ঘনিষ্ঠতার ঘোর প্যাঁচ

সপ্তর্ষি
Published : 8 July 2011, 12:35 PM
Updated : 8 July 2011, 12:35 PM

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা , এই ভাষার কোন সীমাবদ্ধতা সচরাচর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। এর কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের মনের সকল ভাবই এই ভাষায় সহজেই প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু এই ভাষারও যে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে,আছে কিছু শব্দের অভাব তা আমরা অনুভব করি তখন, যখন আমরা বন্ধুত্ব , সম্পর্ক কিংবা ঘনিষ্ঠতার সংগা দিতে যায়। একটু চিন্তা করে দেখুন তো আপনি এগুলোর সংগা সঠিক ভাবে দিতে পারেন কিনা? কি অসুবিধা হচ্ছে তো? এবার নিশ্চয়ই ভাষার অভাব বুঝতে পারছেন। আসলে একজন মানুষ আরেক জন মানুষের সাথে বিভিন্ন সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকে। উদাহরন স্বরূপ বলা যায় একজনের সাথে আরেক জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক , পিতা-পূত্রের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক, ভাই-বোনের সম্পর্ক, আরও অনেক ধরনের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কতটুকু প্রবল আর কতটুকু হালকা তা আমরা বুঝতে পারি "ঘনিষ্ঠতা" নামক একটি শব্দের মাধ্যমে। মূলত, একজনের সাথে আরেক জনের সম্পর্ক কম বা বেশি হয় না , কম বা বেশি হয় ঘনিষ্ঠতা। মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব তাই তারা কখনো একা জীবন যাপন করতে পারে না , আর তাই একে অপরের মাঝে বিভিন্ন সম্পর্ক তৈরী করে বা তৈরী হয়। কিন্তু এই সম্পর্ক কখন ঘনিষ্ঠতার রূপ নেই আর কেনই বা এই ঘনিষ্ঠতা কমে?

আসলে দুজন সম্পর্কযুক্ত মানুষের চিন্তা-চেতনার মধ্যে মিল না থাকলে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় না। আবার একজন অন্য জনের কাছে বিশ্বস্ত না হলেও ঘনিষ্ঠতা কমে যায়,অর্থাৎ বিশ্বাস বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং চিন্তা-চেতনার পার্থক্য বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘনিষ্ঠতা কমে। ঘনিষ্ঠতা হ্রাস-বৃদ্ধির অনেক কারণ থাকলেও এই কারণ গুলিই প্রধান।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা ঘনিষ্ঠতাকে একটি তত্ত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি , যা সব ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর তা হচ্ছে ,"পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত দুজন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তাদের মধ্যে বিদ্যমান বিশ্বাসের সমানুপাতিক এবং তাদের দুজনের চিন্তা-চেতনার পার্থক্যের ব্যস্তানুপাতিক।"

অর্থাৎ ,
ঘনিষ্ঠতা ∞ বিশ্বাস ।

এবং ঘনিষ্ঠতা ∞ ১ / দুজনের চিন্তা-চেতনার পার্থক্য।

সুতরাং , ঘনিষ্ঠতা ∞ বিশ্বাস / দুজনের চিন্তা-চেতনার পার্থক্য

বিজ্ঞান বিভাগের যারা ছাত্র-ছাত্রী তারা সহজেই বুঝবেন উপরের সমীকরণের সমানুপাতিক চিহ্নের পরিবর্তে সমান চিহ্ন বসাতে চাইলে আমাদেরকে একটি ধ্রুবক ডান পক্ষে গুণ করতে হবে।

অর্থাৎ , ঘনিষ্ঠতা = সম্পর্ক * বিশ্বাস / দুজনের চিন্তা-চেতনার পার্থক্য।

এখানে সম্পর্ক নির্দিষ্ট সময়ে দুজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য ধ্রুবক।

আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে সম্পর্ক আবার কিভাবে ধ্রুবক হতে পারে ? আমি আগেই বলেছি সম্পর্ক কম বা বেশি হয় না , কম বা বেশি হয় ঘনিষ্ঠতা , সম্পর্ক সব সময় স্থির থাকে। পূত্র তার পিতাকে বাবা বলেই ডাকে , কোন কারণে ঘনিষ্ঠতা কম হলে পিতাকে কখনো চাচা বা খালু নিশ্চয় বলে না। আপনার সাথে আপনার বন্ধুর ঘনিষ্ঠতা কমলে বা একেবারেই না থাকলে আপনি তার সম্পর্কে বলেন, 'সে আমার বন্ধু ছিল' , কারণ ঘনিষ্ঠতা থাক বা না থাক এখানে সম্পর্কের নাম "বন্ধুত্ব"। তাই সম্পর্ক নির্দিষ্ট সময়ে দুজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য ধ্রুবক। নির্দিষ্ট সময় বলছি কারণ সময়ের সাথে সম্পর্ক কখনো কখনো পরিবর্তনশীল। যেমন , আপনার একজন মেয়ে বন্ধুর সাথে আপনার বড় ভাই এর বিয়ে হলে, সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে পরিবর্তিত হয়ে দেবর-ভাবী তে পরিণত হয়।

এবার আমরা দৃষ্টি ফেরাই "বিশ্বাস" এর দিকে। যে কোন সম্পর্ক জমাট বাধার মূলে থাকে বিশ্বাস। বিশ্বাস না থাকলে সন্তান তার মায়ের হাতের খাবার নিশ্চিন্তে খেতে পারতো না , বিশ্বাস অত্যন্ত প্রবল বলেই মাতা-পূত্রের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ। বিশ্বাস না থাকলে একজন তার বন্ধুর সাথে নিশ্চিন্তে কোন অজানা পথে হটতে পারেনা , মনের সকল কথা তাকে বলেনা কারণ তা প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। আর যার সাথে মনখুলে কথা বলা যায়না তার সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকবে কিভাবে ? স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ঘনিষ্ঠতা কমতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বিশ্বাস না করলে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ নিশ্চিত। তাই বিশ্বাস থাকলে ঘনিষ্ঠতা অটুট থাকে, ঠিক যেমনটি পাখি তার ডানাকে বিশ্বাস করে বলে নিবীড় ঘনিষ্ঠতায় তা নিজের শরীরের সাথে লেপটে রাখে।

এবার ধরুন, আপনি মনে করেন পথে চলা কোন তরুণীকে কটু কথা বলে উত্ত্যক্ত করা উচিত নয় , কিন্তু আপনার বন্ধু ভাবে এটা করা অনেক গৌরবের কাজ, তাহলে আপনার পক্ষে তার সাথে পথ চলা কি সম্ভব ?। চোরে-চোরে খালাতো ভাই হয় কিন্তু চোর-গৃহস্থ্য কখনো খালাতো ভাই হয় না। আপনি চান আপনার স্ত্রী পর্দায় থাক কিন্তু আপনার স্ত্রী তা চাইল না। এমন ধরনের মতপার্থক্য যত বেশি হয়, সম্পর্কের গাঢ়তা তত কমে, যা আমি উপরের তত্বের মাধ্যমে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়েছি।

সমাপ্ত
তাং : ২৩-০৮-২০০৭

বি.দ্র. লেখাটি অন্যান্য ব্লগে পুর্বে প্রকাশ হয়েছে