শৃঙ্খলিত বাঙ্গালি, মুক্তির পথ এবং একজন তারেক মাসুদ

মাসুদ খানমাসুদ খান
Published : 21 Oct 2012, 07:32 AM
Updated : 21 Oct 2012, 07:32 AM

শৃঙ্খলা বলতে আমরা কি বুঝি ? এটা কি মানবতা বিবর্জিত, পেশী শক্তির পূজারী স্বার্থান্ধ –অর্থলিপ্সু ও ক্ষমতা বিলাসীর রামরাজ্বত্বে ধর্মের বোরকা পড়া অধার্মিকদের আস্ফালন স্বত্তেও নিশ্চুপ থাকা । না কি শোষিত হতে হতে মুক্তির শ্লোগান ভুলে যাওয়া । আমরা বাঙ্গালিরা ঐতিহাসিক ভাবেই অনেক বেশিই সহনশীল । আড় ভাঙ্গতে একটু সময় লাগে আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় শুরু করা নিয়ে সন্দিহান থাকে অনেকে । যে কারনে ঘুম দেরিতেই ভাঙ্গে । ভাগ্যিস একাত্তরে এটা হয় নি ।

গত দুএকদিন আগে দেখেছি তারেক মাসুদের "রানওয়ে" । তারেক মাসুদ সম্পর্কে কিছু বলাটা আমার মত দুধে শিশুর পক্ষে সমীচীন হবে না, তবে মুক্তির গান, মাটির ময়না এবং রানওয়ে দেখে এটাই বুঝেছি আমাদের গুণে ধরা সমাজের আড় ভাঙতে তারেক মাসুদের বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল । কারন চলচিত্র একটা শক্তিশালী মাধ্যম । আর বর্তমান সময়ে এটাই প্রতিবাদের অন্যতম ভাষা । আর সেই ভাষাকে মুক্তির বাহন বানিয়েছেন তারেক মাসুদ । মাটির ময়না এবং রানওয়ে আমাদের কে সে মুক্তির কথায় জানান দিয়ে গেল এবং মুক্তির পথ সম্বন্ধেও । রুহুল এবং আরিফ । একজনের কাছে সমাজ এবং পরিবারের চাইতে মূল্যবান ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্যজন হন্য হয়ে ঘুরছে একটা চাকরির জন্য । বাবা প্রবাসে আছে কিন্তু কোন হদিস নেই মায়ের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম সাথে ছোট বোনের চাকরিতে রুহুলের ঘর সংসার চলে না । এ অবস্থায় মামার ক্যাফে রুহুলের পরিচয় হয় আরিফের । আরিফের সাথে ভালো সম্পর্কের তথা মিষ্টি কথার জের ধরে রুহুল পা বাড়াই তথাকথিত ছহি পথে । শুরু হয়ে যায় রুহুলের ভিন্ন পথে চলা । কিছু দিন যেতে না যেতেই বাসায় শুরু হয় বিধি নিষেধ , শুরু হয়ে যায় হারাম হালালের তথাকথিত ফতোয়া । এখানে তারেক মাসুদ অনন্য – রুহুলের হারাম হালালের জবাব যে ভাবে ফুটে উঠেছে মায়ের কণ্ঠে ঠিক যেন মানি না এসব ফতোয়া । আর শেষ টা হয়েছে তারেক মাসুদনীয় । রুহুলের ভুল বুঝতে পারা, আরিফের পরিনতি মনে করা , মায়ের পরম মমতায় ছেলেকে আদর করা খানিকটা মনে হল এটাই আসল মুক্তির স্বাদ । যে মুক্তি দরকার আমাদের সমাজে । দরকার এ নিখিল ভুবনে ।

লিখছিলাম শৃঙ্খলা নিয়ে । শৃঙ্খলা আসলে কি ? আর আমরাই বা কি বুঝি ? শৃঙ্খলা কতটুকু দরকার ? আর শৃঙ্খলা কি মুক্তির পথে বাঁধা ? শৃঙ্খলা কেমন হওয়া চাই ?

শৃঙ্খলা ! মানে মুখ বুঝে সয়ে যাওয়া । যায় করুক না কেন টু শব্দ না করা । আমরা বাঙ্গালিরা শৃঙ্খলা মানে বুঝি বহুকাল ধরে সামাজিক পরম্পরায় প্রথাসিদ্ধ এক অন্ধকার, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা না বলা কে । বুঝি পরশ্রীকাতরতা হিংসা-প্রতিহিংসা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং নৃপতিদের অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে চুপ থাকাকে । এসব মেনে নেওয়াকে যদি শৃঙ্খলা বলা হয় তাহলে শৃঙ্খল মুক্ত হওয়াটা বা হতে পারাটাই আসল । যে শৃঙ্খল আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় দুঃশাসন, যে শৃঙ্খলের ফলে বাড়তে থাকে অশ্নিলতা, ভুমিলুট, বালবিবাহ, ধর্মীয় আবাল আস্ফালন, যে শৃঙ্খলের ফলে সাধারন জনগণ ভুগছে চরম নিরাপত্তাহিনতায়, খর্ব হচ্ছে তার মৌলিক অধিকার তাহলে কেন দরকার এ শৃঙ্খলা ?

তাই এখন দরকার শৃঙ্খলা তথা সামাজিক আরগল মড়কে দিয়ে এক নতুন সমাজ পদ্ধতির প্রবর্তন করা । যেখানে মানবতায় হবে মূলমন্ত্র । যেখানে মানুষ পরিচয়েই পরিচিত হবো আমরা । ভেদাভেদ থাকবে না কারো প্রতি । হয়তোবা এমন এক বিশ্ব হবে যেখানে কাঁটাতার বলতে কিছুই থাকবে না , সারা বিশ্বই হবে স্বদেশ । এর জন্য আগে দরকার শৃঙ্খলা ভাঙ্গা । শুধু শৃঙ্খল ভাঙলেই হবে না সেটা বাস্তবায়নের জন্য ত্যাগী মনোভাবের লোক দরকার , যারা মুক্তির স্বাদ কেমন তা বলবে । কেন মানুষে মানুষে সম্প্রীতি দরকার তা জানাবে । এ জন্য প্রয়োজন সকলের এগিয়ে আসা, ভয় নয় সাহসকে আপন করা, নিজ স্বার্থ নয় পরের স্বার্থে নিজেকে নিবেদন করে, হিংসা নয় ভালোবেসে, ভোগে নয় ত্যাগে , মসজিদ-মন্দিরে অজোর নয়নে ক্রন্দনে নয় মানবতাকে বুকে ধারন করে ।

যদি বলি শৃঙ্খলা মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায় ! তাহলে কি ভুল হবে ?

হ্যাঁ, অবশ্যই শৃঙ্খলা মুক্তির পথে বাঁধা হিসেবে কাজ করছে যুগ থেকে যুগে । আমাদের কে শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা শিখানো হয়েছে, মাথা ঠুকে মরলেও , নিজ অধিকার ভূলুণ্ঠিত হতে দেখলেও , কিন্তু বলা হয় নি কখন শৃঙ্খলার আওতা আর থাকে না , বলা হয় নি প্রয়োজন কোন আইন মানে না । শুধু মাত্র জ্বি হুজুর বলতে বলেছে তখনও যখন দেখি হুজুররা আমাদের কে চুষে মারে । আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে জ্বি হুজুর বলার অভ্যাস । আমরা না বলতে পারি না অন্যায়ের বিরুদ্ধে , ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে না বলতে পারি না ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে, না বলতে পারি না শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে । এই না বলতে না পারাটা আমাদের কে খুড়ে খুড়ে জ্বালিয়ে মারছে, মুক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে কিন্তু আমরা তেমন কিছুই বলছি না কারন আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ !

শৃঙ্খলা কেমন হওয়া চাই ? কোন ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মুক্তির পথে অন্তরায় ?

একজন শিক্ষক তার সন্তানতুল্য ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাচ্ছে আমাদের শৃঙ্খলিত সমাজ এবং সাধারন জনতা কিন্তু লম্পট শিক্ষকের পক্ষে। রাজনৈতিক দলগুলু দেশকে লুটেপুঁটে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে, আমাদের শৃঙ্খলিত জনগণ তাদেরকেই ভোট দিয়েই ক্ষমতায় আনছে । সর্বক্ষেত্রে জনগন কিন্তু শৃঙ্খলিত , সে শৃঙ্খলিত যখন সে ঘুষ দেয় বা নেয় , যখন সে কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, যখন সে পরিস্থিতির দোহায় দিয়ে কোন অনৈতিক কাজকে মেনে নিতে বাধ্য করে । এ কেমন শৃঙ্খলা ! যে শৃঙ্খলা আমাদের কে বঞ্চিত করছে ? যে শৃঙ্খলার ফলে আমাদের আর পশুদের মাঝে কোন তফাৎ থাকছে না , যে শৃঙ্খলা আমাদের কণ্ঠরোধ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যে শৃঙ্খলার ফাঁদে পড়ে ……………………………………………… !!!!

শৃঙ্খলার সাথে একাকারভাবে জড়িয়ে আছে অর্থনীতিক মুক্তি । জড়িয়ে আছে আর্থ সামাজিক অবস্থান । আমরা বাঙ্গালিরা অল্পতেই সন্তুষ্ট সেটা প্রায় সময় যদি না পাওয়াতেই কেটে যায় তাহলেও । আমরা অনেক বেশি আবেগপ্রবন , অনেক বেশি হাসিখুশি প্রিয় । যার জন্য এত দুঃখ কষ্টের পরে মুখ বুঝে সয়ে যাওয়া নিত্য । আমরা প্রথা ভাঙ্গতে চাই না , চাই না প্রতিবাদ করতে , চাই না ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে । আর এর জন্য প্রধানত দায়ী শৃঙ্খলা ! নতুন কে ভয় পেয়ে পুরাতনকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা বা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে না পারা বা তাদের কে জীবনের মানে টা কি সেটা সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারার কারনে বেশির ভাগই জানে না আসলে কেমন হওয়া উচিত তাদের জীবন । আবার জানলেও এটার শেষ পরিনতি কি হবে এটা নিয়েই বেশি সন্দিহান থাকে যার জন্য চূড়ান্ত অনীহা । কারন শৃঙ্খলায় আছি ভালোই আছি পাছে যেন অবস্থা আরও খারাপ না হয়ে যায় ।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে মনে হয় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই শৃঙ্খলিত , এই যেমন কিছু হলেই সরকারি দল বিরোধী দলের দোষ দিবে আর বিরোধী দল সরকারি দলের দোষ দিবে, সরকারের সকল কাজকেই বিরোধী দল শৃঙ্খলিত ভাবেই বিরোধিতা করবে আবার সরকারি দল দেশে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসানোর কাজটিও শৃঙ্খলিত ভাবে ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রচার করবে, এ সব শৃঙ্খলিত ভাবে হয়ে থাকে । রামুতেও দেখলাম শৃঙ্খলিতভাবেই ইমানি জজবা নিয়ে সবাই (লিগ, বিএনপি, জামায়াত) হামলা, অগ্নি সংযোগে অংশ নিয়েছে

এ শৃঙ্খলা ভাঙ্গবে কে ? নিশ্চয়ই রাষ্ট্রযন্ত্র না ! শেষমেশে সাধারন জনগনই কিন্তু ভাঙবে । কারন রাষ্ট্রযন্ত্র চাই না এটা কেও ভাঙ্গুক । এটা যত দিন থাকবে তত দিন ষ্টীম রোলার চালানো যাবে আনায়সেই । শৃঙ্খলা ভাঙ্গা দরকার মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য । যদিওবা আমরাও শৃঙ্খলা ভাঙ্গতে জানি । যেমন করে ভেঙ্গেছিলাম ১৯৫২ তে, ভেঙ্গেছিলাম ৬৬ সালে , ভেঙ্গেছিলাম ৭০ এর নির্বাচনে । ভেঙ্গেছিলাম ৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে । শৃঙ্খলা ভেঙ্গেছিল বলেই আমাদের ভাষা আজ বাংলা, আমরা স্বাধীন জাতি । শৃঙ্খলা ভেঙ্গেছিল বলেই স্বৈর শাসকের হাত থেকে মুক্তি মিলেছিল আমাদের । এখন দরকার শৃঙ্খলা ভাঙ্গা । শৃঙ্খলিত জীবন যদি আমাদের আশা কে পুরন করতে না পারে তা হলে কেনই বা শৃঙ্খলা ? কি হবে এতে ? না পাচ্ছি মুক্তির স্বাদ, না পাচ্ছি নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রাপ্য অধিকার ।

শৃঙ্খলা ভাঙতে হবে যেখানে অন্যায় সেখানে , ভাঙ্গতে হবে নিজেদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে, ভাঙতে হবে বাঁচার মত বাঁচার জন্য । এর জন্য রাষ্ট্রের অপেক্ষা করাটা হবে বোকামির নামান্তর । কারন মুক্তি যুগে যুগে এসেছে শোষিতদের হাত ধরে , কোন শোষকের হাতে নয় ।