সাধারন মানুষের রাজনীতিতে নির্লিপ্ততা প্রেক্ষিত আমাদের অন্ধকার যাত্রা

মাসুদ খানমাসুদ খান
Published : 4 Oct 2012, 10:52 AM
Updated : 4 Oct 2012, 10:52 AM

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সাধারন মানুষ যদি রাজনীতি সচেতন না হয় তাহলে দেশ অচিরেই আফগান বা পাকিস্তানের রুপ ধারন করবে । সাধারণত যে দেশের জনসাধারন রাজনীতি সচেতন এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা রাখে সে দেশের সাধারণ জনতার উপর খুব সহজেই দমন নিপীড়ন চালাতে পারে না গণতন্ত্রের লেবাসে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক কোন দল বা তাদের উপর জুড়ে বসতে পারে না সামরিক শাসন । রাজনীতি নিয়ে আমাদের গভীর হতাশা বা না পাওয়ার ক্ষোভ থাকলেও এখনো সাধারন মানুষ মনে করে রাজনীতিতেই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের মুক্তি নিহিত আছে, তবে তা হতে পারে শুধু মাত্র ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে । এটা দেশে বর্তমানে যে ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু আছে তার মাধ্যমে সম্ভব নয় । কিন্তু সাধারন জনগনের সমর্থন নিয়েই ৯০ পরবর্তী থেকে বর্তমান পর্যন্ত বা তার আগেও বিভিন্ন ছদ্মাবরণে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে আর জনতার সামনে সব দলই ঘূর্ণায়মান মুলা ঝুলিয়ে গেছে । বস্তুত কোন দলই জনগনের মৌলিক অধিকার পুরন করেনি উপরন্তু দমন নিপীড়ন চালিয়ে গেছে । রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈতিক এবং জনবিরোধী কার্যকলাপের পরেও আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি যার ফলশ্রুতিতে দ্বিগুন বেগে অত্যাচার সইতে হচ্ছে । দেশে বিদ্যমান একটি দলেও গণতন্ত্রের লেশ মাত্র নেই, নেই জন কল্যাণমুখী কোন পদক্ষেপ । তারপরেও এরা সাধারন জনতার বাধ ভাঙ্গা সমর্থন পেয়ে বার বার মসনদে বসছে । এটা অনেকটা খাল কেটে কুমির নিয়ে আসার মত । কিন্তু এই যে সাধারন মানুষ ভোগান্তি পোহাচ্ছে এ নিয়ে তেমন একটা অংশের মাথা বেথা নেই এটার কারন হচ্ছে রাজনীতি বিমুখতা এবং রাজনীতি নিয়ে ভাবনার অসারতা তাছাড়াও রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে তাদের দাবি দাওয়া সম্পর্কে অন্ধকারে থাকা। পাশের দেশ ভারতের জনগন খানিকটা রাজনীতি সচেতন বলা যায় অন্তত গণতন্ত্রের আড়ালে আমাদের দেশের মত অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম কম চলে, যদিওবা বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশে এখনো ক্ষুধা, দারিদ্র এবং দুর্নীতি হয় তদুপরি ভারতে জনগণের পিঠে বোঝা চাপানো রয়ে সয়ে হয় এবং মসনদে থাকা দাদা বাবুরা ভেবে সিদ্ধান্ত নেন এবং যদি এটা জনগনের বিরুদ্ধে যায় তাহলে জনগণ প্রতিবাদ করে । এটার সর্বশেষ প্রমান গত কিছু দিন আগে তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে সরকার বাধ্য হয়ে তেলের দাম কমাতে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়াও দুর্নীতির অভিযোগ আসলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদত্যাগ করেন অথবা দল থেকে তাকে স্থায়ী বা আপদকালীন বহিষ্কার করা হয়ে থাকে । এ ধরনের কার্যকলাপ তখনি হয় যখন সাধারন জনগণ সরকার কি করছে আর কি করছে না এবং নির্বাচনী ওয়াদার পরিপ্রেক্ষিতে কতটুকু বাস্তব সম্মত পদক্ষেপ নিয়েছে তা অনেকটা মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষণ করে থাকলে । কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে তার কোন হিসাব বা পর্যবেক্ষণ রাখা হয় না ।

অ্যামেরিকাতেও আমাদের মত দুই দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু দুই দলের মাঝে সাপে নেউলে কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়াও দুই দলের বাইরে "টি পার্টি" নামক একটি জনসম্পৃক্ত ফোরাম আছে যারা দুই দলের বাইরে থেকে রাজনৈতিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে থাকে । আমেরিকার রাজনীতির উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে উভয় দলই তাদের পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধাচারণ করে না যদিওবা রিপাবলিকান পার্টি যুদ্ধপ্রিয় মনে হয় কিন্তু মোদ্দা কথা হল তাদের পররাষ্ট্রনীতির আসল এবং শেষ কথায় হল তাদের নিরাপত্তা এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদের দোসরদের নিরাপদ রাখা । কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রনীতিই বদলে যায় দুই দলের সময়েই, এক দল অতিরিক্ত ভারতপন্থী আর অন্য দল পাকিস্তানি ভাবধারা বা সৌদিপন্থী ভাবধারায় চলে । কিন্তু উভয় দলই আবার আমেরিকানপন্থী।

লিখছিলাম জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে –

রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জন । জাতির জনক শেখ মুজিব ছিলেন রাজনীতির মহান জাদুকর । তারই চৌকসতায় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, মুজিবের কথায় দেশের আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সবাই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল, তার মানে যেটা দাঁড়ায়- সাধারন মানুষের মুক্তির আকাংখার পরিপ্রেক্ষিতে সাড়া দেওয়া,সাথে যোগ হয়েছিল মুজিবের রাজনৈতিক কারিশমা, যার ফলাফল স্বাধীন বাংলাদেশ ।

কিন্তু স্বাধীনতার অর্জন যতটুকু হওয়ার কথা ততটুকু হয়নি যে আশা নিয়ে মানুষ মুক্তির মিছিলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তা পুরন হয়নি । এটার অন্যতম কারন রাজনীতি রাজনীতির মধ্যে না থাকা এবং সাধারন জনগণের রাজনীতি বিমুখ হওয়া। এটার ফলে রাজনৈতিক দল গুলু যেমন ইচ্ছে তেমন করেই গেছে এবং আজ অবধি যাচ্ছে । এর ফলে সমাজের কিছু মানুষ ফুলে ফেঁপে গিয়ে সম্পদের চড়াই উঠেছে আর সমাজের বড় একটি অংশ না খেয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে । আর আমরা যারা সাধারন জনগণ তারাও মুখ বুঝে সয়ে চলেছি এ বৈপরীত্য, যেটাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক দলগুলো দিনের পর দিন সহিংস হচ্ছে ।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশি কিছু ঘটনার দিকে নজর দিলেই বুঝা যাবে, জনগণের রাজনীতি সচেতন হওয়াটা কতটুকু জরুরি –

আরব বিশ্বে গন জাগরনের মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে কিন্তু সাধারন জনগণ । যদিওবা তাদের অধিকাংশ দেশের উপরে আমেরিকার ছাতা ছিল কিন্তু জনগণের এক ধাক্কায় সেটা খড় কুটার মত উপচে পড়েছে , আর শেষ মুহূর্তে আমেরিকা সমর্থন দিয়ে তাদের দায় সেরেছে । অবশ্য সামরিক শাসকদের সমর্থন দেওয়াটা তাদের অনেক পুরানো অভ্যাস । সেটা কিউবা, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা সহ লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের ইতিহাস দেখে প্রতীয়মান হয় । সেটা জনগণের না জাগা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল ।

আমাদের দেশে সামরিক শাসনের হানা বেশ কয়েক বছর ছিল এবং বার বার গণতন্ত্র প্রতিহত হয়েছে কিন্তু গণতন্ত্রের আড়ালে যারাই ক্ষমতায় ছিল প্রায় সবাই স্বৈর শাসকের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না । বার বার গণতন্ত্রের আড়ালে এখানে হয় পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে না হয় একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে আর তার চিড়ে চ্যাপ্টা হয়েছি আমরা সাধারন জনগণ । ক্ষেত্র বিশেষে জনগণ প্রতিবাদ না করে স্বৈর শাসকদের স্বাগত জানায় অবশ্য তার মাশুলও গুণতে হয় কড়াই গণ্ডায় । কিন্তু এ প্রতিবাদ যদি হত অপ রাজনীতির বিরুদ্ধে , যদি হত রাজনৈতিক দলগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ,যদি হত রাজনীতির নামে সাধারন জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে তাহলে দেশ এত দিনে সোনায় সোহাগা হত । কিন্তু জনগণ প্রতিবাদ করাতো দূরের কথা উল্টা মুখ বুঝে সয়ে নিয়েছে । আমরা হয়েছি বিশ্বের সবচেয়ে সহনশীল জাতি আর আমাদের দল গুলু হয়েছে বিশ্বের সবচাইতে বেশি অত্যাচার চালানো দল ।

সহনশীলতার মাত্রা এতই বেড়ে গিয়েছে যে রাষ্ট্র যখন লিমনের মত নিরপরাধ ছাত্রের বিরুদ্ধে লাগে অথবা বিদ্যুতের দাবিতে বা পানির দাবিতে আন্দোলন করা সাধারন জনতার উপর গুলি বর্ষণ করে , যখন সাংবাদিক দম্পত্তি হত্যাকাণ্ডের রিপোর্ট নিয়ে সরকারের উপরি মহল থেকে হস্তক্ষেপ করে তখনো এরা নিশ্চুপ দর্শকের ভুমিকা পালন করে । গত দু এক দিন আগে রামুতে বৌদ্ধ বসতি, এদের মন্দির, ঘরবাড়িতে তাণ্ডব চালিয়েছে কিছু কুলাঙ্গার কিন্তু সাধারন মানুষের কেও তেমন প্রতিবাদ করলো না ( বিক্ষিপ্ত দু'একটি ছাড়া ) । উপরন্তু পুলিশ কে খবর দেওয়ার পরেও তড়িৎ এ্যাকশান না নেওয়া এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে নতুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য নিতান্তই দায় সারা গোছের। সাধারন মানুষের কেও বলেনি যে প্রতি ঘরে ঘরে পুলিশ দিতে হবে , এহেন বক্তব্য দিয়ে দায় এড়ানোর কৌশল নিঃসন্দেহে বুমেরাং হত অন্যান্য দেশে কিন্তু যেহেতু এটা বাংলাদেশ সেহেতু রাজনীতিবিদের যেমন ইচ্ছে তেমন বলার স্বাধীনতা আছে । এই স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমরাই দায়ী ।

দু'একটা ব্যাতিক্রম দেখা যায় যদিওবা এসব প্রতিবাদ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল । আসল কথা হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকার গুলু যে রাষ্ট্রকে পুরন করতে হয় তা যেন ভুলে গেছে সাধারন মানুষ । না হলে এ কয়েক বছরে ৪-৫ বার তেলের দাম বাড়ানো হল, অজুহাত ছিল বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে কিন্তু দাম কমে গেলেও এখানে সেটা আর কমানো হয় নাই । তদ্রূপ বিদ্যুতের দাম নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য মাস দুয়েক বিদ্যুৎ সরবরাহ করেই দাম বাড়ানো হল , যেটার ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারন জনতা । এ নিয়ে ৭তম বারের মত দাম বৃদ্ধি করা হল ! এবং বিদ্যুতের দামের ক্ষেত্রে সরকার বৈষম্য সৃষ্টি করেছে । গ্রামের মানুষদের তুলনামুলক বেশি দামে বিদ্যুৎ ব্যাবহার করতে হচ্ছে শহরের চেয়ে । আর আমরা মুখ বুঝে সয়ে যাচ্ছি ।

আবার প্রতিবার নির্বাচনের সময় বেশ ঘটা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ইশতেহার দেই আমাদের সম্মুখে কিন্তু সে ইশতেহারের অগ্রগতি নিয়ে তেমন কারও ভাবনা নেই । ভোট দেওয়ার সময় আমরা রীতিমত উৎসব করি যদিওবা এটা পরিবর্তনের আশায় দেওয়া হয় না । আর আমাদের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আলোকে বলা যায় প্রতি ৫ বছর পর পর সরকার পরিবর্তন হবেই এটা সরকার কতটুকু ভালো কাজ করলো তার উপর নির্ভর করে না । অন্য একটা কারন বলা যায় – জনগণের একটা অংশ ভাবে যে বর্তমানে যে দল বা জোট ক্ষমতায় আছে তার চাইতে অন্য দল বা জোট অনেক ভালো ছিল । কিন্তু উভয় দল বা জোট কেও জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে চিন্তিত না যতটা না চিন্তিত মন্ত্রিত্ব নিয়ে, ভাগ নিয়ে , ক্ষমতার কেন্দ্র হওয়া নিয়ে ।

রাজনীতির এ অবস্থা থেকে উত্তরন করতে হলে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সংশোধন হতে হবে আর না হলে সাধারন জনগনের উচিত প্রতিবাদ করে এদের হয় ইতিবাচক ধারায় ফেরত আনা আর তা নাহলে এদের রাজনীতি থেকে অবাঞ্ছিত করে দেওয়া, এটা হতে পারে তাদের কে ভোটের সময় প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে । আর রাজনীতির বাইরে থেকে একটি শক্তিশালী ফোরাম করা যে ফোরাম রাজনীতির বাইরে থেকেই রাজনীতিতে প্রভাব রাখবে জনসম্পৃক্ত হয়েই । কিন্তু বর্তমানে যে সব ফোরাম কাজ করছে রাজনীতির শুদ্ধি অভিযানে তারা কোন না কোন ভাবেই যে কোন দলের তল্পিবাহক ( সব ফোরাম না ) । এটা বড় দুই দলের বি টিম হিসেবে কাজ করে থাকে এবং যে কোন কিছুতেই বড় দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এরা সোচ্চার ভুমিকা পালন করে থাকে । এদের দ্বারা সাধারন মানুষের অধিকার আদায় হবে না ।

এখনি দরকার অধিকার আদায়ের জন্য জনগণের সংগ্রাম করা । তা না হলে দেশে নাগরিকের অধিকার বলতে কিছুই থাকবে না । আর সাধারন জনগনের রাজনীতি সচেতনতা আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়া না এটা তার অধিকার আদায়ের খবর নেওয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক দেশের সাধারন জনগনের উপর চালানো দমন নিপীড়ন বন্ধে সোচ্চার হওয়া ।

" মুক্তি এখনো আসে নি, বিপ্লব অপেক্ষমাণ "