দিল্লী থেকে চীনের কথা বলতে আপত্তি কেন?

আতাউস সামাদ
Published : 31 Jan 2010, 02:40 PM
Updated : 31 Jan 2010, 02:40 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের শেষে যে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইস্তেহার আছে তাতে ইংরেজী Operationalise (কার্যকর করা বা চালু করা) শব্দটি বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা হয়েছে।

দুই সরকার এক সঙ্গে এবং একে অপরের জন্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেগুলোই সিদ্ধান্ত অথবা প্রস্তাব আকারে আছে যৌথ ইস্তেহারে।

এর মধ্যে কয়েকটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রাধিকার দিয়ে বলা হয়েছে এগুলো 'অপারেশনলাইজ' করার জন্য তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যেমন, বাংলাদেশ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করার জন্য ভারতের সহায়তায় যেসব ভৌত অবকাঠামো করবে, এবং ভারতের কাছ থেকে রেল ইঞ্জিন ও কোচ, বাস এবং ড্রেজার কিনবে যার জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে সে কাজগুলি দ্রুততম সময়ে 'অপারেশনালাইজ' করা হবে।

আবার কিছু কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থ বের করার জন্য অদূর ভবিষ্যতে দুই দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত হয়েছে; যেমন, তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে।

এ আলোচনা আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আবার, ফেনী, মনু, মহুরি, খেয়াই, গোমতি, ধরলা ও দুধকুমার নদী নিয়ে যেসব সমস্যা সমাধান করতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন সেগুলি যৌথ নদী কমিশন আলোচনা করবে তবে তা কবে নাগাদ করা হবে সেকথা যৌথ ইস্তেহারে নেই।

সম্ভবত সুযোগ-সুবিধা মতো হবে। আর বাংলাদেশে পদ্মা (তথা গঙ্গা) নদীর পানি স্বল্পতার বিষয়টি উল্লেখই করা হয় নাই সহযোগিতার বানীতে ভরা এই ইস্তেহারে।

স্মারণ করা যেতে পারে যে, ভারতের ফারাক্কা বাঁধ এই নদীর ওপরে। 'কানেক্টিভিটি' নামে অভিহিত যে বিষয়টির কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রায়ই বলে আসছিলেন সেক্ষেত্রে তাঁরা একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলার সমুদ্রপথের বন্দর এবং আশুগঞ্জ নদী বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রতিশ্র"তি দিয়েছেন।

একই সাথে এই বন্দরগুলোতে যাতায়াতের জন্য রেলপথ ও ভারতকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবর্তে ভারত দেবে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে রেল যোগাযোগ করতে।

বাংলাদেশ বলেছে যে সে ভারতের মধ্যে দিয়ে ভুটানের সাথে ও রেল যোগাযোগ করতে চায়। তাছাড়া বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানকে ও মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রস্তাব দেবে।

এজন্য যে ভারতীয় ভূখন্ডের ওপর দিয়ে যাতায়াতের যে সুনির্দিষ্ট অনুমতি লাগবে সেই বিষয়ে ভারত আপাতত মৌনতা অবলম্বন করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশী বেসামরিক ব্যক্তিদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল যে উত্থাপন করেছিলেন তা যৌথ ইস্তেহার পাঠ করলে বোঝা যায় কিন্তু বিষয়টি এমন ভাষা ব্যবহার করে উল্লেখ করা হয়েছে যাতে মনে হবে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ যেমন প্রায়ই বাংলাদেশীদেরকে হত্যা করছে বাংলাদেশের বিডিআরও বুঝি তেমনভাবে ভারতীয়দেরকে মারছে।

যৌথ ইস্তেহারের অষ্টাদশ প্যারাগ্রাফের শেষ দিকে লেখা হয়েছে যে, সীমান্তের দুই দিকে অবৈধ কার্যকলাপ হ্রাস করার জন্য এবং প্রাণহানি প্রতিরোধ করতে (To curtail illegal cross border activities and prevent loss of lives) দুই দেশের রক্ষীদের মধ্যে (অর্থ্যাৎ বিডিআর ও বিএসএফ-এর মধ্যে ঘন ঘন বৈঠক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের সংযত হওয়া প্রয়োজন।

এখানে 'প্রাণহানি ঘটার' বিষয়টির আগে 'সীমান্তের দুই পারে অধিক কার্যকলাপ' হওয়ার কথা বলায় কিন্তু এটাই দাঁড়াল যে সীমান্তে আইনবিরোধী কাজ ও অবৈধভাবে সীমান্ত পরস্পর ঠেকাতেই সীমান্তরক্ষীদের হাতে ওইসব আইন ভঙ্গকারীরা নিহত হচ্ছে।

যৌথ ইস্তেহার প্রণয়নের জন্য যে বাংলাদেশী প্রতিনিধিরা কাজ করেছেন তাঁরা এই মরাবাঁচার সমস্যাটি নিয়ে এতো এতো ভদ্র এবং ভারতের প্রতি এত নরম ও বিনয়ী না হলেও পারতেন।

সামান্য একটু দুর্বির্নীত যে হতে পারলেন না তার মানে কী এই যে তাঁরা আসলেই বিশ্বাস করেন যে, বিএসএফ-এর গুলিতে যে বাংলাদেশীরা মরছে তারা সবাই চোরা কারবারি, মাদক পাচারকারী অথবা গরু চোর!

আমার খুবই শ্রদ্ধাভাজন একজন সাংবাদিককেও টেলিভিশনে ওই ধরনের বিরূপ ইঙ্গিত দিতে দেখলাম। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় পড়ছি যে, বিএসএফ-এর হাতে যে বাংলাদেশীরা খুন হচ্ছে তাদের অনেকেই কৃষক এবং সীমান্ত সংলগ্ন জমিতে কৃষিকাজ করার সময় তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

এমন কী গরু ছাগল চরায় যে কিশোর -কিশোরীরা তাদের লক্ষ্য করেও বিএসএফ গুলি করে। গত বছর ৬ নভেম্বর তারিখে মঞ্জুআরা নামে ১২ বছর বয়সী এক কিশোরী রৌমারী সীমান্তে তার গরু আনতে গিয়ে বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত হয়েছে।

এই গোলাগুলির বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যান ১০ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে। তার আগের দিন, অর্থাৎ জানুয়ারি ৯, ২০১০ তারিখে, বিএসএফ বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ সীমান্তে একজনকে এবং বেনাপোল সীমান্তে একজনকে হত্যা করে।

আবার প্রধানমন্ত্রীর সফরের শেষ দিনে (জানুয়ারি ১২) তারা বেনাপোলের দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে গরু নিয়ে আসার সময় এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে বিএসএফ।

অর্থাৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস্ত করছিলেন তখনও বিএসএফ তাদের পুরনো অভ্যাস মতোই রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে।

তারা কী করে এসেছে তা উপলব্ধি করা যায় সামান্য কয়েকটি পরিসংখ্যান দেখলে। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৯৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৮৯ জন।

গত ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ এই নয় বছরে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৮৪১ জন বাংলাদেশী। কাজেই বাংলাদেশের প্রতিবাদ আরও অনেক জোরদার হওয়া উচিত ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লী সফর সংক্রান্ত বাংলাদেশÑভারত যৌথ ইস্তেহারে তার যথেষ্ট স্পষ্ট প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন ছিল আমাদের সীমান্তের দরিদ্র কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবার পরিজনদের নিরাপত্তার জন্য।

সত্যি কথা বলতে কী আমার কাছে মনে হয়েছে ওই যৌথ ইস্তেহারে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, শেখ হাসিনা ভারত থেকে ফিরে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে বললেন যে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর উন্মুক্ত করে দিতে চান অর্থাৎ তিনি চান যে এই বন্দরটি বাণিজ্যের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত হোক এবং তা থেকে বাংলাদেশ ভাল পরিমাণ অর্থ আয় করুক।

এই প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আসরাফুল ইসলাম আরও ব্যাখ্যা করে বললেন যে, চীন ও মায়ানমারকেও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে প্রস্তাব দেওয়া হবে।

ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইসতেহারে আঞ্চলিক বা আন্তজার্তিক সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাব এবং স্থলপথে মায়ানমার ও চীনের সাথে বাংলাদেশের ইচ্ছার উল্লেখ থাকতে পারতো। চীন ও মায়ানমার তো নেপাল ও ভুটানের চেয়ে বেশি বাণিজ্য করে বাংলাদেশের সাথে।

ভারত নিজেও তো বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও চীনের সাথে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে সব কিছু করছে। একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতা হয়েছিল তা এখন নয়াদিল্লীর কাছে ফেলে দেওয়া অতীত।

কাজেই দিল্লীতে বসে বাংলাদেশও যদি তাদের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করে তাতে দোষের কী?

সমস্যা হলো, অনেক ভারতীয় আছেন, বিশেষত কারও সরকারে যারা সুযোগ পেলেই বলেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের অবদানের জন্য এদেশ ভারতের প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি।

আমাদের দেশে ও এই একই মত অনেকে আছেন এবং গত সপ্তাহে কোন কোন পত্রিকায় উপ সম্পদিকীয়তে একথা লেখাও হয়েছে। এক্ষেত্রে আমার তিনটি বক্তব্য আছে।

আমরা ভারতের কাছে সব সময়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আসছি তবে এখন থেকে আমরা আশা করবো যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারতের জন্য অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে কারণ, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তান যেখানে ভারতের সাথে তিনটি বড় যুদ্ধ বাধিয়েছে সেখানে ১৯৭১ এর পর এ পর্যন্ত এই ৩৯ বছরে, আর তা করেনি অর্থাৎ '৭১- এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের মাটিতে পরাজয়ের পর তারা আর বড় কোন যুদ্ধ বাধায়নি।

তবে মনে রাখতে হবে যে, ৭১ সালেই ভারতীয় সামরিক বাহিনী তর্কাতীতভাবে বিজয় পায়। এর আগে পাকিস্তানের সাথে তাদের যুদ্ধ অমীমাংসিত থেকেছে এবং চীনের সাথে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারত পরাজিত হয়েছে। অর্থাৎ ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ও জনগণের হাত ধরে ভারত জয়ের গৌরব অর্জন করেছে।

দ্বিতীয়ত, সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ভারত এখন তার পূর্ব রণাঙ্গন পূর্ব দিক নিয়ে অনেক নিশ্চিন্ত। এটা তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বর্ধিত সমূহ বিনিয়োগের সুবিধাও এনে দিয়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশে ভারতের বাণিজ্য দিনকে দিন স¤প্রসারিত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাবনা বাড়ছে। তাই ভারতের উচিত বাংলাদেশকে মূল্যবান সহযোগিতার সম্মান দেওয়া।