ব্যুরজোয়ার মাকড়সা বৃত্তান্ত

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 15 Nov 2007, 05:22 PM
Updated : 15 Nov 2007, 05:22 PM


মেঘলা এক রোববারে টানা ঝিরঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের টিউবভ্রমণ শেষে যখন টেট মডার্ন-এ পৌঁছলাম তখন ভ্রমণক্লান্তিতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া আর চার বছরের পুত্র মাতিসও ক্লান্ত।

আয়োজনটা প্যাট্রিসিয়ার। বিয়ের দশ বছর পূর্তি উদযাপন। লন্ডনের দক্ষিণপ্রান্তে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের উল্টোপাশে মিলেনিয়াম সেঁতুর এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে অন্য পাশের টেট শিল্পশালার বিশাল চিমনির সামনে চত্বরে রাখা লুই ব্যুরজোয়ার মাকড়সাটাকে দেখামাত্র এক ঝাঁকুনিতে তিনজনের ক্লান্তি কেটে গেল। তারপর পুরো বিকেল চমকের পর চমক, ভোজের ভেতর ভোজ, কবিতার ভেতর কবিতা, বলায় যার শেষ নেই, রূপকথাতেই পরিচয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার এক দানবীয় বিদ্যুত তৈরির কারখানাকে নব্বইয়ের দশকে টেট মডার্ন শিল্পশালায় রূপান্তরের সময় স্থপতিরা আগের আদল এমনকি কয়লায় চালানো এঞ্জিন ঘরের চিমনিটুকু পর্যন্ত বদলায়নি। এঞ্জিন ঘরের মূল নাম 'টারবাইন হল' এখনো প্রদর্শনীর সময় ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ-বছরের ২৪ অক্টোবর থেকে আগামি বছরের পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত টেট-এ চলবে 'The World as a Stage' নামের প্রদর্শনী। এতে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সেসব শিল্পীকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে যাদের শিল্পকর্মে ফাইন আর্টস-এর সাথে পারফরমেন্স-এর মেলবন্ধন ঘটেছে।

কিউবিস্ট, ফিউচারিস্ট, স্যুররিয়ালিস্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার ও পপ শিল্পীদের বিভিন্ন আমলের বিভিন্ন কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীর মধ্যমনি হল নব্বই পেরুনো জীবিত কিংবদন্তী লুই ব্যুরজোয়া। ১৯১১-তে প্যারিসে জন্ম, ১৯৩৮-এ বিয়ের পর থেকে এ-অব্দি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।

টেট-এর কিউরেটর সাত যুগ ধরে ব্যুরজোয়ার কাজ ৯টি গ্যালারিতে বা পর্বে ভাগ করেছেন। সাত যুগ ধরে ব্যুরজোয়ার মুখের আদল বিভিন্ন আলোকচিত্রীর দৃষ্টিতে কীভাবে ধরা পড়েছে তার ভিত্তিতে বিশাল একটি অ্যালবামও তৈরি করা হয়েছে দরবারি দেয়াল জুড়ে।

নারী শরীর উন্মোচনের মাধ্যমে উনিশ শ চল্লিশের দশকে যাত্রার শুরুতে ব্যুরজোয়া বলেছিলেন : ওই নারীরা জানে না যে ওরা আধা নগ্ন। ওরা এও জানে না যে ওরা পালাতে চাইছে। পালানোর চূড়ান্ত মুহূর্তেই নগ্নতার প্রকাশ।

একই দশকের পুরোটা জুড়ে মার্কিন শিল্প-ইতিহাসবিদ রবার্ট গোল্ডওয়াটারকে বিয়ের পর থেকে তাদের তিন সন্তানসহ ম্যানহাটানের এক অ্যাপার্টমেন্টে কাটান। খোলা ছাঁদ তার স্টুডিও। সে-ছাদ থেকে দেখা আকাশছোয়া স্কাইস্ক্র্যাপারগুলো এ-সময়কার সরু সরু ভাস্কর্যগুলোর প্রেরণা। তিনটি শিশুকে বড় করবার পাশাপাশি শিল্পজগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার সংগ্রাম চলেছে একযোগে। একই সময় 'অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশানিস্ট'দের পুরুষালি প্রকাশভঙ্গির সাথেও তার বিরোধ শুরু হয়। এ-সময় তার সবচেয়ে আলোচিত কাজ হচ্ছে 'সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতায় পুরুষের প্রস্থান' কাঠখোদাই সিরিজ।

সরু ভাস্কর্যগুলোকে বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত করে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বিভিন্ন গ্যালারি আয়োজন করে একের পর এক 'personage' নামের প্রদর্শনী। কুনিং, রথকো, পোলকের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় ব্যুরজোয়ার নাম।

এরপর তার কাজের মাধ্যম হয়ে ওঠে প্লাস্টার ও ল্যাটেক্স। কনিষ্ঠ ইভা হেস, ব্র"স নোম্যানের সাথে জোট বেঁধে নিজেদের শিল্পকর্মগুলোকে দাঁড় করান মিনিমালিজমের বিরুদ্ধে। নামে ও ফর্মে কাজগুলো হয়ে দাঁড়ায় বিশালাকৃতি টাওয়ার।

ব্যুরজোয়ার ভাষায় : গোলমাল নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস; দুটো দিকনির্দেশনা খুব জরুরি – কোথায় তুমি নিজেকে দেখতে চাও, কেন্দ্রে নাকি প্রান্তে?

ষাটের পুরোভাগ ব্যুরজোয়া কাটান নারী-পুরুষের শরীরকে বিভিন্ন আঙ্গিকে উন্মোচন করে। কোনো কোনো কাজে পুরুষ ও নারীর যৌনাঙ্গ একসাথে উপস্থিত। কোনোটিতে শরীর ও ল্যান্ডস্কেপ মিলেমিশে একাকার। ইটালির কারারা অঞ্চলের বিখ্যাত মারবেল খনিতে ব্যুরজোয়া ষাটের শেষ লগ্নে সময় কাটান তার স্মৃতিও এ সময়ের কাজে বর্তমান। এ-সময়ের ওর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ 'বাবার নিধনযোগ্য'।

মার্বেল ভাষ্কর্যগুলো দেখে সমালোচকেরা তাকে রদ্যার সাথে তুলনা করেন। ক্যমি ক্লদেলের কীর্তিগুলোকে গৌন বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া রদ্যার সাথে তুলনায় ব্যুরজোয়া খুশি হয়েছিলেন কিনা বলা মুশকিল।
যা যেভাবে বিশ্বাস করেন তা শিল্পে বিস্তারিত করা ছাড়াও কথায়ও স্পষ্ট করেছেন তিনি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। কোনো কোনো বিষয়ে নিরবতা অবশ্য কিছুতেই মৌন সম্মতি নয়। যৌবনে শিল্প অধ্যয়নের শুরুতে ব্যুরজোয়া কমিউনিস্ট বুদ্ধিবৃত্তির কেন্দ্র মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটালেও সারা জীবনেও প্রত্যক্ষ পরোক্ষ কোনোভাবেই কমিউনিজম বা সোভিয়েট শাসন নিয়ে সমর্থনসূচক মন্তব্য করেন নি। প্রধান সাক্ষাৎকারগুলো দিয়েছেন সবসময় ইংরেজিতে। এ-কারণেই ফরাশি সংস্কৃতির ধ্বজাধর আলিয়ন্স ফ্রন্সেসে তার উপস্থিতি প্রায় শূন্য।

জাতিগোষ্ঠি ও ভাষাগোষ্ঠির যে তর্ক উপনিবেশিকতা পেরিয়ে আধুনিকতায় বিস্তৃত, ব্যুরজোয়ার কাজ, জীবন, অনুশীলন তা পেরিয়ে উত্তর-আধুনিকতায় সার্থকভাবে স্থাপিত। আশির দশক জুড়ে করা আত্মজীবনীমূলক কাজগুলোতে এর প্রমাণ আরো নিবিড়। ১৯৮০-তে ব্যুরজোয়া ব্র"কলিনের এক পরিত্যক্ত কাপড়ের কারখানাকে স্টুডিও হিসেবে ভাড়া নেন। পুঁজিবাদি বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়ায় প্রবল নারীবাদি এক শিল্পীর প্রতীকি নিভৃতি খোঁজবার প্রয়াস। প্রতীকগুলো ব্যক্তিগত, পারিবারিক স্মৃতি বিশেষ করে মায়ের ঘরকন্যার সাজ-সরঞ্জাম ঘিরে গড়ে উঠেছে। কারখানার ভেতর গড়ে উঠল কাঠের তক্তায় ঘেরা বিশাল বিশাল ছাদখোলা এক-দরজার ঘর। ঘরগুলোর নাম 'সেল'। হতে পারে তা কারাগারের সেল, গুলাগের সেল বা ভিক্ষুর নির্জন উপাসনা-ঘর। শিল্পীর নিজের ভাষায় 'সেল' হচ্ছে 'রক্তকণা' : একটি আরেকটির পাশে, কিন্তু আলাদা। প্রদর্শনীর আট নম্বর কক্ষে রাখা বিশালাকার ছাদখোলা ঘরগুলোর একমাত্র সীমানা আকাশ।


পৌঁছলাম শেষ কক্ষে। এখানে রাখা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যুরজোয়ার প্রিয় মাধ্যম কাপড়-কেন্দ্রিক কাজ। গেরস্থালির পুরোনো কাপড়, চোপড়, ন্যাকড়া, ত্যানা দিয়ে বানানো ফিগারেটিভ কাজগুলো মানুষের প্রেম, জন্ম, মৃত্যুকে সরাসরি ধরে রেখেছে মমির মত। কাপড় দিয়ে বানানো বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন আকারের চৌকো ইটের টুকরোর আদল একটির ওপর আরেকটি রেখে অনবদ্য আনন্দদায়ক একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছেন ব্যুরজোয়া।

প্রদর্শনী থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরের আকাশ আরো মেঘলা, আরো ভেজা। ভেতরের আকাশে রংধনু। মাকড়সাটা তখন মায়ের প্রতীক।

লন্ডন, নভেম্বর ২০০৭

লুই ব্যুরজোয়ার রূপান্তর