মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট সমুদ্রসীমার অর্থ সুদিনের সূচনা

নাদিরা মজুমদার
Published : 11 Feb 2011, 05:15 PM
Updated : 4 April 2012, 03:45 PM

বঙ্গোপসাগরের শরিক তিনটি দেশ-বাংলাদেশ, বার্মা বা মিয়ানমার ও ভারত। ২০১২ সালের ১৪ই মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানার বিষয়টির পাকাপাকি ফয়সালা করে দেয় আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন বিষয়ক আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দি ল' অব দি সী-সংক্ষেপে ইটলস)। ফলে, এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরের উপরে আইনগত হিস্যার দ্বিপাক্ষিক সমাধান হয়েছে; সামুদ্রিক সীমানার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে ভারতের সঙ্গে ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পরে।
সামুদ্রিক সীমানা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার শুরু সেই ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মাঝেমধ্যে বৈঠক হয়েছে। তারপরে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় দীর্ঘ ছেদ পড়ে। প্রায় দুই দশক বাদে, ২০০৭ সালের শেষের দিকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আবার পুনর্জীবিত করা হয়। ২০০৮ সালে এসে বাংলাদেশ সামুদ্রিক সীমা নির্ধারণের প্রশ্নে ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠতে থাকে। হয় এসপার নয় ওসপার; তবে তা অর্জন করতে দেখাতে হবে অপরিমেয় কৌশলগত ও কূটনৈতিক দক্ষতা ও নিপুনতার।

ইত্যবসরে, এই মিলেনিয়ামের শুরুতে ভারত ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের গভীরে 'অফশোর ড্রিলিং' করে যথাক্রমে ধিরুভাই ও শোয়ে নামক দুটো গ্যাসফিল্ডের সন্ধান পায়; এবং অচিরে দেশ দুটো বাণিজ্যিকভিত্তিতে গ্যাসের সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণও শুরু করে দেয়। ভারতের ধিরুভাই ফিল্ড ও মিয়ানমারের শোয়ে ফিল্ড সমুদ্র সীমানার কলহ এলাকার বেশ কাছাকাছিই অবস্থিত বলে মনে করা হতে থাকে। তদুপরি, বঙ্গোপসাগরের বিখ্যাত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ অঞ্চলটি ধনুকের মতো ভেতরের দিকে বেঁকে সৃস্টি করেছে অবতলতার এবং ভারত ও মিয়ানমার নিজ নিজ দাবি মতো সমুদ্র সীমা এমনভাবে ভাগভাটোয়ারা করে নেয় যে উপকূল থেকে বাংলাদেশের সমুদ্র দৌড় দক্ষিণে ১৭০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত, সেও আবার আকারে ত্রিভুজের মতো। এভাবে  "এলাকাবেষ্টিত" হয়ে পড়াতে, এবং তদুপরি শক্তি ঘাটতিতে ক্ষুধার্ত বাংলাদেশের জন্য সামুদ্রিক সীমানার স্থায়ী সমাধান অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে। অর্থাৎ কলহের গ্রহণযোগ্য মিটমাট না হওয়া পর্যন্ত সমুদ্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা গ্যাস ও তেলের এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদের শান্তিপূর্ণ অনুসন্ধান কার্য চালানো মোটেই সম্ভব নয়।

সমুদ্রবিষয়ক বিধি অনুযায়ী, সমুদ্রে যখন কোন দেশের "একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকা" (এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন-ইইজেড) থাকে, তখন এই এলাকার পরিসীমার মধ্যে সবধরণের অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা, সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহারসহ জল ও বায়ু ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদনের অনন্য এক অধিকার দেশটি অর্জন করে। "একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকার বিস্তার দেশটির সমুদ্রমুখি রাষ্ট্রীয় জলসীমা (টেরিটোরিয়াল সী বা ওয়াটার) থেকে সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০.৪ কিলোমিটার) পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে। একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকাকে দেশটির সংলগ্ন বা নিকটস্থ এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। কখনোবা "একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকা" নামক পরিভাষাটির চিন্তা ও রীতিবিবর্জিত ব্যবহার হয়ে থাকে, এবং ফলে রাষ্ট্রীয় জলসীমা ও মহাদেশীয় অববাহিকা বা শেল্ফকেও একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাতিসংঘের সনদে, রাষ্ট্রীয় জলসীমার বিস্তার ১২ নটিক্যাল মাইল (২২ কিলোমিটার) মেনে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় জলসীমা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের অংশ, যার অর্থ জলসীমার ওপরের আকাশসীমা ও সমুদ্রের গভীর তলদেশ পর্যন্ত এই সার্বভৌমত্বের অধিকার বিস্তৃত। তবে অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশি সামরিক ও অসামরিক যানবাহনের চলাচল সম্ভব। রাষ্ট্রীয় জলসীমা ও একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকা ছাড়াও দেশটির উপকূলীয় উপান্ত রেখা বা বেইজ লাইন থেকে সমুদ্রের তলদেশে অন্তত আরো ৩৫০ নটিক্যাল মাইল (৬৪৮ কিলোমিটার) পর্যন্ত এলাকা, যাকে বর্ধিত মহাদেশীয় অববাহিকা বলা হচ্ছে, দেশটির আওতাধীন হতে পারে। এই বর্ধিত মহাদেশীয় অববাহিকা যদিও একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকার অংশ নয়, তবে রাষ্ট্রীয় জলসীমা ও একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকার মতো মহাদেশীয় অববাহিকাও দেশটির আইনগত অধিকারের অন্তর্গত হলেও হতে পারে।

আয়তনের দিক দিয়ে তুষারযুগে পৃথিবীর মহাদেশগুলোর সাইজ যা ছিল, তুষারযুগের অবসানের ফলে বরফগলা জলে মহাদেশের অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল অগভীর সাগরজলে ও উপসাগরীয়জলে তলিয়ে জন্ম দেয় মহাদেশীয় অববাহিকার। যেকোন অন্ত-তুষার যুগেই মহাদেশীয় অববাহিকার অস্তিত্ব দেখা যায়। পৃথিবীর সর্বশেষ তুষারযুগটি ছিল ভূ-তত্ত্বীয় হিসেব মতে, ১১০০০০ ও ১০০০০ বছর আগে। সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণে নটিক্যাল মাইল, উপান্ত রেখা, মহাদেশীয় অববাহিকা ইত্যাদি যেসব পরিভাষা ব্যবহার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সমুদ্রবিধিতে এসবের সংগা নির্ধারিত করা হয়েছে। যেমন, এক নটিক্যাল মাইলের পরিমান ঠিক ঠিক ১.৮৫২ মিটার; বা মহাদেশীয় অববাহিকার আইনগত সংগা ভূ-তাত্ত্বিক অর্থবহতার সঙ্গে ঠিকঠিক সরাসরি মেলে না ইত্যাদি।

মহাসাগরীয় তলদেশে নানাধরণের খনিজ ও অখনিজ আকরিকের এবং অশোধিত তেল ও গ্যাসের সঞ্চয় লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনার জন্যই সামুদ্রিক সীমানার নির্ধারণ প্রশ্নে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কলহের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকার সঠিক ব্যাপ্তি নিয়ে। কারণ, মহাদেশীয় অববাহিকা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে মোটামুটি অভিগম্য হলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে উপরোক্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান ও আহরণের মাধ্যমে যেকোন দেশ ক্রমশ তার ভাগ্য বদলে দিতে পারে; দাতাদেশের ওপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেয়া ও এমনকি শেষপর্যন্ত একেবারে অনির্ভরশীল হওয়াও সম্ভব। তাই শক্তিনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, কৌশলগত সুবিধা অর্জনে এর গুরুত্ব সীমাহীন। বঙ্গোপসাগরের তলদেশের শরিক তিনটি দেশ হওয়ার দরুণ সৃষ্টি হয় প্রাবরণীয় বা অধিক্রমণীয় দাবির (ওভারল্যাপিং ক্লেইম)।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ২০০৮ সালে বেশ তীব্র হয়ে ওঠে; ফলে, অবস্থা যথেষ্ট নাটকীয়তায় মোড় নেয়। যেমন, মিয়ানমার একদিকে বাংলাদেশকে "একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকা"র ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত আর কোন অনুসন্ধান কার্য় না চালানোর  আশ্বাস দিলেও, দক্ষিণ কোরিয়ার ডেইয়ু কোম্পানিকে সেন্ট মার্টিন'স দ্বীপের ৫০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে জরিপ কাজ করতে পাঠায়, সঙ্গে পাহারার জন্য দিয়ে দেয় নৌবাহিনীর দুটো জাহাজকে। ঘটনাটি ঘটে ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে। কূটনৈতিক প্রতিবাদ তো বটেই সেইসঙ্গে বাংলাদেশও নৌবাহিনীর তিন জাহাজ- আবু বকর, মধুমতি ও নির্ভয়কে পাঠিয়ে দেয় দেশের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুন্ন রাখতে। সীমান্ত কলহ বিদ্যমান বলে মিয়ানমারকে অবশ্যই কোন কৌশলে ডেইয়ু 'কে রাজি করাতে হয়েছিল। কিন্তু বাহাদুরিতে বাংলাদেশও কম যায় না; কনোকোফিলিপসের মতো আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে পাঠিয়ে দেয় তার "একচেটিয়া অর্থনৈতিক এলাকা"য় অনুসন্ধানকার্যে। কলহের এই স্তরেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত থাকে, তবে ছিল ফলবিহীন। কলহ জিইয়ে রেখে কারোই কোন লাভ তো দূরের কথা, বরং ক্ষতিই হচ্ছিল। ফলস্বরূপ, ২০০৯ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের কাছে ফয়সালার ভার দেয়া হয়। ২০১২ সালের ১৪ই মার্চ তার রায় হয়। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত কলহের অবসান ঘটে।
একুশটি দেশের ২১ জন জজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালত গঠিত। সালিশী তালিকায় "বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সমুদ্রোপকূলের সীমানা চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত কলহ" (ডিসপুট কনসার্নিং ডিলিমিটেশন অব দি ম্যারিটাইম বাউন্ডারি বিটুইন বাংলাদেশ এন্ড মিয়ানমার) নামক মামলাটি ষোলো নম্বরে ছিল বটে কিন্তু সালিশ আদালতের ইতিহাসে ছিল প্রথম এবং সর্বপ্রথম সমুদ্রোপকূলের সীমানা চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত মামলা। বিধি মতে সালিশ আদালতে বিচার প্রার্থী দেশের জজ না থাকলে নিজস্ব জজ নির্বাচনের অধিকার সেই দেশের থাকে। এই অধিকার বলে বাংলাদেশ বর্তমান জজদের মধ্য থেকে বেছে নেয় ঘানার জজ মেনসাহকে, মিয়ানমার নেয় যুক্তরাষ্ট্রের জজ অক্সম্যানকে। ২১ জন জজের মধ্যে চীনের জজ গাউ, সেনেগালের জজ মালিক ন্ডিয়ে এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো'র জজ লাকি বিপক্ষে মত দেন, বাকি ১৯ জন জজ পক্ষে রায় দেন। সম্পূর্ণ রায়ের অংশ হিসেবে সংযোযিত হয় তিন জজ- নেলসন, চন্দ্রশেখর রাও ও কটের যুগ্ম ঘোষণা, জজ ভোলফ্রামের ও জজ ট্রিভেসের প্রত্যেকের একক ঘোষণা, এডহক জজ মেনসাহ ও অক্সম্যানের যুগ্ম ঘোষণা, জজ ন্ডিয়ে, জজ কট ও জজ গাউয়ের প্রত্যেকের একক মত, এবং জজ লাকি'র ভিন্নমত।

দীর্ঘদিনের একটা সমস্যার ইতি টেনে দেয় এই ঐতিহাসিক রায়টি। সীমানা অঙ্কিত হওয়ার ফলে দুই দেশেরই আয়তন সুনির্দিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাতে লাভ হয়েছে দুই দেশেরই। চেক দেশে বলে, ভাল বন্ধুত্বের ভিত্তি হল ছিমছাম পারিপাট্যতা; সম্পর্ক স্বচ্ছ হলে বন্ধুত্ব করা ও বজায় রাখা সহজ হয়, সেই বন্ধুত্ব টেকেও ভাল। এবারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার নিশ্চিন্তমনে যার যার সীমানার আওতায় অফশোর অনুসন্ধান কার্য চালাতে পারবে। সমস্যার সমাধানে দুই দেশেরই সদিচ্ছা, কূটনৈতিক তৎপরতা, কৌশলগত বৈশিষ্ট্য অনুঘটকের কাজ করেছে, সন্দেহ নেই। ফলে, এক পর্যায়ে পরস্পর পরস্পরকে "দাঁত কিড়মিড়" করলেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তার কুপ্রভাব পড়েনি। বরং আগ্রহ ও অত্যাবশ্যকীয়তার প্রতিফলন হয়েছে; প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্কটির স্বচ্ছতা সুদৃঢ় হয়েছে। তদুপরি, এই পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের সঙ্গে রহিঙ্গী সমস্যাসহ, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন বসানো, দুই বৃহৎ প্রতিবেশি দেশের (চীন ও ভারত) সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার লিভারেজ সমেত আরো অনেক অনেক সুযোগসুবিধার পথও খুলে গেছে। এই মুহূর্তে অন্তত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমা সংক্রান্ত কোন বিবাদ আর নেই বাংলাদেশের। ফলে, সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ব্যাপ্তি বিষয়ে বাংলাদেশের বিরাট একটা মাথাব্যথার কিছুটা সুরাহা হল। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ক কলহের মীমাংসা হওয়ার পরে সমুদ্রসীমার ত্রি-পাক্ষিক ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র হবে।

মামলার প্রবাহ ও ফলাফল থেকে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে বড়ো বড়ো সমস্যার সমাধানে আওয়ামী লীগ পূর্বে একাধিকবার যে নিপুনতা দেখিয়েছে, এবারেও সেই নিপুণতার প্রতিফলন দেখলাম আমরা। আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতে এই মামলাটি দায়ের করা ও উত্তরকালের রায় থেকে স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ দেশের সার্বভৌমত্বসহ সম্পদ ও সম্পদের উৎসের নিরাপত্তাবিধানে বদ্ধপরিকর। এমনকি প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক দেশের শক্তিনিরাপত্তার স্বার্থে অন্তত ৫০ বছরের প্রয়োজনীয় গ্যাস মজুত অক্ষুন্ন রাখার প্রতিজ্ঞাও স্মরণযোগ্য। ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমা অঙ্কণের মামলার মিটমাট ২০১৪ সালের আগে হচ্ছে না। সচেতন যুক্তিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ও আর্থ-রাজনৈতিক গতিময় ট্রেন্ডের ভিত্তিতে বলা যায় যে ভারতের সঙ্গে সালিশী মামলায় বাংলাদেশকে যথোপযুক্ত লিডারশীপ দিতে আওয়ামী লীগই উপযুক্ত প্রতিনিধি হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য মামলার রায়টি যেমন বিরাট বিজয়, আবার আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের মাধ্যমে সমুদ্র সীমা নির্ধারণের অভূতপূর্ব আইনানুমোদিত বৈধ পূর্বদৃষ্টান্তও হয়ে রইল রায়টি।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-দুই দেশের সঙ্গেই চীনের সম্পর্ক ভাল। অন্যতম প্রধাণ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে চীনের পক্ষে মধ্যস্থতার ভূমিকা না গ্রহণে কিছু মৌলিক কারণ ছিল। মিয়ানমারের শোয়ে গ্যাস ফিল্ডের মূল ক্রেতা চীন; তদুপরি গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজনীয় ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার নির্মাণের দায়িত্বও তার। বোধগম্য কারণেই চীন তাই দুই দেশের কোন একটির সঙ্গে সম্পর্ক তেতো হোক, চায়নি। তদুপরি, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-দুই ভিন্ন নীতির, যথাক্রমে "ইকুইটি" নীতি ও "ইকুইডিস্ট্যান্স" নীতির ভিত্তিতে সীমান্ত অঙ্কনের দাবি করে। এই নীতিগত বিভিন্নতাও হয়তো চীনের জন্য আরেকটি মৌলিক সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। কারণ, দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরকে কেন্দ্র করে বহুজাতিভিত্তিক অমীমাংসিত সামুদ্রিক সীমান্ত কলহের কারণে পরোক্ষে কোন নীতির সমর্থনও হয়তো কাম্য ছিল না চীনের।

সামুদ্রিক সীমান্ত নির্ধারিত হওয়ার ফলে বাংলাদেশ তার শক্তি ও জ্বালানির ক্রণিক ক্ষুধার উপশমের এবং মিয়ানমার তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নিয়োজিত হতে পারছে। সৌভাগ্যক্রমে কলহের মিটমাট হওয়ার আগেই বাংলাদেশ কনোকফিলিপসের সঙ্গে প্রোডাকশন শেয়ারিং চুক্তি (পিএসসি) করতে পেরেছিল। বর্তমানে সীমান্ত নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার ফলে হয়তো অন্যান্য আন্তর্জাতিক তেল কোস্পানিও (আইওসি) অন্যান্য ব্লকের কাজ পেতে উৎসাহিত হবে। অফশোর অনুসন্ধান কার্যকে জুয়াখেলার সঙ্গে তুলনা করা চলে। কারণ, অনুসন্ধানকার্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল, অথচ গ্যাস বা তেল আদৌ পাওয়া যাবে কিনা তার কোন গ্যারান্টি নেই; এবং এই কার্যে প্রয়োজন ব্যয়বহুল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির। এই কারণে তাই গভীর সমুদ্রে সম্পদ অনুসন্ধাকারী কোম্পানির সংখ্যাও সীমিত। পিএসসি'র মাধ্যমে অনুসন্ধানকারী কোম্পানি অনুসন্ধানের সঙ্গে জড়িত সম্পূর্ণ ব্যয়ভারের ঝুঁকি নেয়; ফলে, তেলের বা গ্যাসের ভান্ডার শূন্য হলে ক্ষতি কোম্পানির, পাওয়া গেলে, পিএসসি' অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্পদের পরিচালনা করা হয়। ব্যয়বহুল আধুনিক লাগসই প্রযুক্তি ও বিপুল পুঁজি বিনিয়োগের দায় কোম্পানি নেয় বলে সেই ১৯৫০ সাল থেকে পিএসসি ব্যবস্থা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ব্যবহার হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিকভাবে নির্দিষ্ট ও স্বীকৃত নিয়মবিধি অনুযায়ী  পিএসসি তৈরি হয়ে থাকে। সেইসঙ্গে বাড়তি লাভ হিসেবে হয়তোবা "বহুশাখাভিত্তিক প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক বঙ্গোপসাগরীয় উদ্যোগ" (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেকটোরাল টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনোমিক্যাল কো-অপারেশন-বিমস্টেক) ও অন্যান্য অনুরূপ বহুমুখি আঞ্চলিক সংস্থার জন্যও বঙ্গোপসাগর এলাকায় সহযোগিতামূলক সাহায্যের পথ খুলে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে বড়ো সড়ো আকারের গ্যাসফিল্ড পাওয়া গেলে দেশের শক্তি সঙ্কটের লাঘবে যেমন সাহায্য করবে, সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি রাখবে। ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমার ফয়সালা হয়ে যাওয়ার পরে শক্তি পরিস্থিতির যে আরো উন্নতি হবে বলাই বাহুল্য।

নাদিরা মজুমদারঃ বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।