নারী-অভিজ্ঞতার মহাকাব্যকার ডরিস লেসিং

অবনি অনার্য
Published : 18 Oct 2007, 12:46 PM
Updated : 18 Oct 2007, 12:46 PM

গত, অন্তত, বছর তিনেক যাবৎ নোবেল সাহিত্য বিজয়ী নিয়ে নানামুখী তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তর্ক-বিতর্কের প্রধান বিষয় দুটি – সাহিত্যরচনার মান এবং সাহিত্যিকদের রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা। আমাদের মনে পড়বে, ২০০৪ সালের নোবেল সাহিত্য বিজয়ী হিসাবে এলফ্রিয়েদে ইয়েলিনেক-এর নাম ঘোষণা করলে নোবেল সাহিত্য নির্বাচক কমিটির একজন বিচারক, নাট আনলান্ড, পদত্যাগ করেন। ইয়েলিনেক-এর সাহিত্যরচনা তাঁর কাছে কেবল শব্দের-পর-শব্দ বসানো শিল্পগুণ-বিবর্জিত রচনা মনে হয়েছে, এবং ইয়েলিনেককে নোবেল সাহিত্য বিজয়ী ঘোষণার মধ্য দিয়ে নোবেল কমিটি পদকটির মর্যাদার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

পদত্যাগের প্রসঙ্গে আমাদের নিশ্চয়ই আরো একটি ঘটনা মনে পড়বে – সালমান রুশদির ওপর ইরানের আয়াতুল্লাহ খুমিনি কর্তৃক ফতোয়া ঘোষিত হলে নোবেল সাহিত্য কমিটির পক্ষ থেকে রুশদিকে সমর্থন না করায় দুজন বিচারক পদত্যাগ করেন ১৯৮৯ সালে। যাহোক, ইয়েলিনেক-এর পর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেলেন যুক্তরাজ্যের হ্যারল্ড পিন্টার (২০০৫) এবং তুরস্কের ওরহান পামুক (২০০৬)। তাঁদের দুজনকে নিয়ে বিতর্ক রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতা। এবারের নোবেল বিজয়ী ডরিস লেসিংকে নিয়েও পার্শ্ব-আলোচনার সুযোগ আছে। গত দু'বারের নোবেল সাহিত্য বিজয়ী পিন্টার এবং পামুকের মতো, নিজ নিজ দেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে দু'জনের ভাষ্য, সেটার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্ক ইত্যাদির মতোই, ডরিস লেসিংকে নোবেল সাহিত্য পুরষ্কার প্রদানের সঙ্গে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আমেরিকার আগ্র্রাসী মনোভাবের মধ্যস্থতা করার প্রবণতার মিল লক্ষ্য করা যায়। অন্য একটা কারণেও ডরিস লেসিং নিজেই বিস্মিত! আসছে ২২ অক্টোবর তাঁর বয়স হবে ৮৮। উল্লেখ করা দরকার, তিনিই বয়োজ্যেষ্ঠ নোবেল সাহিত্য বিজয়ী।

জীবনসায়াহ্নে এসে নোবেল সাহিত্য বিজয়ের সংবাদে ডরিস লেসিং নিজেই বিস্মিত, বিস্মিত সাহিত্য-রাজনীতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মানুষ। অনেকেই এর মধ্যে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন। কোথায় সে রাজনীতির গন্ধ? এর উত্তর পাওয়া যাবে সম্ভবত লেসিং-এর জীবনীতেই। কেননা এ রাজনীতি নারীবাদী সাহিত্য সংশ্লিষ্ট রাজনীতি।

২.
১৯১৯ সালের ২২ অক্টোবর পারসিয়ায় (বর্তমান ইরান) জন্মগ্রহণ করেন ডরিস মে টেইলার। বাবা-মা দুজনই ব্রিটিশ। বাবা ছিলেন ইমপেরিয়াল ব্যাংক অব পারসিয়ার কেরানী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পঙ্গু হন ডরিসের বাবা। মা ছিলেন নার্স। ভুট্টা চাষ করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হবার আশায় ডরিসের বাবা-মা ডেরা গাড়েন ব্রিটিশ কলোনি দক্ষিণ রোডেশিয়ায় (বর্তমানে যেটা জিম্বাবুয়ে)। ডরিসের বাবা না চাইলেও মা'র স্বপ্ন ছিলো রাতারাতি কেতাদুরস্ত বনে যাওয়া। মা'র স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। হাজার একর জমি ব্যর্থ হলো কাংক্ষিত ফসল উৎপাদনে।

লেসিং তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, সামান্য আনন্দ আর অশেষ বেদনায় রচিত ছিলো তাঁর শৈশব। বেদনা-আক্রান্ত শৈশবের একমাত্র প্রশান্তি বলতে ভাই হ্যারির সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোই। মেয়েকে যথার্থ মেয়ে হিসাবে বড় করার লক্ষ্যে ডরিসের মা বাড়ির ভেতরে-বাইরে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেন। প্রথমে তাঁকে ভর্তি করানো হয় যাজক-পরিচালিত স্কুলে যেখানে নানদের মুখে কেবল স্বর্গ-নরকের ভয়ঙ্কর গল্পই শুনতে হতো। পরে সালিসবারির রাজধানীতে একটি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। অচিরেই স্কুল পড়াশোনার ইতি ঘটে। ডরিসের বয়স তখন তেরো, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষার এখানেই সমাপ্তি ঘটে তাঁর।

দক্ষিণ আফ্রিকার অলিভ শ্রেইনার, কিংবা নাদিন গর্ডিমারের মতো লেখকরাও উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতে পারেননি। তাঁদের মতো করে ডরিসও স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। তিনি মনে করেন, অসুখী ছেলেবেলা গল্পকার বানানোর কারিগর। তাঁর ভাষায়, আমি মনে করি এটা বাস্তব। যদিও তখন ব্যাপারটা অতো পরিষ্কার বুঝতে পারিনি, এবং নিশ্চয়ই, ভবিষ্যতে লেখক হবো এমনটাও তখন মনে হয়নি। কিন্তু একটা ব্যাপার ছিল, আমি সারাক্ষণ সবকিছু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইতাম।

লন্ডন থেকে পার্সেলে বই আসতো। ডিকেন্স, স্কট, স্টিভেনসন, কিপলিং-এর পর যোগ হলো ডি.এইচ. লরেন্স, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি। মায়ের মুখের ঘুমপাড়ানী গল্প, বাবার মুখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত-অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুনতে কৈশোর কেটেছে ডরিসের। যুদ্ধের বিষয়টা ডরিসের মনে দাগ কেটেছে গভীরভাবে। তিনি লিখেছেন, "আমাদের সবার জন্ম যুদ্ধের ভেতর দিয়ে, যুদ্ধ আমাদের ক্ষত-বিক্ষত করে, অথচ আমরা অচিরেই সেসব ভুলে যাই।" নোবেল বিজয়ী ঘোষণা করার পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবের এক পর্যায়ে জানা যায়, তাঁর পরবর্তী লেখাটিও 'একটি আবেগঘন যুদ্ধ-বিরোধী' লেখা। তাঁর সর্বসাম্প্রতিক লেখা 'আলফ্রেড অ্যান্ড এমিলি' -তে তিনি তাঁর বাবা-মা'র জীবনের এমন একটি ছবি এঁকেছেন যেখানে যুদ্ধ তাঁদের জীবনকে বাধাগ্রস্ত করেনি।

পনেরো বছর বয়সে মার হাত থেকে পালিয়ে নার্সমেড-এর চাকরি নেন ডরিস। চাকরিদাতার কাছ থেকে রাজনীতি-সমাজনীতির বই পেতেন ডরিস, আর চাকরিদাতার শ্যালকের কাছ থেকে পেতেন রাতের বেলায় এলোপাতাড়ি চুমু। ডরিস বলেছেন, এ সময় তিনি কামতাড়নায় অস্থির হয়ে উঠতেন। গল্প লেখা চলছে সে সময়, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাগাজিনে দুটো গল্প ছাপাও হয়েছিল।

১৯৩৭ সালে সালিসবারিতে ফেরেন টেলিফোন অপারেটরের চাকুরি নিয়ে। বছরখানেক চাকুরি করেন সেখানে। ঊনিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন ফ্রাংক উইজডমকে, দুটো সন্তানের জন্ম হয় তাঁদের। কয়েক বছর পরেই পারিবারিক জীবনে আটকা পড়ে যাচ্ছেন এই ভয়ে পরিবার ত্যাগ করে সালিসবারিতে থেকে যান। শীগগিরই কম্যুনিস্টদের গ্রুপ লেফট বুক ক্লাবের সমমনা সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হন, এবং গ্রুপে যোগ দেন। ডরিস যখন গ্রুপে যোগ দেন, তখন গ্রুপের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন গটফ্রিড লেসিং। ডরিস এবং গটফ্রিড লেসিং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয়।

যুদ্ধোত্তরকালে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাস হারান ডরিস, এবং ১৯৫৪ সালে কম্যুনিস্ট আন্দোলন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হন। ১৯৪৯ সালের মধ্যে ছোট ছেলেসহ লন্ডনে চলে আসেন ডরিস। ওই বছরই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য গ্রাস ইজ সিংগিং' প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর পেশাদার লেখকজীবনের শুরু।

লেসিং-এর ফিকশন গভীরভাবে আত্মজীবনীমূলক যার অনেকটা জুড়েই আছে আফ্রিকার অভিজ্ঞতা। তাঁর লেখার মধ্যে আছে তাঁর নিজের রাজনীতি-সমাজ-সংশ্লিষ্টতা, নানামুখী সংস্কৃতির বিরোধ, বর্ণবাদ কেন্দ্রিক অসাম্যের অবিচার, ব্যক্তির নিজের মধ্যে উপস্থিত বিপরীতমুখী উপাদানগুলোর বিরোধ, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ এবং সামষ্টিকতার বিরোধ। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আফ্রিকার প্রেক্ষাপটে রচিত গল্প-উপন্যাসগুলোতে আছে সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে কালোদের সব হারানোর কান্না, দক্ষিণ আফ্রিকায় হোয়াইট কালচারের অসারতা। স্পষ্টভাষণের কারণেই দক্ষিণ রোডেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হন লেসিং।

১৯৫১-১৯৫৯ সালে রচিত শিক্ষামূলক সিরিজ উপন্যাস 'চিলড্রেন অব ভায়োলেন্স' লেখার পর অন্য এক ডরিস লেসিং বেরিয়ে আসেন। ১৯৬২-তে এসে তিনি লেখেন "দ্য গোল্ডেন নোটবুক"-এর মতো অসমসাহসী বর্ণনাত্মক নিরীক্ষাধর্মী বয়ান, যেখানে একজন সমসাময়িক সাহিত্যিকের বিভিন্নমুখী সত্তা ফুটে ওঠে অবিশ্বাস্য গভীরতা এবং ব্যাপ্তি নিয়ে।

ডরিস লেসিং-এর অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আছে 'দ্য গুড টেরোরিস্ট (১৯৮৫)', 'দ্য ফিফথ চাইল্ড (১৯৮৮)'। জেন সমারস ছদ্মনামে তিনি দুটো উপন্যাস প্রকাশ করেন: 'দ্য ডায়েরি অব আ গুড নেইবার (১৯৮৩)' এবং 'ইফ দ্য ওল্ড কুড (১৯৮৪)'।

১৯৯৫ সালের জুনে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অনারারি ডিগ্রি গ্রহণ করেন ডরিস, এবং একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। ১৯৫৬ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার পর সেটাই প্রথম ভ্রমণ। চল্লিশ বছর আগে যেসব বিষয়ের জন্য তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, সেবার সেসব বিষয়ের ওপরই লেখক হিসাবে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। ওদিকে দীর্ঘ তিরিশ বছর আউট অব প্রিন্ট থাকার পর ১৯৯৬ সালে হার্পারকলিন্স থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয় তাঁর 'গোয়িং হোম' এবং 'ইন পারস্যুট অব ইংলিশ'। অসাধারণ বই দুটিতে পাওয়া যায় তাঁর ব্যক্তিত্ব, জীবনদর্শনের গভীর অন্তর্দৃষ্টির সন্ধান।

গল্প, উপন্যাস ছাড়াও ডরিস লেসিং কবিতা, নাটক, এমনকি সায়েন্স ফিকশনও লিখেছেন। অবশ্য লেসিং-এর সায়েন্স ফিকশনকে চতূর্থ শ্রেণির সায়েন্স ফিকশন হিসাবে উল্লেখ করেছেন সাহিত্য সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম।

দীর্ঘ সাত বছরের ব্যবধানে, ১৯৯৬ সালে, প্রকাশিত হলো তাঁর নতুন উপন্যাস 'লাভ অ্যাগেইন'। এর আগে তাঁর আত্মজীবনী প্রচারের জন্য বিশ্বভ্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য এই বইটির কোনো প্রচারে বের না হবার সিদ্ধান্ত নিলেন ডরিস। অথচ এই বইয়ের জন্য সেবার নোবেল সাহিত্য এবং ব্রিটেনের উইনটারস গিল্ড অ্যাওয়ার্ড ফর ফিকশন-এর জন্য মনোনীত হন। তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড 'ওয়াকিং ইন দ্য শেড' প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে, এবং সেবারই ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কল অ্যাওয়ার্ড-এর জীবনী/আত্মজীবনী বিভাগে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।

৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯, নতুন সহস্রাব্দ শুরুর প্রাক্কালে যুক্তরাজ্যের অনার্স লিস্টে 'কম্পেনিয়ন অব অনার' হিসাবে নিযুক্ত হন। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ওই পুরস্কার প্রদান করেন। ২০০৫ সালে প্রথম ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ-এর শর্টলিস্টে ছিলেন। ২০০৭ সালের ডরিস লেসিং নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ডরিস মোটেও উচ্ছ্বসিত নন এ-পুরস্কারে, যেমনটি হননি ২০০৩ সালের নোবেল সাহিত্য বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার জে.এম. কোয়েৎজিও।

ঢাকা, অক্টোবর, ২০০৭
aunarjo@gmail.com