ঘেউ ঘেউ কুকুর, মেউ মেউ বুদ্ধিজীবী

আনিসুর রহমান
Published : 30 Jan 2012, 03:20 PM
Updated : 26 Sept 2020, 11:37 AM

বাঙালি মাত্রই 'ঘেউ' শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরের ছবি কল্পনায় চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তেমনি 'মেউ' শব্দের সঙ্গে 'বিড়াল' বা 'বিলাই'র ছবি আমাদের সামনে ভেসে উঠবে। একই ভাবে 'জাবর কাটার' সঙ্গে সঙ্গে গরুর ছবি সামনে আসবে। হয়তোবা অন্য কোনো প্রাণীও কুকুর, বিড়াল বা গরুর মতো আচরণ করে থাকতে পারে বা তাদেরও একই রকম স্বর থাকতে পারে।

আমার জন্ম বেড়ে ওঠা গ্রামে হবার সুবাদে এই তিন প্রাণীকূলের আচরণ ও স্বভাব সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তবে ইদানীং গোল বেঁধে যায়। যেমন, ধরুন ক্ষমতাধর কোনো মাস্তান, আমলা, জোচ্চোর ব্যবসায়ী, ঠিকাদার বা রাজনৈতিক দলের নেতা বা পাতি নেতার কথা শুনে বেড়ে ওঠা সময়ের কুকুরের 'ঘেউ ঘেউ' শব্দের মিল খুঁজে পাই; কিংবা উচচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় বড় জাহাবাজ পণ্ডিত বা কর্তারা যখন একই কথা দিনের পর দিন জপ করেন তখন গরুর জাবর কাটার কথা মনে পড়ে। দেশ ঘূর্ণিঝড়ে বা দুর্যোগে দুর্বিপাকে বিপদের কিনারে চলে গেলেও বা খুনখারাবি, ক্রসফায়ার, অপারেশন ক্লিন হার্ট, কুত্তা নিধন, পাখি সাবাড়, বন উজার, আদিবাসী উচ্ছেদ, বস্তিতে আগুন, নদী দখল, সংখ্যালঘু নিপাত চললেও আমাদের বুদ্ধিজীবিদের স্বরের একই মেজাজ একই আওয়াজ। যেমনটা বিড়ালের। বিড়ালের আওয়াজ কেমন? সকালেও মেউ, দুপুরেও মেউ, বিকালেও মেউ, রাতেও মেউ, খাইলেও মেউ, না খাইলেও মেউ। পিঠে এক  ঘা পড়লেও মেউ, না পড়লেও মেউ। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হয়েছে একই দশা।

এবার ঘেউ ঘেউ, মেউ মেউ, জাবর কাটা প্রসংগ থেকে সরাসরি কয়েকটি খবরের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।

এক, খবরের শিরোনাম, অপসারণ কুকুরশূন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ। ধারণা করা হয় ঢাকা দক্ষিণ নগর সংস্থা এই অঙ্গনের কুকুরগুলোকে অপসারণ করেছেন। এই নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা নির্বিকার।

দুই, ইতিহাস বিকৃতির অপরাধে ব্যবসায় অনুষদের মোরশেদ হাসান খান নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক চাকরি খুইয়েছেন। যদিও খোদ অধ্যাপক খানের শিক্ষক পরিচিতির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভাকসাইটে ক্যাডার হিসেবে পরিচিতি উল্লেখযোগ্য।

তিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষকের অভিযোগের ভিত্তিতে উপাচার্য মোহাম্মদ আবদুস সোবাহানের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে।

চার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সামিয়া রহমান এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান গবেষণা চুরি করে ধরা খেয়েছেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের চুরিধারি নতুন কিছু নয়। এসব প্রতিকার প্রতিরোধ ও কার্যকর শাস্তি প্রদানের দৃষ্টান্তও খুব একটা নাই। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার নামে মৌলিক কোনো উদ্ভাবনের নমুনা বিগত দশকগুলোতে দৃশ্যত আমাদের জানা নাই। বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোর কর্তাদের চেয়ারে যারা বসে আছেন কেউ কি বলতে পারবেন কোন কর্তার কোন গবেষণাকর্মটি দেশ ও জাতি, সমাজ ও সভ্যতা আর তাবৎ প্রাণীকূলের নিমিত্তে কোন প্রয়োগিক প্রয়োজনে এসেছে। কর্তাদের বেশির ভাগ নানা সময়ের বিবিধ ক্ষমতাধর মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও কৃপা লাভের লোভে … ভাই ভাই … আপা আপা …. ম্যাডাম ম্যাডাম জপতে থাকেন। যা শুনে বিড়ালের মেউ মেউ বা গরুর জাবর কাটার কথাই যেন মনে পড়ে।

পাঁচ, উপ-উপাচার্যের পদও মর্যাদার মধ্যে কোনো হেরফের থাকার কথা না। এটা নিতান্তই কাণ্ডজ্ঞান এর ব্যাপার। যিনি আগে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন রাষ্ট্রাচারে তার নামটিই আগে আসবে। এমনটাই শিষ্টাচার। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আগে নিয়োগপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদের আগে পরে নিয়োগপ্রাপ্ত মাকসুদ কামালের নাম ও বৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়েছিল।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা এবং সর্বোচ্চ আদালতের বয়োজ্যেষ্ঠ্য একজন আইনজীবীর মধ্যস্থাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ্য এবং বয়োকনিষ্ঠ উপ-উপাচার্য পদক্রম দ্বন্দের অবসান হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণায় উপ-উপাচার্য পদটি প্রশাসনিক ঝামেলায় জড়ানো ছাড়া আর কিছু না। উন্নত বিশ্বের ডাকসাইটে অধ্যাপক বা গবেষকরা এ ধরনের ঝামেলা এড়িয়ে চলেন। এরকম বিস্তর উদাহরণ রয়েছে। এক পর্যায়ে দেশের  সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা এবং সিন্ডিকেট হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পদ নিয়ে দ্বন্দের অবসান হয়। এটাই শেষ নয়। এর আগে খোদ উপাচার্য আখতারুজ্জামান সিনেটের ভোটে দ্বিতীয় হয়েও নিজের নামটি প্রথম লিখে উপাচার্য প্যানেল জমা দিয়েছিলেন। আর এরাই হচ্ছেন শিক্ষক। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বটে। বাটে পড়ে ধরা খেল মোরশেদ খান, সামিয়া রহমান আর মারজান।

ক্ষমতায় থাকা কর্তারা গয়ো গয়ো জিন্দাবাদ। বাকিদের অনেকেই কর্তাদের পেছনে পেছনে মেউ মেউ ধন্য।

এবার কুকুর নিধন প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আগেই উল্লেখ করেছি আমার জন্ম বেড়ে ওঠা গ্রামে হবার সুবাদে গৃহপালিত এবং ফেরারি উভয়বিধ কুকুরের সম্পর্কেই আমার ধারণা লাভ করার সুযোগ হয়েছে। পর্যবেক্ষণ বলে গ্রাম এলাকাতে রাতের সিধকাটা চোর, বেড়াকাটা বদমায়েশ শ্রেণির লোক এবং শেয়াল পণ্ডিতরা কুকুরকে আপদ এবং শত্রু মনে করে। কেননা কুকুর হচ্ছে মনিবের বাড়ি আর গোটা গ্রামের অতন্দ্র প্রহরী। তাই চোর এবং বদমাশদের রাতের কর্ম করতে কুকুর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একই ভাবে শেয়ালকেও কুকুর মনিবের মুরগি শিকার করতে প্রতিরোধ করে, গ্রাম এলাকায় চোর, বদমাশ আর শেয়াল প্রতিরোধ করা ছাড়াও কুকুরের বড় কাজ হল উচ্ছিষ্ট খেয়ে পরিবেশ প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতায় ভূমিকা রাখা।

কুকুর শহরজীবনেও যে একই কাজ করে থাকে সেরকমটাই আমার পর্যবেক্ষণ। গ্রামে চোর বদমাশ আর শেয়ালরা কুকুরের দাপটে নাস্তানাবুদ হলেও কুকুরের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ কোনো অবস্থান নিতে পারে না। কিন্তু ঢাকা শহরে কী এমন হল কার স্বার্থে এই বিশ্বস্ত নিরীহ গোবেচারা প্রাণীটিকে অপসারণ ও নিধনের জন্যে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে একেবারে কুকুর বিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে।

শহরে শেয়াল নাই, জানি। চোর বদমাশ নির্ঘাত আছে। কিন্তু রাতের বেলায় সিধ কাটা বা বেড়াকাটার মত ঝুকিপূর্ণ অপকর্ম চলে কী না জানি না। তাহলে কুকুর দল কার বা কাদের বাড়া ভাতে মুখ বা সিধ কাটায় বাধা বা বেড়া কাটায় বাগড়া দিল? কুকুরদের শহর থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে কেন? কুকুরের প্রাণি অধিকার বলে কি কিছু নাই? যতদূর মনে পড়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস নিজেও মেয়র হবার পূর্বে কুকুরের পক্ষে আইনী লড়াই করেছেন। তাহলে কি মেয়রকে বিভ্রান্ত করে বা অন্ধকারে রেখে ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের স্বার্থে এই কুকুর নিধন চলছে?

প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গ আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে কুকুর ধরে উধাও করে দেবে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ রয়েছে। কুকুরের প্রয়োজন ও উপযোগিতা নিয়ে তাদের কি কোনো গবেষণা রয়েছে? কুকুর যে কতটা পরিবেশ বান্ধব ও উপকারী বন্ধু প্রাণিটি শহরে না থাকলে নগরবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাবে।

কথায় কথা বাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা র‌্যাগ আর র‍্যাগিং শব্দ দুটিকে গুলিয়ে ফেলে র‌্যাগ ডে'কে নিষিদ্ধ করার জন্যে মাঠে নামেন। জীবন ও পরিবেশের জন্যে কুকুরের উপযোগিতা নিয়ে ইতিবাচক গবেষণা ও উদ্যোগ কেমনে নেবেন? 'মেউ মেউ' বুদ্ধিজীবী কেন বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আপ্যায়ন এবং হোটেল ব্যবস্থাপনা বলে একটা বিভাগ আছে। অথচ খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী। পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান নামে একটা ইনস্টিটিউট রয়েছে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর খাবারের যে হাল। সেখানে এই প্রতিষ্ঠান থেকে দেশের খাবার ও পুষ্টির সামগ্রিক দিক নির্দেশণামূলক কোনো গবেষণা ও সমীক্ষা কি রয়েছে? তারপর স্কুলের দুপুরের খাবারের জন্যে খিচুড়ি ভ্রমণের যে মুখরোচক কেলেঙ্কারির কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় আমরা কোথায় যাই, শ্যাম রাখি না কূল রাখি। একজন আদমি হিসেবে আমার জানার খুব আগ্রহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীরা কোনো গবেষণালব্ধ নমুনা বাতলে দেবেন কি? না কি খিচুড়ি রান্না শিখতে আমাদের বড় লাটদের বিদেশে যেতে বলবেন, কল্যাণে আমরা ফেসবুকে তাহাদের কতগুলো সেলফি দেখতে পাব। এরকম অনেক প্রসঙ্গেই আমাদের পণ্ডিত বুজুর্গ বুদ্ধিজীবীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।

এই পর্যায়ে আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর আগে একই গ্রহের নিতান্ত পিছিয়ে থাকা জনপদ নরওয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই।

আমি নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের শরণাপন্ন হব। তিনি ১৮৮১ সালে ঘোস্ট নামক নাটকটি লিখেছিলেন। নাটকটি তিনি পিতাপুত্রের যৌনরোগ সিফিলিসকে উপজীব্য করে লিখলেও তৎকালীন নরওয়ে-ডেনমার্কের সমাজে উঁচুতলার রন্ধ্র্যে রন্ধ্র্যে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সিফিলিসকে উন্মোচিত করেছিলেন। এই নাটক নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ইবসেন তাতে দমে না গিয়ে এহেন প্রতিক্রিয়ার জবাবে লিখলেন গণশত্রু বা দ্য এনিমি অব দ্য পিপল নাটকটি। এই নাটক অবলম্বনেই সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন গণশত্রু নামের ছায়াছবিটি। অবাক করার ব্যাপার বাঙালি সমালোচক গোষ্ঠী সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবিটির তাৎপর্য খুব একটা ধরতে পারেনি। যা নিয়ে সত্যজিৎ রায় অবাক হয়েছিলেন। গণশত্রু নাটকে নগরের এক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মানুষ ও নগরের কল্যাণে সত্য প্রকাশের অপরাধে শাস্তি ভোগ করেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমরা ইবসেনের চোখে দেখা দেড়শ বছর আগেকার তার স্বদেশভূমির সঙ্কট ও ক্ষমতার নানা স্তরের কুশীলব আর বৃদ্ধিজীবিদের নানা ভণ্ডামি চিহ্নিত করেছিলেন। আমাদের সমাজের সিফিলিস কে চিহ্নিত করবেন?

আমরা এমন এক সময় পার করছি দেশের যাত্রাশিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। বহুসংস্কৃতির আদিবাসী জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির মুখে। এই তো সেদিনও মধুপুরের গারো আদিবাসীদের ভিটেমাটি কলার বাগান বন বিভাগের লোকজন গুড়িয়ে দিল; একের পর এক ক্রসফায়ার, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যৌন নির্যাতিত বোনের লাশ আর শ্রমদাস ভাইয়ের লাশ; সামাজের কোষে কোষে সুবিধাভোগী মানুষদের লোভ আর লালসা আশ্রিত কত অপকর্ম; বন উজাড়, নদী নিমেষ, জলাশয় নিশ্চিহ্ন; দখল উচ্ছেদ, বস্তিতে বস্তিতে আগুন।

শেষতক সমাজ আর কর্তৃপক্ষ নগরের প্রতিপক্ষ হিসেবে খুঁজে পেল হাজার কয়েক ফেরারি কুকরকে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা নির্বিকার। এদের বিবেক বুদ্ধি লজ্জা এমন এক কাতারে ওনারা জানাজা এবং দাফনের সেলফি আর নিজের পুরস্কারের ছবি প্রাপ্তির উল্লাস আর অপ্রাপ্তির নাখোশের প্রকাশে ভরে তোলেন ফেসবুক। সকলের কল্যাণ হোক জাতির মেউ মেউ বুদ্ধিজীবীগণ ভালো থাকুন।

নগরের ঘেউ ঘেউ কুকরগুলোও অধিকার ফিরে পাক। তারাও বেঁচে থাকুক।