে বলে অভিযুক্ত আসামীগন হুমকি প্রদান করেন।

তাছাড়া, আসামীগণ র‌্যাব সদস্যহওয়ায় এবং তাদের বিরতিহীন জীবন নাশের হুমকিতে তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ এলাকা ছাড়া থাকেন। তাছাড়া, র‌্যাব সদস্যদের ভয়ে শরিয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির কোন অ্যাডভোকেট তার পক্ষে মামলা দায়ের করতে সম্মত হন নি।

অবশেষে, দীর্ঘদিন পর তিনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হিউম্যান রাইটস্ (বিআইএইচআর)'র সার্বিক সহায়তায় ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তিনি মামলাটি দায়ের করেন।

বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, শরিয়তপুর জনাব অশোক কুমার দত্ত বাদীর জবানবন্দী গ্রহন করেন এবং.অভিযোগটি আমলে সিয়ে পালং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তা এজাহার হিসেবে গ্রহনের আদেশ প্রদান করেন।