বিজয় দিবসঃ একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কথা

জাদু
Published : 15 Dec 2011, 02:28 PM
Updated : 15 Dec 2011, 02:28 PM

মুক্তিযুদ্ধ। সে এক বিশাল ইতিহাস। আমাদের প্রজন্ম সে যুদ্ধ দেখে নাই। শুধু শুনেছে। সে যুদ্ধের নির্মমতা বোঝে নাই, শুধু অনুভব করেছে। পাক বাহিনীর বর্বরতা সম্পর্কে জানে না, তাই হয়তো এখনো কেউ কেউ পাকদের খেলায় সাপোর্ট করে। আমি ও জানিনা শুধু শুনেছি। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গেরিলা যোদ্ধা। তার যে বিশাল সাহস ছিল তা জেনেছি তার মৃত্যুর পর। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কত্তৃক আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তার সাহসের গল্প শুনেছিলাম। অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, কেন এত সাহসী একজন মানুষ ছাপোষা সরকারী চাকুরী করতেন? তিনি কি দেশ গড়ার কারিগর হতে পারতেন না? তিনি কি পারতেন না দেশের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিতে? তারপর কারণ অনুসন্ধানে বের হলাম। বের হল চমকপ্রদ তথ্য। বাবা আওয়ামীলীগে ছিলেন। সেই দুঃশাসন সহ্য করতে পারেননি বলে তিনি জাসদ এ যোগদেন। বিজয়ের ২ বছরের সময় দেশে রাজাকারেরা পুনরায় প্রবেশ করতে আরম্ভ করে। তারা তীব্র প্রতিবাদ করেন। বিচার চান। কিন্তু অস্থির সেই সময়ে জাসদের নেতারা ছিল সবচেয়ে অসহায়। রাজাকারদের পুনর্বাসন হয়েছিল কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ গঠনে অংশ নিতে দেয়া হয়নি। বাবাদের সাথে একই কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেছেন এমন অনেকেই আছেন যারা আজ বিশাল সম্পত্তির মালিক। বাবা কখনই তাদের আপন করে নিতে পারেননি। কারণ যুদ্ধের পাশাপাশি তারা লুণ্ঠনে ও বাস্ত ছিলেন। এরকম অনেক যোদ্ধা আছেন যারা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেকেই আছেন যারা হয়েছেন নিগৃহীত। যারা সম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছিল তারাই পরবর্তীতে নেতৃত্ব দিয়েছে। আর একের পর এক মামালার আসামী করা হয়েছে আমার বাবাসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এইসব মামলা করেছে রাজাকারেরা। হা…হা…হা। শেষ পর্যন্ত আমার বাবার বুয়েট এ পড়া হয়নি। আমার দাদা সাহস পাননি তার দুরন্ত ছেলেকে ঢাকায় পাঠাতে। বাবার প্রতি যখন রাজাকারদের মৃত্যু পরওয়ানা জারি হল তখন তৎকালীন জাসদ নেতা গোপনে তাকে রাজশাহী পাঠিয়ে দেন পড়াশোনা শেষ করবার জন্য। জীবন বাঁচাতে এছাড়া তার কোন বিকল্প পথ ছিল না। তারা ৫ বন্ধু সবাই রাজশাহী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। ৪ বছর পর পড়া শেষে তিনি চাকরি পান এবং তাকে বদলি করে দেয়া হয় পটুয়াখালীতে। তিনি ও হারিয়ে ফেলেন তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এই লিখাটি লেখার উদ্দেশ্য হল, তখন তো বর্তমান সরকার ক্ষমতায় ছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন না করে রাজাকারদের করেছে। আজ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত মাতামাতি, এত কিছু, রাজাকারদের যদি বিচার হয় তবে তাদের প্রশ্রয় দাতাদের কি বিচার হবেনা? যারা এই দেশে রাজারদের পুনর্বাসিত করেছে, তাদের কি বিচার হউয়া উচিত না?

সাইদির, নিজামির গাড়িতে যেদিন বাংলাদেশের পতাকা উঠেছিল, সেদিন আমাদের বাসায় যে কি গজব গেছে আমরা জানি। খাঁচায় বন্দি এক বাঘ, অসহায় ভাবে শুধু গর্জন করে গেছে। সেদিন বাবার চোখে আমি পানি দেখেছিলাম। গর্জন থামার পরে পরাজয়ের গ্লানি। শুধু একবার বলেছিল" যদি একটা রিভলবার পেতাম।" তখন আমি ছোট। এইসব বুঝিনা। আজ বুঝি কি নির্মম কষ্ট থেকে বাবা এই কথাগুলো বলেছিলেন। যারা সাইদি- নিজামি- মুজাহিদ দের এত ক্ষমতা দিয়েছে, রাজাকারদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা দিয়েছে; তাদের কি বিচার হবে না?

আমি এই প্রজন্মের এক যুবক। আমার যুদ্ধ কিংবা রাজাকারদের বিচার কোন কিছু নিয়েই আগ্রহ নেই। কারণ জানি এইসব লোক দেখানো মাত্র। ভোট পাওয়ার একটা উছিলা মাত্র। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রথম মেয়াদের ৫ বছরে তার পিতার হত্যার বিচার করতে পারেন নাই। এই ৫ বছরেও যুদ্ধাপরাধিদের বিচার সম্পূর্ণ শেষ হবেনা। বিচারের বাণী শুধু নিভৃতে কেঁদে যাবে। আর যাদের স্বজন হারিয়েছে তারা পুনরায় যে স্বপ্ন দেখেছিলো তা ধ্বংস হবে। সরকার বদল হলে এরা আবার বাইরে আসবে, আমাদের দেশের এক ধরণের মানুষ তাদের ছালাম দেবে, তাদের পিছনে স্লোগান দিবে, তাদের গাড়িতে আবার এই দেশের পতাকা তুলে দেবে। তারা আবার বিপুল বিক্রমে বলবে, এই দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নাই। আর আতংকে থাকবে সেইসব পরিবার যারা সাক্ষি হিসাবে এখন আছে। আর আমরা শুধু বলব ইস!

এই দেশ কি বদলাবে? হয়তো। একদিন এইদেশে কোন মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকবে না, থাকবে না কোন রাজাকার। তখন হয়তো আমরা নতুন কোন ইস্যু নিয়ে মাতবো। কিন্তু দেশ গঠনে আমাদের যে ভুমিকা, সে ভুমিকা হয়তো তিমিরেই রয়ে যাবে! আমরা কি একবার চেষ্টা করতে পারিনা, নিজের অবস্থান থেকে দেশকে কিছু দিতে। সবাই একটু একটু করে দিলেই হবে। দরকার শুধু একটু সদিচ্ছা। আমরা কি পারিনা সেটুকু নিজেদের মাঝে লালন করতে?

বাবা গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন বলে কোনদিন তার পায়ের আওয়াজ শুনি নাই। তার হাঁটায় কোন শব্দ হত না। তিনি দরজায় নক করা না পর্যন্ত বোঝা যেতনা তিনি এসেছেন। আমার এখনো মনে হয়, বাবা নিঃশব্দে আমার পাশেই আছেন। আমার সব কাজের প্রেরণা যোগাচ্ছেন। বাবা বিজয়ের এইদিনে তোমার প্রতি রইলো অনেক অনেক ভালবাসা। যেখানেই থাকো দোয়া কর, যেন দেশকে একটু ভালবাসতে পারি।