ফেসবুকে যৌন ব্যবসার রমরমা প্রচারণা: প্রশাসন কোথায়?

শাহানূর ইসলাম সৈকত
Published : 13 Oct 2016, 08:33 AM
Updated : 13 Oct 2016, 08:33 AM

'কল গার্ল ঢাকা' অনলাইনে কল গার্ল, বডি ম্যাসেজ ও ফরেনার এস্কর্ট সরবরাহকারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি ফেসবুক পেজ। কল গার্ল ক্লাব, ঢাকা, পাওয়ার্ড বাই এস্কর্ট রেইন ঢাকা কর্তৃক পরিচালিত কল গার্ল সাপ্লায়ার-বডি ম্যাসেজ-ফরেনার এস্কর্ট-অনলাইন বেইজ সার্ভিস প্রদানকারী তথাকথিত এজেন্টটির ঠিকানা গুলশান ১, ঢাকা এবং কনটাক্ট পার্সন জনৈক রিগান, যার মোবাইল নাম্বার ০১৮২৫১৩৮৮১২। গত ১৫ জুলাই ২০১৬ ইং তারিখে ফেসবুকে খোলা এই পেইজটি এতোমধ্যে বিভিন্ন চটকদারী পোস্টের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রমের প্রচার চালাচ্ছে কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই।

১৫ জুলাই ২০১৬ ইং তারিখে প্রদত্ত পোষ্টের মাধ্যমে পেইজটি তাদের নরমাল ক্যাটাগরি এস্কর্ট এর রেট, জায়গা, বুকিং সিস্টেম প্রকাশ করছে এবং এ ক্যাটাগরীর সেবা নিতে আগ্রহী হলে কি করতে হবে তাও বর্ণনা করেছে।

২৭ জুলাই ২০১৬ ইং তারিখে পেইজটি কলাবাগান, ধানমন্ডি, ধানমন্ডি ২৭ এবং মধ্যবাড্ডায় তাদের নরমাল ক্যাটাগরী এস্কর্ট সেবার স্থান, রেট ও যোগাযোগ নাম্বার প্রকাশ করেছে।

এস্কর্ট এজেন্সিটি যে অচিরেই মিরপুর এলাকায় তাদের সেবা নিয়ে হাজির হচ্ছে তা গত ৩ আগস্ট ২০১৬ ইং তারিখের পোষ্টের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে।

সর্বশেষ এস্কর্ট সরবরাহকারী পেইজটি গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ইং তারিখে এস্কর্ট রিক্রুইটিং এজেন্ট, নারী এস্কর্ট এবং পুরুষ এস্কর্ট নিয়গের জন্য পেইজটিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে কাজ করতে আগ্রহীদের যোগ্যতা, কাজ সম্পর্কে ধারনা, প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র, পারিশ্রমিক এবং যোগাযোগের ঠিকানা বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৪০ নং অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে কোন পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোন যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোন আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে। কিন্তু সংবিধানের ১৮ (২) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র প্রকাশ্যে গনিকাবৃত্তি ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে।

দণ্ডবিধির ২৯০, ২৯২ ও ২৯৪ ধারায় উপরোল্লিখিত কার্যক্রমসমূহ আইনগতভাবে অপরাধ হিসাবে গন্য করে অপরাধীর জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান করেছে। তাছাড়া, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ এর ৭৪ ধারায় পতিতা বৃত্তির জন্য আহবান করাকে অপরাধ হিসাবে গন্য করে অপরাধীর কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান করেছে।

পাশাপাশি, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এর ১১, ১২ এবং ১৩ নং ধারা কল গার্ল ঢাকা কর্তৃক সম্পাদিত কার্যক্রমসমূহকে শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করেছে। উক্ত আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি জবরদস্তি বা প্রতারণা করিয়া বা প্রলোভন দেখাইয়া কোন ব্যক্তিকে পতিতাবৃত্তি অথবা অন্য কোন প্রকারের যৌন শোষণ বা নিপীড়নমূলক কাজে নিয়োগ করিবার উদ্দেশ্যে বিদেশ হইতে বাংলাদেশে আনয়ন করিলে বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে এবং অন্যূন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থ দন্ডে দন্ডিত হইবেন।

১২ নং ধারায় বলা হয়েছে, (১) কোন ব্যক্তি পতিতালয় স্থাপন বা পরিচালনা করিলে অথবা তাহা স্থাপন বা পরিচালনা করিতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা বা অংশগ্রহণ করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর এবং অন্যূন ৩ (তিন) বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে এবং ইহার অন্যূন ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড দন্ডিত হইবেন। (২) কোন ব্যক্তি, যিনি⎯ (ক) ভাড়াটিয়া, ইজারাদার, দখলদার বা কোন স্থান দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি, জানিয়া-শুনিয়া উক্ত স্থান বা এর কোনো অংশবিশেষ পতিতালয় হিসাবে ব্যবহার করিবার অনুমতি প্রদান করিলে; অথবা (খ) কোন বাড়ির মালিক, ইজারা-দাতা অথবা জমির মালিক অথবা উক্ত মালিক বা ইজারা-দাতার কোন প্রতিনিধি উক্ত বাড়ি অথবা উহার কোন অংশবিশেষ পতিতালয় হিসাবে ব্যবহৃত হইবে তাহা জানা সত্ত্বেও উক্ত বাড়ি বা জমি ভাড়া প্রদান করিলে; তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর এবং অন্যূন ৩ (তিন) বৎসর সশ্রম কারাদন্ডে এবং অন্যূন ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন। এবং উক্ত আইনের ১৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি রাস্তায় বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে অথবা গৃহ অভ্যন্তরে বা গৃহের বাহিরে পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে মুখের ভাষায় বা অংগভঙ্গি করিয়া বা অশালীন ভাব-ভঙ্গি দেখাইয়া অন্য কোন ব্যক্তিকে আহবান করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর সশ্রম কারাদন্ড অথবা অনধিক ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে হইবেন।

সর্বোপরি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ ধারা কল গার্ল ঢাকা পেইজে উল্লেখিত প্রচারণামূলক কার্যক্রমসমূহ আইনগতভাবে অপরাধ এবং অপরাধীর সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান করেছে। উক্ত ধারায় বলা হয়েছে যে, (১) কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷ (২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি ১[ অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে] এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷

ইদানিং প্রায়শ ফেসবুক এ ব্যক্তির প্রতি অবমাননাকর বা অশ্লীল প্রচারণার জন্য অনেক ব্যক্তিকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের, গ্রেফতার, এমন কি বিচারান্তে শাস্তি প্রদানের কথা শোনা যায়। যার অধিকাংশের বিরুদ্ধে আবার উক্ত ধারার অপপ্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। সরকার সাইবার অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের বিশেষ ইউনিট গঠন এবং নিয়মিত ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং করছে। তারপরও গত জুলাই মাস থেকে কল গার্ল ঢাকা নামক পেইজটি প্রশাসনের নাকের ডগায় নিয়মিত প্রকাশ্যে তাদের আশ্লীল প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে কোন প্রকার বাঁধা ছাড়াই।

প্রশাসন কি উল্লেখিত বিষয়টির ব্যাপারে অবগত নন। নাকি সব কিছু জেনেও উপরি পেয়ে চোখ বন্ধ রেখেছে। যদি তাই করে থাকে অথবা নাই করে থাকে, তবে প্রশাসনের এখনই উচিত হবে কল গার্ল ঢাকা'র কার্যক্রম আরো ব্যাপকভাবে প্রসারের আগেই উক্ত অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যথায় আপনি আমি সবাই তাদের এই হীন্য অপরাধের শিকার হব। তখন আর চাইলেও করার কিছু থাকবে না!

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট: https://www.facebook.com/Shahanur.Saikot,

ডেডিকেটেড ব্লগ: https://shahanur.blogspot.com/