কেউ গ্রামে ফিরে যায়, কেউবা গ্রামে ফিরতে চায়!

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 23 Jan 2012, 01:20 PM
Updated : 1 July 2020, 02:20 PM

কথাটা শুনে বুকের মধ্যে কেমন টনটন করে উঠলো। কয়েকদিন ধরে খুব অস্থির লাগছিল। সাইকেলটা নিয়ে বের হয়েছিলাম। ভাগ্নেটাকে দেখে যখন ফিরছিলাম তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে একটা দুর্বল কণ্ঠ বলে উঠলো, "উজ্জল ভাই আরতো চলতে পারিনা। খাওন দাওন করাটাই অসম্ভব হইয়া গেছে গা। দেহেন ভাই কিছু একটা করন যায় কিনা।"

কথাগুলো চাঁদ উদ্যানের বস্তিবাসী ঝুমুর বেগমের (৩৫)।  সাইকেলে আসতে আসতে ঝুমুর আপার কথা শুনছিলাম। সে একে একে বলেই চললো- "জামাইটার দারোয়ানের চাকরি চলে গেছে, বাসার বান্ধা বেবাক কাম থেইকা ছাড়ায়ে দিছে বেতন না দিয়াই, জমানো টাকা শেষ, বাবাটা এই করোনায় সময় মইরা গেল, একটা বাচ্চা অসুস্থ…।"

আরও অনেক অনেক কথা। আমারও দম বের হয়ে আসে সাইকেল চালাতে চালাতে। শেষে থেমে কথা বলি, ঝুমুর আপা সংসার তাইলে চলে কেমনে?

"আরে ভাই জমানো যে টাকা আর খাওন আছিলো তার প্রায় সবই শেষ। কোন আয় রোজগার নাই ভাই, কেমনে চলি? এখনতো কেউ ধারও দেয় না।"

"কেন সরকারি কোন ত্রাণ পান নাই?"

"আরে ভাই ত্রাণ! আপনারা কয়টা চাল ডাল দিছিলেন আর এরপর বা আগে কেউ কিছু দেয় নাই। কমিশনার অফিসে গেছিলাম। বলে নাম দিয়া যাও কিন্তু কোন রকম কোন ব্যবস্থা করে নাই।"

কথা হলো পোড়া বস্তির হান্নান ভাইয়ের সাথে। পোড়াবস্তিতে প্রায় ২৮৫০টি পরিবার প্রায় ১৭/১৮ হাজার মানুষ বসবাস করে। এই মানুষদের অধিকাংশ দিন মজুর, গার্মেন্টস কর্মী আর গৃহকর্মী। করোনাভাইরাসের সময়ে তাদের অধিকাংশের কাজ চলে গেছে। তার হিসেব মতে প্রায় ১০ ভাগের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে গ্রামে চলে গেছেন আর প্রতিদিনই কম বেশি মানুষ যাচ্ছেন। আর তারা কেউ ইচ্ছা করে যাচ্ছেন না, যাচ্ছেন ঢাকা শহরে তারা আর টিকে থাকতে পারছেন না বলে। তাই গ্রামে যাওয়াটা এ সময়ে ঢাকা শহরের নিম্ন আয়ের এই অসহায় মানুষদের জন্য বাধ্য হয়ে যাওয়া, একদমই না পেরে উঠে চলে যাওয়া।

দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন ফিরোজা আহমে (৬৯) (ছদ্মনাম)। ছেলে-মেয়েরা সকলেই বিদেশে থাকেন। মোহাম্মদপুরের একটি অভিজাত এলাকায় তিনি একাই বসবাস করেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর তার আর কিছু ভাল লাগেনা। তিনি প্রায়ই ফোন করে হাহুতাশ করে বলেন, গ্রামে চলে যেতে চান। এই শহুরে জীবন আর তার ভালো লাগে না। গ্রামের প্রাণ, প্রকৃতির মাঝে অন্তত বেঁচে থাকার উপাত্ত রয়েছে, আত্মীয় পরিজনরাও মরার সময় ফেলে যাবে না। যে কঠিন বাস্তবতা আজ এই শহর তাকে শেখাচ্ছে।

সোনিয়া আক্তার (৩৮) এক সময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। এখন এক সন্তানকে নিয়ে স্বামী সংসার। স্বামী একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস তাদের জীবনে যেন অভিশাপ হয়ে এসেছে। ছোট সন্তানটি যেন কেমন হয়ে গেছে। বারবার সে বাইরে যেতে চায়। এই শহুরে বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি চায় সোনিয়া। সে ভাবছে গ্রামে তার সামান্য জমিতে একটা ছোট্ট বাড়ি করবে আর একটা স্কুলে শিক্ষকতা জুটিয়ে নিবে। নিশ্চয়ই তাদের ভালই চলে যাবে। তাই তারা গ্রামে ফিরে যেতে চায়। সে বিশ্বাস করে গ্রাম তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে, শহর না।

কফিল উদ্দিন (৩৫) পেশায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে তিনি প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছেন গ্রামেই ফিরে যাবেন। কারণ তার প্রিয় বিষয় হলো প্রাকৃতিক কৃষি নির্ভর একটা জীবন আর একটি দারুণ ফার্ম হাউজ করা। যে কৃষি ও ফার্ম হাউজ করে তার নূনতম বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা খুব ভালো করেই হয়ে যাবে। আর গ্রামে মা বাবা আছে তাদের পাশেও থাকাটা হবে। গ্রামে তিনি একটা লাইব্রেবি ও স্কুলের পরিকল্পনাও পাক্কা করেছেন এবং এমনকি এরমধ্যে বাড়ির ঘরও ঠিক করে ফেলেছেন। তিনিও ভাবেন- গ্রাম আসলে সকল কিছুকেই ধারণ করতে পারে আর গ্রামের জন্যও তার অনেক কিছু করার আছে।

রিকসাওয়ালা কাউসার (৪০) বাড়ি কুষ্টিয়া। করোনাকালে ঢাকা শহরে পুরো সময় থাকলেন। গত ঈদে বাড়িও যাননি। কিন্তু আয় রোজগারের যে অবস্থা তাতে সে আর ঢাকা শহরে থাকার কোন আশা দেখছে না। তার বাড়ির মানুষজনও অস্থির হয়ে গেছে। খুব কষ্টে সে গত ঈদে কিছু টাকা বাড়িতে পাঠাতে পেরেছিল। কিন্তু এখন যে অবস্থা তাতে খুব টাকা পয়সা জমানো যাচ্ছে না। তিনিও বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু এ যাত্রাটা ব্যতিক্রম কারণ তিনি একেবারেই চলে যেতে চাচ্ছেন।

আশরাফ হোসেন (৩৮) একটা গার্মেন্ট এ কাজ করতেন। ভাইরাস সংক্রমণের আগে তার চাকরি চলে যায়। থাকেন আদাবর ১৫ একটি টিনশেড বাড়িতে। তিনিসহ ৬টি পরিবারের ২০ জন মানুষ এই বাড়িতে বাস করেন। গত কয়েকদিন আগে তিনি ফোন করে বললেন- যে তার একটা কাজ খুবই জরুরি। আর না হলে এই ২০ জন মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা কোনওভাবে করা যায় কিনা! অন্তত একবেলা হলেও। কারণ এই পরিবারের কারও এখন কোন আয়ের সংস্থান নাই। এভাবে আর তারা ঢাকা শহরে থাকতে পারবেন না। তাদের বাধ্য হয়েই চলে যেতে হবে।

রিয়াজ হোসেন (১৯) সোনা মিয়ার টেক বস্তিতে বসবাস করে। সে জানালো বস্তি থেকে অনেক মানুষ চলে যাচ্ছে। কিন্তু তারা সবাই কোথায় যাচ্ছে কেউ বলতে পারেনা। তবে ধারণা করা যায় তারা গ্রামে চলে যাচ্ছে। 

মো. সেলিম (৬২) থাকেন ঢাকা উদ্যানে। পেশায় দিনমজুর। ভাইরাস সংক্রমণের আগে ছেলেকে একটা দোকান করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ২ লাখ টাকা লস দিয়ে দোকান বন্ধ। পরিবার নিয়ে তার চলাটাই কঠিন। বাচ্চাদের সাইকেল ভাড়া দিয়ে কোনভাবে সংসার চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু অভাবে করোনারকালে ৫/৬ টা সাইকেল বিক্রি করতে হয়েছে। তার গ্রামে কিছুই নাই। থাকলে তিনিও গ্রামে ফিরে যেতেন।

এই কথাগুলো কেমন গল্পের মতন লাগলো, তাই না? কিন্তু না।

এই কথাগুলো আমার কয়েকদিনের দেখা, শোনা আর অভিজ্ঞতার সামান্য দলিল। ঢাকা শহরের প্রায় ৪০ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষ আর এই করোনাকালে আরও কত লাখ মানুষ এ কাতারে নেমে এসেছে তা হিসাব করতে হবে আমাদের।

মধ্যবিত্ত অভিজাত এলাকা থেকে বাসা পাল্টে চলে যাচ্ছে কম ভাড়ার বাসায়। কম ভাড়াও যারা দিতে পারছেন না তারা উঠে যাচ্ছে ছোট বাসায়। আর ছোট বাসা গুটিয়েও প্রতিদিন শত শত মানুষ শহর ছাড়ছে। গ্রামের পথে পাড়ি দিচ্ছে এ শহরে টিকতে না পাড়া মানুষগুলো। তবে এই মানুষদের বেশির ভাগ নিম্নআয়ের ও দরিদ্র মানুষ। এই শহর এই মানুষদের ৩ মাস টিকে থাকার ব্যবস্থাটাও করতে পারেনি। এককথায় কাজ নেই, আয় নেই, খাদ্য সংকট, রোগ বালাই, এতো সমস্যা নিয়ে টিকে থাকাটা কি সহজ?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লেলিন চৌধুরীর মতে, করোনাভাইরাস যদি গরিবের রোগ হতো হবে বহু আগেই রাষ্ট্র এটিকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা শুরু করতো। কিন্তু এটি সত্যি এখন পর্যন্ত এটি বস্তি এলাকায় খুব সংক্রমিত হচ্ছে এমন তথ্য প্রমাণও নেই আমাদের কাছে। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষদের রেশনিং এর ব্যবস্থা না করে লকডাউন করাটা তাদের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্রের এই শোষণ নীতির কারণেই আজ এই জনগোষ্ঠির মানুষরা আরও প্রান্তিকতার দিকে যাত্রা শুরু করেছে। অথচ এই জনগোষ্ঠি না থাকলে এ নগর ও দেশ গড়ে তোলাটা একদমই অসম্ভব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)  আয় ব্যয়ের জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী দারিদ্রের হার ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে শেষে অনুমিত হিসেবে তা নেমে এসে দাঁড়ায় সাড়ে ২০ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিডিপি) গত ৭ জুন ২০২০ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়- করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দারিদ্রের হার ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমেছে, বেড়েছে চরম দারিদ্রের হার।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর আগে যাদের গড় মাসিক আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা, মার্চ মাসের শেষে তা নেমে আসে ৩ হাজার ৭৪২ টাকায়। অর্থাৎ গড় আয় ৭৫ ভাগ কমে গেছে। আয়ের ভিত্তিতে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৯ ভাগই চরম বা হতদরিদ্র স্তরে নেমে গেছে। এ কারণে আগের তুলনায় চরম দারিদ্রের সংখ্যা ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে ৭২ শতাংশের কাজ কমে গেছে। করোনাকালীন তাদের গবেষণায় দেখা যায় ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে কোনও খাবার ছিল না। ২৯ ভাগ মানুষের ঘরে খাবার ছিল এক থেকে তিন দিনের। সরকারের জরুরি ত্রাণ পেয়েছে মাত্র চার শতাংশ মানুষ।

এগুলো হলো পরিসংখ্যান যা জীবনের উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু একজন ঝুমুর বেগমের আর্তনাদ আর গ্রামে ফিরে যাওয়ার কষ্টের হিসাব কোথায় লেখা থাকবে? আবার একজন ফিরোজা আহমেদের গ্রামে ফেরার আকুলতা কিভাবে মিটবে? সবকিছুর জন্যই দায়ী এই রাষ্ট্র ও ক্ষমতা ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ ভোগের যে ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করেছে তারই করুণ পরিণতিই আজ আমাদের দেখতে হচ্ছে। মানুষের জন্য যে ব্যবস্থা নয় তা কখনোই মানুষকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে না। এই করোনাকাল আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কৃষি, কৃষক ও ফসলের গুরুত্ব কতটা। কোন ব্যবস্থা মানুষকে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। আর কোন ব্যবস্থা সবচেয়ে নিকৃষ্ট। কিউবা, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কেরালা একেকটা স্বপ্নের নাম নিশ্চয়ই!