ভাত দে হারামজাদাঃ ইতিকথার পরের কথা

রাজু চাকলাদার
Published : 13 April 2016, 01:15 AM
Updated : 13 April 2016, 01:15 AM

বাংলা কবিতা যাঁরা ভালবাসেন, পড়েন তাদের কাছে অতিপরিচিত একটি কবিতা হলোঃ কবি রফিক আজাদ এর কালজয়ী কবিতা ভাত দে হারামজাদা। এই কবিতার ইতিহাসটা সকল সাহিত্য প্রেমীদের জানা দরকার বলেই লিখতে বসলাম।

তৎকালীন বহুল প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক-এর এক ফটোসাংবাদিক সস্তা-পরিচিতি পাওয়ার জন্য বাসন্তী নামের একজনকে জাল পরিধান করিয়ে ছবি তুললেন। টাকার বিনিময়ে আরেকজনের বমি খাওয়ার অভিনয়ের ছবিও তোলা হলো। এসব মিথ্যাচার তথা হলুদ ফটোসাংবাদিকতার জারজচিত্র পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। পত্রিকার পাতায় এসব দেখে 'স্বাধীনতা' শব্দটির প্রতি খুব রাগ হয়েছিল কবি রফিক আজাদের! আর সেই অনলবর্ষী রাগ থেকেই জন্ম নিল বহু বিতর্কিত ওই কবিতা। ভাত দে হারামজাদা… সুপ্রিয় পাঠক, চলুন কবিতাটিতে একবার চোখ বুলিয়ে আসিঃ

ভীষন ক্ষুধার্ত আছিঃ উদরে, শারীরবৃত্ত ব্যেপে
অনুভূত হতে থাকে – প্রতিপলে – সর্বগ্রাসী ক্ষুধা
অনাবৃষ্টি যেমন চরিত্রের শস্যক্ষেত্রে জ্বেলে দেয়
প্রভূত দাহন – তেমনি ক্ষুধার জ্বালা, জ্বলে দেহ

দু'বেলা দু'মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনও দাবি
অনেক অনেক-কিছু চেয়ে নিয়েছে, সকলেই চায়ঃ
বাড়ি, গাড়ী, টাকাকড়ি- কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবিঃ পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর-
ভাত চাই-এই চাওয়া সরাসরি – ঠান্ডা বা গরম,
সরূ বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চাল হ'লে
কোনো ক্ষতি নেই মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাইঃ
দু'বেলা দু'মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি!

অযৌক্তিক লোভ নেই, এমনকি নেই যৌন ক্ষুধা-
চাইনি তো নাভিনিম্নে পড়া শাড়ি, শাড়ির মালিক;
যে চায় সে নিয়ে যাক – যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও –
জেনে রাখোঃ আমার ও সব এ কোনও প্রয়োজন নেই।
যদি না মেটাতে পারো আমার সামান্য এই দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কান্ড ঘটে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন-কানুন –
সমুখে যা পাবো খেয়ে নেবো অবলীলাক্রমে;
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধর, পেয়ে যাই –
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে।

সর্বপরিবেশগ্রাসী হ'লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিনতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ করে!

দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অবধি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবোঃ গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী-
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।

এই কবিতা লেখার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কবি রফিক আজাদের। কবি বলেন, "আমার তো বড় ভাগ্য! ভাগ্য ভালো না হলে আমি কবে মারা পড়তাম। 'ভাত দে হারামজাদা' লেখার পর অনেকেই আমার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করল। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানের গন্ধ তখনো আকাশে-বাতাসে। কিছু সুবিধাবাদী শয়তানের দল স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাকেও তাদের দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। পারে নাই। তো, আনোয়ার হোসেন ও আনোয়ারুল হক শহীদ—এই দুজনে মিলে আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন।

শেখ সাহেব আমার সব কথা শুনলেন। আমাকে যেতে বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। এরপর আমার সামনেই ফোন দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, ওরে পাঠাইলাম। ওর কথা শুনে এই গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দেবে। পরে মনসুর আলী সাহেবের কাছে গেলে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলে তখনকার ডিআইজি সাহেবকে টেলিফোন দিলেন। এরপর এসবির অফিসে নিয়ে আমাকে আটকে রাখল। এই কবিতা কেন লিখেছি? কী লিখেছি কবিতায়, তার ব্যাখ্যা চাওয়া হলো আমার কাছে। বলা হলো, মুখে বললে হবে না, কাগজে লিখে দিতে হবে। কাগজ-কলম দেওয়া হলো আমাকে। সঙ্গে দুই কাপ চা। এরপর আমি লিখলাম ৬১ পৃষ্ঠার মতো দীর্ঘ এক লেখা।"

কী লিখেছিলেন সেই ৬১ পৃষ্ঠার মতো দীর্ঘ লেখায়? কবি রফিক আজাদের ভাষ্যমতে, "সবকিছু মনে নেই। আসলে তখন সারা পৃথিবীতে খাদ্যাভাব ছিল। বাংলাদেশে যুদ্ধের পরে অভাব থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কোন দেশের মানুষ বেশি অভাবগ্রস্ত, কোন দেশের মানুষ মোটামুটি খেতে পারছে, কোন দেশে পারছে না। দুর্ভিক্ষ অঞ্চলে কেন মানুষ বসবাস করছে, আবার না খেতে পেয়ে মরছেও—এই সব। মনে আছে, ৬১ পৃষ্ঠা লিখতে লিখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমি আরও লিখেছিলাম, মানুষ যেন না খেয়ে মারা না যায় এ জন্য দেশ স্বাধীন করছি। এখন না খেয়ে ভাতের অভাবে একটা মানুষও মরতে পারবে না। লেখা শেষ হলে আমাকে বের করে দেওয়া হলো। আমি চলে এলাম।"

এই হারামজাদা কে বা কারা অথবা হারামজাদারা ভাত দিল কী দিল না, বাংলা সাহিত্যের রত্নভান্ডারে সে প্রসঙ্গের চেয়েও বড় ব্যাপার হলো- হলুদ ফটোসাংবাদিকতার প্রচ্ছন্ন-প্রভাবে সৃষ্ট এই কবিতা কবি রফিক আজাদকে দিয়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব, কবিকে দিয়েছে ভোগান্তি ও বিড়ম্বনা! দেশজুড়ে খ্যাতি! গুরু তোমাকে সালাম।