মৌলিক অধিকার চিকিৎসা: রাষ্ট্র কথা রাখছে না

দেবু মল্লিক
Published : 26 Feb 2012, 11:22 AM
Updated : 26 Feb 2012, 11:22 AM

রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী, আনুগত্য স্বীকার করার বিনিময়ে রাষ্ট্র আমাদের কয়েকটি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু আমরা সাধারণ নাগরিকরা রাষ্ট্রের অনুগত্য স্বীকার করলেও আমাদের মৌলিক অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সব সময় কৃপণতা দেখিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণী অর্থিক অভাবের কথা বলে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে আমাদের ন্যায্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এখনো তাই চলছে। প্রতিনিয়ত অপ্রয়োজনীয় খাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও দেশের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তার সামান্যটুকু জোগাড় করতে পারছে না। সারাদিন পরিশ্রম করেও দুবেলা খাবার জুটছে না। তাই প্রশ্নই ওঠছে না, তার বেচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অন্য কোন উপাদান সে সঠিক ভাবে পাচ্ছে কি না। কিছু দিন আগে লিখে ছিলাম শাসক গোষ্ঠি কী ভাবে মৌলিক অধিকার শিক্ষাকে আইনি পন্য ঘোষনা করলো, তার কাহিনী। আজ লিখছি আমাদের দেশের চিকিৎসা সেক্টরের বর্তমান করুণচিত্র।

প্রথমত বলা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। গত তিন বছরে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের কাহিনী পূর্বের যে কোন পুঁজিবাদী সরকারকে হার মানিয়েছে। শতভাগ দলীয় বিবেচনায় প্রায় ৪০ হাজার জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে । কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যায়নি। উল্টো নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলার কারনে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। বর্তমান সরকারের আমলে স্থাপিত মেডিকেল কলেজের স্বচ্ছতা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ সরকারি দলের সাংসদরা।

বেসরকারি সাহায্য সংস্থ্যা 'টেরেডেস হোমস্ ফাউন্ডেশন' এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বর্তমানে শুধু কুড়িগ্রাম জেলায় ৩৫ হাজার শিশু পুষ্টিহীনতায় ভূগছে। যারা বর্তমান সরকারের মেয়াদে জন্মগ্রহণ করেছে। হিসাব অনুযায়ি সারা দেশে এমন শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ। বর্তমান সরকারের মেয়াদে জন্ম নেয়া এ শিশুদের একটা বড় আংশ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। ৭ ফেব্র"য়ারি শিশু সুরক্ষা দিবসের এক অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশন এ তথ্য প্রকাশ করে।

বর্তমান সরকারের তিন বছরে চিকিৎসক ও সেবিকা পদে ৩৯ হাজার ৯২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিসিএসের মাধ্যমে মাত্র ১৯৭ জন সহকারী সার্জন নিয়োগ নিয়োগ দেয়া হয়। একই পদে এডহক ভিত্তিতে ৪ হাজার ১৩৩ জন নিযোগ দেয়া হয়। যাদের প্রায় সবাই দলীয় বিবেচনা নিয়োগ পান। এছাড়া গত তিন বছরে সরকার ৬৪ জেলা সিভিল সার্জনের অধীনে ৬৩৯১ জন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ দিয়েছে। আর সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে সারা দেশে সাড়ে তের হাজার স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ দেয় সরকার। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অন্যান্য যে কোন সময়ের থেকে চরম অনিয়ম হয়। লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েও অনেকে নিয়োগ পান। শুধু তাই নয় পরীক্ষায় অংশ না নিয়্ওে শতাধিক নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা ঘটে। যা ওই সময় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বেসরকারি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৪৭ ভাগ প্রতিনিয়ত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। ফলে একেবারে ভেঙে পড়েছে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাত।

পত্রিকা মারফত জানা যায়, দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে চায় বর্তমান সরকার। এজন্য এখন পর্যন্ত তারা সারাদেশে ১১ হাজার ২৬২টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছে। নিয়োগ দিয়েছে ১২ হাজার ৭৪১ জন জনবল। এসব ক্লিনিকে প্রায় একশ কোটি টাকার ২৮ প্রকারের ঔষধ সরবরাহ করেছে সরকার।

কিন্তু আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার কোন সুফল সাধারন মানুষ পাচ্ছে না। সরকারের সরবরাহ করা বিক্রয় নির্ষিদ্ধ ঔষধ স্বাচিপ নেতা ও দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা কর্মচারীরা বাইরে বিক্রি করছেন। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শুধু সরকারি ঔষধ বাইরে বিক্রি করছেন না। একই সাথে তারা প্রতিনিয়ত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। বেসরকারি গবেষনা সংস্থা 'স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন'র প্রতিবেদন অনুযায়ী নতুন নিয়োগ পাওয়া স্বাস্থ্য কর্মীদের ৪৭ ভাগ প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের দেওয়া জমির ওপর গড়ে ওঠা এসব ক্লিনিক প্রায় সব দিনই বন্ধ থাকে।

বর্তমান সরকারের আমলে চালু শুধু কমিউনিটি ক্লিনিকেই নয়, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিকিৎসা পাওয়ার একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতালগুলোতেও চলছে নানা অব্যবস্থাপনা। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স। প্রয়োজনের তুলনায় অ্যামবুলেন্স একেবারে নেই বললেই চলে। ভোলার চিকিৎসা সেবার করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন খোদ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, ভোলায় ৮০ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও আছেন মাত্র ২০ জন। একই দিন সংসদ সদস্য মারুফ সাকলাইন তার নির্বাচনী এলাকার দুটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক সংকটের কথা কথা তুলে ধরেন। সরকার দলীয় আরেক সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক বলেন, মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতালে ৮০ জন ডাক্তারের পদ থাকলেও আছে মাত্র ২০ জন ডাক্তার। তাছাড়া মানিকগঞ্জ জেলায় চিকিৎসা সেবার জন্য কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ'র শাহ জিকরুল আহমেদ বলেন, তাঁর এলাকার হাসপাতালের দুটি অ্যাম্বুলেন্সের দুটিই অকেজো। বেসরকারি গবেষনা সংস্থা 'স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন'র প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। দেশের মোট সরকারি চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীদের ২০ ভাগ পদ শূন্য রয়েছে। তাছাড়া কর্মরতদের মধ্যে প্রায় ৪৭ ভাগ কোন না কোন অজুহাতে প্রতিনিয়ত কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকছেন।

একদিকে, স্বাচিপ নেতাদের দৌরাত্ম্য, অন্যদিকে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া নতুন কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ও হাসপাতালে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় প্রতিনিয়ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু সরকার থেকে কোন কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বলা যায় নেয়া সম্ভব হয়নি। এর প্রথম কারন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সরকার চিকিৎসা সেবাকে বানিজ্যিক পন্য ভাবতে চাইছে। ব্যববসায়ীদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সরকারের উপর তাগিদ রয়েছে ওই সব বন্ধুদের। তাইতো সারা দেশে সরকারি প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠছে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক। এসব চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা সেবার নামে চলে চিকিৎসা বানিজ্য। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এসব বানিজ্যিক কেন্দ্রে দেশের পরিচালকরা কোন সময় চিকিৎসা নেন না। কারন এখানে টাকার লেনদেন হলেও চিকিৎসা সেবা মেলে না।

আর দ্বিতীয় কারন হলো মাত্র দুই বছর পর জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এসব ক্যাডারদের কাজে লাগবে। তাই তো মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্য সেবা থেকে সাধারণ মানুষদের বঞ্চিত করেও তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। খালি চোখে আমরা তার প্রমাণও দেখতে পাই। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধুমাত্র বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শোভাযাত্রা আর আলোচনা অনুষ্ঠান করায় একমাত্র কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। এসব কাজে রাষ্ট্রিয় কোষাগার থেকে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকা ব্যায় হচ্ছে। অথচ মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্য সেবার অর্থাৎ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

তবে মনে রাখা দরকার এভাবে কখন সমাজ ব্যাবস্থা চলে না। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব এমন পরিস্থিতিতে অবহেলিত মানুষ হয় তার অধিকার ছিনিয়ে এনেছে, অথবা রাষ্ট্রের অনুগত্য অস্বীকার করেছে।