ডরিস লেসিং-এর তিনটি বইয়ের কাহিনী

কৌশিক আহমেদ
Published : 18 Oct 2007, 11:42 AM
Updated : 18 Oct 2007, 11:42 AM

দি ক্লেফ্ট: পৌরাণিক নারীবিশ্বে পুরুষের উদ্ভব

দি ক্লেফ্ট পুরোমাত্রায় একটা বণর্নাধর্মী উপন্যাস। ক্লেফ্ট বলতে নারী ও পুরুষের পাহাড়ী বসবাসস্থান ও স্ব স্ব জননেন্দ্রীয়কে বোঝানো হয়। উপন্যাসে নিরোর সময়ের একজন রোমান ইতিহাসবিদ পৌরানণক একটা কাহিনী শোনান। প্রাগৈতিহাসিক কালের কোনো এক সময়ে জগতে কেবল নারীর অস্তিত্ব ছিল। তেমন কাল্পনিক চিত্রে নারীকে আঁকা হয়েছে অলস, সাম্প্রদায়িক ও শুশুকের মত নিরীহ প্রাণী হিসেবে। নারীরা যখন থেকে ছেলেদের জন্ম দেয়া শুরু করলো সেই থেকে অশান্তির সূচনা। অবশ্য ক্রমশ নারী ও পুরুষ পাশাপাশি সহাবস্থান করতে শেখে।

একদিন অসতকর্ভাবে একজন নারী জন্ম দিল ভয়ংকর এক দৈত্য যার ছিল বিশাল পিণ্ড আর উত্থিত মাংশ, দেখতে অনেকটা ক্লিবের মতই। ভীত নারীরা সেই নবজাতকটির মৃত্যু কামনা করে পাহাড়ে নিবার্সন দিল।

তাদের হতবুদ্ধি করে দিয়ে আরো এমন পুরুষ শিশু জন্ম হতে থাকলো; এবং তাদেরকেও মারার জন্য রেখে আসা হতো। অবশ্য ঈগলের কল্যাণে কয়েকটা নবজাতক বেঁচেও গেল। একবার এক ঈগল কয়েকটা শিশুকে উপত্যকায় তুলে নিয়ে গেল। মা হরিণ দুগ্ধ পান করালো। বেঁচে উঠলো কয়েকটা শিশু। কালক্রমে দুটো সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হলো। একদল থাকল উপত্যকায়। যারা অসংগঠিত, অবোধসম্পন্ন ও অভিযানান্মুখ; অন্যদল থাকল সাগরপাড়ের গুহায়। সহজ আর বাস্তব বোধসম্পন্ন।

উপন্যাসে এরপরে উঠে আসে দুটো সম্প্রদায়ের কাছাকাছি হওয়ার চিত্র। পারস্পরিক চাহিদার প্রসার ও দুঃখগাথা। নারীরা ক্রমশ আবিষ্কার করলো তারা এককভাবে আর সন্তান উৎপাদনে সক্ষম নয়। অশান্তি বেড়ে গেল পুরুষ ছাড়া নিজেদের অসম্পূর্ণ দেখে। দেখলো, পুরুষেরা পিতৃত্বের দায়িত্ব এড়িয়ে, সন্তানদের জীবন বিপন্ন করে, অভিযানে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

সুগ্রন্থিত ব্যঙ্গের মাধ্যমে হলেও সমাজ-সৃষ্টির একটা আশাপ্রদ কাঠামো অনুসন্ধানের প্রয়াস বলা যায় ক্লেফ্ট উপন্যাসটিকে। ডরিস লেসিং তার পূবর্সূরীকে দেখিয়েছেন ভিক্টোরিয়ান আদলে, যেখানে নারীরা পরোক্ষ, অনুৎসাহী; আগ্রহ কেবল সন্তান ধারণে ও আভিজাত্য রক্ষায়। পুরুষরা কৌতূহলী, উদ্ভাবক, অভিযাত্রী; আবার দায়িত্বহীনও।

উপন্যাসটিতে বৃদ্ধ বর্ণনাকারী একজন স্বল্পবয়স্কা রমণীর সাথে ভালোবাসাহীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০০৫-এর শ্রেষ্ঠ উদীয়মান লেখক হিসেবে জন ডব্লিউ ক্যাম্পবেল পদকপ্রাপ্ত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের রিভিউয়ার এলিজাবেথ বিয়ারের মতে উপন্যাসে বর্ণিত মানব সমাজের প্রথম সৃষ্টি নারীকে পরিষ্ফূটনের এই কল্পিত ইতিহাসকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য ইতিহাসবর্ণনাকারীকে তৈরি করা যেত একটা চমৎকার চরিত্র হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই চরিত্রটি শেষপযর্ন্ত ব্যঙ্গাত্মক বণর্নায় সীমিত হয়ে পড়েছে। তার মতে, ডরিস লেসিং-এর নোবেল প্রাপ্তি তার রচিত "দি ক্লেফ্ট"-কে আরো বেশি রহস্যপূর্ণ করে তুলেছে। তিনি মনে করেন, এটা কেবল ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যর্থ নয়, বাজে উপন্যাসও বটে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গার্ডিয়ানের রিভিউয়ার জেরালডিন বেডেলও উপন্যাসে কোনো চরিত্র না থাকাটাকে অসুবিধা হিসেবে চিন্থিত করেছেন। অবশ্য একটা উপন্যাসে চরিত্র থাকার আবশ্যিক কোনো নিয়মও নেই, তারপরও যে সমস্ত ঔপন্যাসিকরা নির্মিত উপখ্যান থেকে উপন্যাস রচনা করেছেন তারা প্রথমেই প্রধান চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বিধৃত করেন। এতে উপন্যাসের বিষয়ে প্রবেশ সহজসাধ্য হয়। ক্লেফ্ট-এ বর্ণিত মানববসতি আজ বিলুপ্ত বলে বিষয়টা বোঝাও দুরূহ। এত সুদূরের ঘটনা যে তাদের ব্যক্তিক স্বত্তা ও প্রেম বিষয়ক কোনো ধারণাই আমাদের নেই।

উপন্যাসের বিষয়বস্তু যদিও কাঠামোর কারণে হোচট খেয়েছে তারপরেও লেসিং উপন্যাসটিতে মানুষের আশা ও হতাশার তীব্র অনুভূতি সঞ্চার করতে পেরেছেন। চরিত্রের ব্যক্তিক উপলব্ধি না থাকলেও লেসিং-এর লেখা পরিবর্তনের আকাক্ষাকে চালিত করে। তিনি এমন এক শক্তিশালী বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়েছেন যা মানুষকে তার অবস্থার অস্থায়ীত্বকে এবং বিপরীতভাবে মানব সম্পর্কের অপরির্তনীয় চিত্রকেও তুলে ধরে।

পুরুষ প্রজাতির মানবের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণার কারণে ডরিস লেসিংকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে তিনি 'নারীবাদী ঔপন্যাসিক'-এর অভিধা খারিজ করে দিয়েছেন। যে সমাজে মানবের প্রাথমিক ও প্রধান উপাদান হিসেবে পুরুষ স্বীকৃত সেখানে কেউ কেউ ক্লেফ্টকে নারীবাদী নতুন একটা ঘরানা বলে বিবেচনা করেন।

এই উপন্যাসটির বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক অভিযোগ এখনও উত্থাপিত হয় নি। এটাতে শুধুমাত্র বিবৃত হয়েছে যে পৃথিবীতে নারীরাই প্রথম আবির্ভূত হয়। লেসিং দাবি করেন, উপন্যাসটি একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত যা নারীকে মৌলিক ও প্রাথমিক মানব হিসেবে সম্ভাব্য একটা ধারণা প্রদান করে। এবং সেটি তার পুরুষ সৃষ্টির নব সংযোজন অভিমতের সাথে সামঞ্জস্যময়। তার মতে পুরুষের নারীর মত দৃঢ়তা নেই। নারীর আছে প্রাকৃতিক কোমলতা, বিশ্বও এমনই। তুলনায় পুরুষ অস্থিরমতি।

দি গোল্ডেন নোটবুক : রঙিন ক্যনভাস

ডরিস লেসিং এর সবচেয়ে দীর্ঘ ও উচ্চাভিলাষী সৃষ্টি 'দি গোল্ডেন নোটবুক'। প্রতিটি প্রকাশক ছাপার জন্য উদগ্রীব থাকবে এমন এক বিরল প্রতিভার বিরল সৃষ্টি হচ্ছে 'দি গোল্ডেন নোটবুক' উপন্যাস। বর্তমান সময়ের ইংরেজী সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিশেবে এটাকে চিন্থিত করা যায় নির্দ্বিধায়। যে সময়ে আমরা বাস করি তার আচরণ, উচ্চাকাক্ষা, আশঙ্কা এবং নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার বর্ণীল কীর্তি এই উপন্যাস।

হেনরিক ইবসেন ও জর্জ বার্নাড শ যেমন নতুন এক নারীর চিত্র তুলে ধরেন তেমনি এক প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় 'দি গোল্ডেন নোটবুক'-এর আন্না চরিত্রটিতে। এতে একজন আধুনিক নারীর জটিল জীবনকাব্য বিশ্বাসযোগ্যভাবে বর্ণিত হয়েছে।

আন্না পুরুষের মত স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেষ্টা করে। সে একজন লেখিকা, সার্থক একটি উপন্যাস রয়েছে তার। চারটি নোটবুকে লিখে চলেছেন তিনি। কালো রঙের নোটবুকটিতে লেখেন অতীতের আফ্রিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। লাল রঙেরটিতে রাজনৈতিক জীবনের ঘটনা, কমিউনিজমে মোহভঙের কথা। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কাহিনী একটা চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে হলুদ নোটবুকটিতে লিখছেন একটা উপন্যাস। আর নীল নোটবুকটি একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরি। পরিশেষে আমেরিকান এক লেখকের সাথে মানসিক সম্পর্কে বিপযস্ত হয়ে চারটি নোটবুকের সব লেখা একটা সোনালী নোটবুকে সন্নিবেশিত করেন।

জীবনের এই নানাবিধ ঘটনার চিত্র বর্ণনা করে আন্না সাম্প্রতিক সময়ের এক রঙিন ক্যনভাস তুলে ধরেছেন। মুহূর্তের জন্যও এর সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হওয়া যায় না। নিখুত প্রামাণিক বর্ণনাধর্মী শিল্প উদ্ভাসিত করে একজন প্রাজ্ঞ নারীর রূপকে। প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে চালিত বিতর্ককে তিনি আরো শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।

মারা ও ডান : পৌরাণিক অভিযাত্রা


হাজার বছর পরের নতুন বরফ যুগের সময়ের ঘটনা। সমগ্র উত্তর গোলার্ধ তলিয়ে গেছে একশ ফিট বরফের নীচে। একদম দক্ষিণের বৃহৎ জনবসতি ইফ্রিকের মাহোন্ডি জনগোষ্ঠির সাত বছরের বালিকা মারা এবং তার কনিষ্ট ভ্রাতা ড্যান প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে এক রাত্রিতে ঘর থেকে বিতারিত হয়। কোন এক দরিদ্র গ্রামের সহানুভূতিশীল একজন মাহোন্ডি মহিলা তাদের আশ্রয় দেয়। জলবায়ুর বিরূপতা, খরা ও জন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচার সংগ্রাম শিখলো ক্রমশ। বর্বর পাহাড়ী জনপদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে যুদ্ধ করাও শেখে। এই বর্বর জাতি তাদের ঘৃনা করতো। দক্ষিণের খরা পর্যুদস্ত ভূমি ধুলোয় ধুসরিত হতে থাকলে পর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য পাওয়া যাবে এমন স্থানের খোজে তারা উত্তর অভিমূখী অভিবাসী দলে যোগ দেয়।

যাত্রাপথে তারা নানামূখী বিপদের সম্মুখীন হয় আবার বেঁচেও যায়। অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরান জনপদে পরিণত অঞ্চলে বেঁচে থাকতে প্রানন্ত সংগ্রামে নিয়োজিত হয়। কখনও বন্দী হয় হারডন জনগোষ্ঠির হাতে। পালিয়েও যায় আবার। উত্তরের দিকে চলতে থাকে। টাউনস নদীর উষ্ণ জল পেড়িয়ে। চ্যারাড নামক একটা দেশে পৌছে বন্দী হয় সৈন্যবাহিনীর এক কমান্ডারের হাতে। চ্যারাড চিরস্থায়ী যুদ্ধের দেশ। ড্যান একসময় সেদেশের সৈন্যবাহিনীর জেনারেল হয়। মারা হয় গুপ্তচর। কিন্তু বিপক্ষ একটা গোষ্ঠী তাকে ছিনতাই করে নিয়ে গেলো গোপন তথ্য লাভের আশায়। একসময়ে উভয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হলো। তারপরে আবার শুরু হলো উত্তর অভিমূখে যাত্রা। মারার জলের জন্য হাহাকার করলে ড্যান তাকে বাঁচিয়ে তোলে। ভ্রাতা-ভগ্নি পরস্পরকে প্রচন্ড ভালবাসে, উত্তরের পানে যাত্রাকালিন আপদে শতাধিকবার একে অপরকে রক্ষা করেছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারে নি উত্তর কি? উত্তরে গিয়ে তারা কি পাবে?

মারার মনে প্রশ্ন জাগে অজস্র। কে তাদের পিতামাতা? এবং কেন অসংখ্য মানুষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছে তাদের বাঁচাতে? তারা এমন কি মূল্যবান? চারিপাশের এই ধ্বংষস্তুপের নগরীতে অতীতকালে কারা বাস করতো? কেন এই নগর ও সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছে? মারা স্বপ্ন দেখে পানি, বৃক্ষ আর সুন্দর নগরীর। ভদ্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষের। শক্তিশালী প্রাকৃতিক শক্তি মারা ও ড্যানের অভিযাত্রাকে চালিত করলেও এবং হাজারো নিষ্ঠূরতার মাঝে থেকেও মারার ভেতরে বিরাজ করে এক সুতীব্র অনুভূতিসর্বস্ব প্রেমময়তা। ডরিস লেসিং এর আকর্ষণীয় নায়িকাদের মধ্যে মারা এক অনবদ্য সৃষ্টি। আর প্রাগৈতিহাসিক যেকোন গল্পের নায়কের মতই ড্যানকে আপনারা একজন সাহসী নায়ক হিশেবে দেখবেন।

কাল্পনিক এক ভবিষ্যতে অবিস্মরনীয় এক অভিযাত্রায় শামিল এক ভাই আর এক বোনের গল্প ফুটে উঠেছে এই মজার উপন্যাসটিতে। কাল্পনিক কাহিনীর একজন দক্ষ রচয়িতা লেসিং আমাদের সময় সম্পর্কে অসচেতনতা ও গুরুত্ব দেবার অপারগতা বিধৃত করেছেন স্বচ্ছ দৃষ্টির চমৎকার পর্যবেক্ষণে।