মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে ‘আইনিপণ্য’ ঘোষনা!

দেবু মল্লিক
Published : 14 Feb 2012, 12:49 PM
Updated : 14 Feb 2012, 12:49 PM

আইন করে কোচিং করানোকে ঠিক করে দিয়ে সরকার শিক্ষাকে বানিজ্যিক পন্যে পরিনত করলো। এর আগে দেশের বিভিন্ন সরকার আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি বেনিয়াদের পরামর্শে পরিকল্পিত ভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আর বর্তমান সরকার তার আইনি রুপ দিল।

নানা কারনে ধীরে ধীরে আমাদের দেশে কোচিং বানিজ্যের প্রসার ঘটে। তবে মাঝে মাঝে তার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু সরকারের সুদৃঢ় অবস্থানের অভাব, অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যাবস্থা, শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা এবং অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য শিক্ষক নিয়গের ফলে শিক্ষার জন্য হুমকি 'কোচিং বানিজ্য' কখনো বন্ধ করা যায়নি। উপায়ন্তু উত্তর উত্তর তা বৃদ্ধি ঘটেছে। তারই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা বছরের শুরুতে এ বছরও কোচিং বানিজ্যের সেই বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। কোচিং নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থীদের মেধারও সুষ্টু বিকাশ হচ্ছে না। তারা এক প্রকার মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে বেড়ে উঠছে।

কোচিং বানিজ্য বন্ধের ব্যাপারে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বর্তমান সরকারও। প্রথমে তারা কোচিং বানিজ্য পুরোপুরি বন্ধের কথা বললেও পরে সর্বোচ্চ দশ জন ছাত্র পড়ানো যাবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। গত বছরও কোচিং বানিজ্য সম্পূর্ন বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েও অদৃশ্য কারনে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। এবারও বছরের শুরুতে অভিভাবকদের আন্দোলন ও আদালতের নির্দেশনার কারনে একই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোচিং বানিজ্য বন্ধ না করে পাঁচ সদস্যের এক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিত্বে সরকার কোচিংকে আইনি বৈধ্যতা দিয়ে দিলো। এভাবে কোচিং বন্ধের জনদাবি ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা এবারো সরকারের কাছে উপেক্ষিত হলো।

কোচিং বানিজ্য বন্ধ করতে হলে প্রথমে এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ার কারনগুলো আমাদের খুঁজে বের করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে যথেষ্ট। পুজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় শিক্ষাকে তারা পন্য ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। তাই তো কোচিং বানিজ্যের প্রয়োজনীয়তাকে নানা ভাবে প্রশ্রয় দেয়া হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমাদের স্কুল কলেজগুলোতে মানসম্মত শিক্ষকের ব্যাপক অভাব রয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত ভাবে দলীয় লোকদের নিয়োগ দিয়ে, চরম দুর্ণীতির আশ্রয় নিয়ে করা হয়েছে। এটা শুধু বর্তমান সরকারের সময় হচ্ছে তাই নয়। আমাদের বিগত সরকারগুলোর সময়ও হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কারনে বছরে প্রায় ১৭৫-১৮০ দিন স্কুল বন্ধ থাকে। তাই বাকি সময়ের একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে শ্রেণি কক্ষে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হয় না। তাই আনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে তারা কোচিং করে। কিন্তু এ সমস্যাগুলোর সমাধানের কোন উদ্যোগ রাষ্ট্র থেকে কখনো নেয়া হয়নি। ফলে সমস্যা উত্তর উত্তর ঘনিভূত হয়েছে।

এদিকে, আমাদের উচ্চ আদালত চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রানলয় বরাবর কেন কোচিং বন্ধ করা হবে না তা জানতে রুল জারি করেন। এরপর বিভিন্ন সভা-সেমিনারে শিক্ষামন্ত্রি নূরুল ইসলাম নাহিদ কোচিং সম্পূর্ণ বন্ধ করা হবে বলে ঘোষনাও দেন। সারাদেশে কোচিং বানিজ্যের সাথে জড়িত শিক্ষকদের তালিকা করা হচ্ছে বলে সে সময় তিনি জানান। কিন্তু হঠাৎ করে করনীয় ঠিক করার নামে শিক্ষামন্ত্রনালয় থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্ত্বিতে শিক্ষামন্ত্রনালয় আদালতের নির্দেশরা অমান্য করে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোন শিক্ষক বাইরে কোথাও বা নিজের বাসায় কোচিং করাতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত দেয়। তবে একই সাথে জানানো হয়েছে কোন শিক্ষক নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন। এছাড়াও নিজ প্রতিষ্ঠানের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলের ভিতরে পড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে। এভাবে অবৈধ কোচিং বানিজ্যকে সরকার বৈধ্যতা দিল। জাতির উন্নতির জন্য প্রথমেই দরকার যে শিক্ষা তাকেই আইনের মাধ্যমে 'পন্য' বানানো হলো।