ক্রীতদাসের রক্ত

রাজু চাকলাদার
Published : 22 Nov 2016, 07:02 PM
Updated : 22 Nov 2016, 07:02 PM

রোহিঙ্গারা সময়ের স্রোতে ভেসে বেড়ানো নানানজাতির সংমিশ্রিত সুন্নি মুসলামান। এরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। বলে ক্রীতদাসের রক্তে রঞ্জিত সময়ের না-বলা গল্প। নবম শতকে আরব, মোগল, তুর্কি এবং পরে পুর্তগিজরা মায়ানমারে বসতি গড়ে। বার্মিজরা তখন এই ভিনদেশীদের মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। চৌদ্দ শতকে তাদের বংশধরেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মোগল আমলে আরাকান প্রদেশ ছিলো মোগল সাম্রাজ্যের অধীন স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। মুঘলদের পতন হলেও আরাকান তার স্বাধীনতা বজায় রাখে।

১৭৭৫ সালে মগরা আরাকানে আক্রমন করে। ত্রিশ হাজার মগ সেনা আরাকানের প্রায় তিন হাজার মসজিদের সবকটি ধ্বংস করে দেয়। দুই লাখ রোহিঙ্গাকে রেঙ্গুন শাসকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। নিহত হয় প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা। ৩০৭ টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামকে জনশূণ্য করে দেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা ১৮২৫ সালে ইংরেজদের বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) আক্রমণে অনুপ্রাণিত করে। রোহিঙ্গাদের ধারনা ছিল বার্মা ইংরেজদের অধীনে গেলে তারা ইয়াঙ্গুনের নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবে। ইংরেজরা ১৮২৫ সালে প্রায় বিনা বাঁধায় বার্মা দখল করে। বার্মিজ বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিরব শত্রুতা বাড়তেই থাকে। এর প্রকাশ পায় ১৯৪২ সালে। জাপান ওই সময় বার্মা দখল করলে বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের কচুকাটা করে।

বেসরকারি হিসেবে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল এই দুই বছরে তিন লাখ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৪ সালে ইংরেজরা আবার বার্মা দখল করে। রোহিঙ্গারা আবার স্বায়ত্বশাসন ফিরে পায়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পায় বার্মা। ওই সময় আরাকান পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে আবেদন করে কিন্তু জিন্নাহ তাতে রাজী না হলে আরাকান বার্মার হয়ে যায়।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পরই বার্মা রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে। শুরু হয় সরকারি মদদে রোহিঙ্গা নিধন। তবে ভয়াবহতা লাভ করে ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক শাসন জারির পর। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সকল সরকারি চাকরিতে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ লাভ নিষিদ্ধ হয়। ভূমিতে তাদের অধিকারকে অস্বীকার হয়। ১৯৭১ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তাদের বলা হয়- বার্মায় বসবাসকারী কিন্তু নাগরিক নয়।

১৯৭৪ সালে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালে সামরিকজান্তা যে নাগরিক আইন করে তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হওয়ার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আবার শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন। অবস্থা এতটাই অমানবিক ছিল যে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ও সমপরিমান রোহিঙ্গা থাইল্যান্ডে পালিয়ে যায়। ওই সময় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় বলে ধারনা করা হয়।

১৯৮৮ সালে রোহিঙ্গাদের ভ্রমনে বিধিনিষেধ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এতে করে রোহিঙ্গারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ হারায়। ভ্রমনে বিধিনিষেধ থাকায় বার্মা থেকে পালানোর উপায়ও ছিল না। এমনকি চরম অসুস্থ হলেও তারা হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ পায় না ভ্রমনে বিধিনিষেধ থাকায়। ১৯৯০ সালে আবার রাখাইন-রোহিঙ্গা দাঙ্গা শুরু হয়। এই সময়েও প্রচুর রোহিঙ্গা দেশ ছাড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে দুই লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় বার্মা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস বড়ই করুণ। যুগ যুগ ধরে নির্যাতনের স্টীমরোলারে পিষ্ঠ হচ্ছে রোহিঙ্গারা ।

আজও রোহিঙ্গাদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয় ভীত-বেদনায়। তবু বিশ্ববিবেক জাগ্রত হচ্ছে না কারণ রোহিঙ্গারা মুসলিম। বিশ্বের মাতবরগণ আবার সর্বক্ষেত্রে মুসলিমদেরকে ভয়পায় কারণ তারা জানে মুসলিমরা কাউকে পরোয় করে না। বিশ্ব-মাতবরগণ মুসলিমদের নিকট ক্ষমতা হারানোর প্রচ্ছন্ন ভয়ে আড়ষ্ট থাকে সবসময়! তাই, বিশ্ববিবেক রোহিঙ্গা মুসলিমদের আর্তনাদে প্রকম্পিত হয় না, জেগে উঠে না বরং ক্ষমতা হারানোর প্রচ্ছন্ন ভয়ে ভীত থাকে। শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সূচি'র সরকারী সমর্থণে বার্মায় গণহত্যা চলছে ক্রুসেডীয় কায়দায় আর OIC (Organization of Islamic Cooperation) নামক আন্তর্জাতিক বলদ সংঘটি বসেবসে আ্ঙ্গুল চুষছে পরম অক্ষমতায়!

বিশ্বশান্তি রক্ষার বুলি কপচানো জাতিসংঘ নামক দালাল প্রতিষ্ঠানটি তো মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রশাসণিক টুল্স এবং ন্যাটো (NATO) হল সেই সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার সামরিক টুল্স! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী জনমত যেখানে গঠিত হয় মুসলিমদের থ্রেটের উপর ভর করে, সেখানে জাতিসংঘ কিংবা ন্যাটোর মত দালাল সংগঠনের নীরব থাকটা স্বাভাবিক! "জীব হত্যা মহাপাপ" বুলি আওড়ানো, বিপথগামী কতিপয় বার্মিজ/রাখাইন বৌদ্ধদের পাছায় লাত্থি দিয়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে অন্তত মুসলিম বিশ্বের সোচ্চার হওয়া এখন মানবতার দাবী, সময়ের দাবী!