সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং পুলিশি রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য দীর্ঘ ১৩ বছর পূর্বে হাইকোর্ট বিভাগ যে যুগান্তকারী নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন সুপ্রীম কোর্টও আজ সে নির্দেশনা বহাল রেখেছেন। হাইকোর্টের নির্দেশনায় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে যা পূর্ণাঙ্গ রায়ে জানা যাবে।
বহুল আলোচিত বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ১৯৯৮ সালে গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে নির্যাতনপূর্বক হত্যার ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হক এবং বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তারসংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং পুলিশি রিমান্ডসংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধন করার জন্য একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছিলেন। নতুন আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত এ দুটি ক্ষেত্রে সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে চলার জন্য হাইকোর্ট বিভাগ অভিমত দিয়েছিলেন। আদালতের দেয়া নির্দেশনায় সাতটি সুপারিশও করা হয়েছিল। সুপারিশে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় নতুন উপধারা (২) সংযোজন এবং একই কার্যবিধির ১৬৭ ধারার (৩), (৪) ও (৫) উপধারাগুলো সংশোধন করা। সাথে সাথে দন্ডবিধির ২২০ ও ৩৪৮ ধারা দুটি সংশোধন করে ধারা দুটির আওতায় প্রদত্ত শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে বলা হয়েছিল।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা সম্পর্কে নির্দেশনায় বলা হয়েছিল: ডিটেনশন (আটকাদেশ) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। এ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে বিষয়টি তার নিকটাত্মীয়কে জানাতে হবে। আর রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করা হলে সঙ্গে সঙ্গে নিকট আত্মীয়কে জানাতে হবে। উভয় ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে কী কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা তিন ঘণ্টার মধ্যে জানাতে বলা হয়েছিল। বিশেষ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের পর পরই মেডিকেল চেকআপ করতে হবে। গ্রেপ্তারকৃতের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করবেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় প্রদত্ত রিমান্ড সম্পর্কে নির্দেশনায় হাইকোর্ট বিভাগ বলেছিলেন: পুলিশের কাছে কোনো অভিযুক্তকে রিমান্ড দেয়া যাবে না। তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে জেলখানার আলাদা কক্ষে শুধু তদন্তকারী কর্মকর্তা তা করতে পারবেন। আদালত তার অভিমতে আরো বলেছিলেন যে, রিমান্ড দিতে হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে নিশ্চিত হতে হবে- এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটকে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ও তার আইনজীবীর বক্তব্য শুনতে হবে। সর্বোপরি রিমান্ডের আদেশ নিশ্চিত করবেন দায়রা জজ। সেখানেও গ্রেপ্তারকৃতের বিরোধিতা বা আপত্তি করার সুযোগ থাকবে। এ ক্ষেত্রে রিমান্ড দিতে হলে সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল চেকআপ করতে হবে এবং রিমান্ড শেষে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি নির্যাতনের অভিযোগ করলে আবারো মেডিকেল চেকআপ করতে হবে। নির্যাতনের বিষয়ে চিকিৎসক নিশ্চিত হলে ম্যাজিস্ট্রেট কোনো নিয়মতান্ত্রিক আবেদন ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
আদালত আরো উল্লেখ করেছিলেন যে- কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে জেলখানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে একটি কাচের ঘরে তার নিয়োজিত আইনজীবী বা আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতে তা করতে হবে। যাতে তদন্তের স্বার্থে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবী কোনো প্রশ্ন-উত্তর শুনতে পারবেন না। তবে কোনো নির্যাতন করা হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে পারেন।
সরকার উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ২ আগস্ট আপিল বিভাগে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন। তবে হাইকোর্টের ওই অন্তবর্তী নির্দেশনাগুলো আপিল বিভাগ স্থগিত করেননি। অবশেষে, দীর্ঘ শুনানীর পর আজ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের নির্দেশনা বহাল রেখে রায় প্রদান করেন।
এখন প্রশ্ন হলো সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা মানতে সরকার বাধ্য কিনা? যার ন্যূনতম আইন সম্পর্কে জ্ঞান আছে তিনি অবশ্যই বলবেন যে হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা সরকারসহ সকল নিম্ন আদালত এবং সুপ্রীম কোর্টের(আপীল বিভাগের) নির্দেশনা সরকারসহ হাইকোর্ট বিভাগ এবং অধঃস্তন সকল আদালত মানতে আইনগত ও নীতিগতভাবে বাধ্য। যদি তাই হয় তাহলে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং পুলিশি রিমান্ডসংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা সংশোধন করতে সরকারের প্রতি হাইকোর্ট বিভাগ যে শুপারিশ ও নির্দশনা প্রদান করেছিল তা গত ১৩ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি কেন? উক্ত নির্দেশনায় বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপীল চলমান ছিল বলে হয়ত সরকার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেননি বলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইবেন। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট তো আপীলের অনুমতি দেবার সময় হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা স্থগিত করেননি। তাহলে গত ১৩ বছরেও হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ কি? তবে কি সরকার সুপ্রীম কোর্টের (আপীল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ) নির্দেশনা মানতে বাধ্য নয়?