‘রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক’ কবিতা রচনার পটভূমি

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 17 Oct 2007, 07:11 PM
Updated : 17 Oct 2007, 07:11 PM

ইতিহাস কী লিখবো মাগো,
আমি তো আর শেষ জানি না।
এই যে মহাকালের ধ্বজায়
রাজার কথা লিখছে প্রজায়
আমি সে-ইতিহাস মানি না।

তোর মাঝে মা অনন্তকাল
ফেলেছে মন মোহিনীজাল।
সবাই যে জাল ছিঁড়তে জানে
সময় কি আর সে জাল টানে?
আমিও সেই জাল টানি না।

তোর প্রেমের ঐ সিংহাসনে,
সবাই কি আর বসতে জানে?
কাব্যে-সাহিত্যে-গানে
আমি যমের বুকে বজ্র হানি,
কমের বুকে শেল হানি না।

কালের ইতিহাসের পাতা
সবাইকে কি দেন বিধাতা?
আমি লিখি সত্য যা তা,
রাজার ভয়ে গীত ভনি না।

উপরে উদ্ধৃত কবিতাটি মৎ-বিরচিত ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ 'ও বন্ধু আমার'-এর অন্তর্গত। আমার এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৭৫ সালটি আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত শোকাবহ একটি

……
নির্মলেন্দু গুণ, ছবি: ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি
…….
বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। নৃশংসতার মাত্রা-বিচারে এ রকম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে নজিরবিহীন। ঐ বছরের ৩ নভেম্বর, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আমাদের চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। ঐ বছরের ৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত-খুনীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে, ঐ অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ, লে. কর্নেল এটিএম হায়দার ও কর্নেল বজলুল হুদা জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুগত কতিপয় সেনা-সদস্যের হাতে নিহত হন।
—————————————————————–
জগা সাধুর আশ্রমে রামপ্রসাদের গান শুনতে শুনতে হঠাৎ একদিন আমার মনে হলো, এই লোকসুরে আমি যদি কিছু গান লিখি, তো মন্দ হয় না। সাহিত্যের খুব উপকার না হলেও তাতে আমার অন্তর শান্ত হবে। তখন আমি রামপ্রসাদী সুরে কয়েকটি গান লিখি। শুধু রামপ্রসাদী সুরে নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরেও তখন আমি কিছু গান বেঁধেছিলাম।
—————————————————————-
১১ নভেম্বর পিজি হাসপাতালে চিকিৎসারত আবুল হাসানকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালের গেটে আমি কর্নেল নওয়াজিস আহমদের হাতে গ্রেফতার হই। এক সপ্তাহ বন্দি থাকার পর, পরম করুণাময়ের কৃপায় ১৬ নভেম্বর আমি মুক্তি পাই।

২৬ নভেম্বর ১৯৭৫, আমরা হারাই বাংলাদেশের কাব্যজগতে অত্যন্ত শক্তিমান কবি হিসেবে আবির্ভূত আবুল হাসানকে, ব্যক্তিগতভাবে যিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধব। আবুল হাসানের ভাষায় 'উদ্বাস্তু উন্মূল যৌবনসঙ্গী'।

ঐ বছর আমার দু'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথমটি হচ্ছে 'চৈত্রের ভালোবাসা'। প্রকাশকাল জুন ১৯৭৫। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা ছিলো প্রেমের। এক সুন্দরী-বিদুষীর প্রেমে পড়ে আমি তার চিত্তজয়ের নেশায় খুব দ্রুত ঐ কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলাম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে 'ও বন্ধু আমার'। প্রকাশকাল ডিসেম্বর ১৯৭৫।

মুজিব-হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা আমার প্রেমনিমগ্ন কবিচিত্তকে মুহূর্তে বিধ্বস্ত করে দিয়ে যায়। আমার ভিতরে মৃত্যুভয় প্রবেশ করে। আমি কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। সেখানেও মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করে ফিরে। আমার ব্যথিত-অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য আমি তখন আমাদের গ্রামের নদী তীরবর্তী শ্মশানঘাটে জগা সাধুর আশ্রমে যেতে শুরু করি। সেখানে সংসার-ত্যাগী, শুভ্র জটাচুল ও শ্মশ্র"ধারী জগা সাধু ভক্তদের রামপ্রসাদী গান গেয়ে শোনাতেন। আমাদের গ্রামের মানুষ তো ছিলোই, আশপাশের গ্রাম থেকেও সঙ্গীত ও সিদ্ধিপিপাসুরা ঐ আশ্রমে আসতো। সেখানে দিনরাত গান ও সিদ্ধিসেবন চলতো। রামপ্রসাদের গান আমাদের এলাকায় খুব প্রচলিত ছিলো। আমার বাবাও রামপ্রসাদের গান গাইতেন।

জগা সাধুর আশ্রমে রামপ্রসাদের গান শুনতে শুনতে হঠাৎ একদিন আমার মনে হলো, এই লোকসুরে আমি যদি কিছু গান লিখি, তো মন্দ হয় না। সাহিত্যের খুব উপকার না হলেও তাতে আমার অন্তর শান্ত হবে। তখন আমি রামপ্রসাদী সুরে কয়েকটি গান লিখি। শুধু রামপ্রসাদী সুরে নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরেও তখন আমি কিছু গান বেঁধেছিলাম। 'ও বন্ধু আমার' কাব্যগ্রন্থে শুধু দু'টি রামপ্রসাদী নয়, 'চিরকালের বাঁশি' শিরোনামে ১৫টি দুর্বল রবীন্দ্রসঙ্গীতও রয়েছে। পরে 'চিরকালের বাঁশি' নামে আমার একটি গানের বইও বেরোয়।

'ও বন্ধু আমার' কাব্যের অন্তর্ভুক্ত 'রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক ১-২' গান দু'টি যতটা মনে পড়ে আমি লিখেছিলাম জগা সাধুর আশ্রমে বসেই। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী নতুন শাসকগোষ্ঠী যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করবে, তার কিছু আলামত আমি টের পাচ্ছিলাম বলেই 'রামপ্রসাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক' গীতিকবিতাটিতে, রামপ্রসাদী সুরের মোড়কে আমি আমার প্রাণের বেদনা ও বিদ্রোহকে প্রকাশ করেছিলাম।

ঐ গীতিকবিতার রচনাকাল, খুব সম্ভবত ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের কোনো একদিন হবে। আমি আমার কবিতার রচনাকাল কখনও লিখে রাখি না।

'ও বন্ধু আমার' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ঐ বছরের ডিসেম্বরে। তাই আবুল হাসানের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে লেখা 'আবুল হাসানের কবর থেকে ফিরে' এবং 'হাসানের জন্য এলিজি' কবিতা দুটিকে স্থান দেয়া সম্ভব হয়েছিল। ঐ কাব্যগ্রন্থটি আমি আমার অকাল-প্রয়াত বান্ধব কবি আবুল হাসানকে উৎসর্গ করি।

তখনও পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখার সাহস আমার হয়নি। ক্ষমতাসীন খুনীচক্রের ভয়ে তখন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম কেউ মুখে নিতে সাহস পেতো না। নিহত বঙ্গবন্ধু ও আমার অকাল প্রয়াত কবিবন্ধু আবুল হাসানকে যুগপৎ স্মরণে রেখেই আমি সুকৌশলে আমার কাব্যগ্রন্থের নাম রাখি 'ও বন্ধু আমার'। ঐ কাব্যগ্রন্থের সাদা-কালো রঙের শোকাচ্ছন্ন প্রচ্ছদটিও ছিলো আমারই আঁকা।

ঢাকা, অক্টোবর ২০০৭
nirmal_goon@yahoo.com

বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: