তাবিথ আওয়ালের মনোনয়ন: দুদক-ইসি কী বলবে?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 Jan 2012, 04:31 PM
Updated : 7 Jan 2020, 12:28 PM

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে দুর্নীতি হতে পারে, এমন অভিযোগ ওঠার পরপরই দুর্নীতি দমন কমিশন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। অভিযুক্তরা অস্বীকার করলেও দায়ের হয় মামলা। কানাডাতেও মামলা হয়। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে বদনাম দিয়ে ঋণ চুক্তি বাতিল করে দেয়। অভিযোগের পর একাধিক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন। একজন মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সংবাদপত্রে তখন কত লেখালেখি। টেলিভশন টক শোতে কত আলোচনা। বিশ্বব্যাংক যখন বলেছে তখন নিশ্চিত ধরে নিতে হবে- দুর্নীতি হয়েছেই।

দুর্নীতির প্যারাডাইস পেপারস ফাঁস হয় ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে। 'অভিজাত দুর্নীতিগ্রস্তদের' তালিকায় নাম ছিল বাংলাদেশের কয়েকজনের। এর মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ধনকুবের আবদুল আউয়াল মিন্টু, তার স্ত্রী নাসরিন ফাতেমা আউয়াল এবং তিনি ছেলে তাবিথ আউয়াল, তাফসির মোহাম্মদ আউয়াল ও তাওয়ার মোহাম্মদ আউয়ালের নাম ছিল। তারা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বারমুডায় অর্থ সরিয়ে রেখেছিলেন, এটাই জানা গিয়েছিল প্যারাডাইস পেপারস থেকে।

পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে কানাডার আদালত বলেছিল- 'গালগল্প, গুজব ও রটনা' দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। এমন অভিযোগ আনার জন্যও তারা সংশ্লিষ্টদের কঠোর সমালোচনা করেছিল। কিন্তু প্যারাডাইস পেপারস কোনও গালগল্প ছিল না। বাংলাদেশে অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তারা স্বীকার করে নেন- বারমুডায় অর্থ জমা রেখেছিলেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক এ নিয়ে তদন্তও শুরু করেছিল। কিন্তু তদন্ত কাজে খুব একটা অগ্রগতি হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। অথচ পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের আভাস মিলছে, এমন অভিযোগ পেয়েই দুদক দেখিয়েছিল ক্ষিপ্রগতি?

কেন এই দ্বিমুখী নীতি?

আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয়। তার এক পুত্র তাবিথ আউয়ালও রাজনীতিতে উদ্যোগী যুবক। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত মেয়র নির্বাচনেও প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনের আড়াই বছরেরও বেশি সময় পর দুর্নীতির প্যারাডাইস পেপারস ফাঁস হয়। তারপর দুই বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ওই তালিকায় নাম থাকার পরও বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় মেয়র পদে নির্বাচন প্রার্থী হওয়া কি সমর্থনযোগ্য?

২০১১-২০১২ সালে পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক কিংবা অন্য কোনো সংস্থা তখন পর্যন্ত একটি পয়সাও ছাড় করেনি। কীভাবে দুর্নীতি হবে? বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হলো- সেতু নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়ায় ঠিকাদার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ করবে। এ জন্য ব্যয় পড়বে ৫ কোটি ডলারের মতো। সেই কাজ কে পাবে, সেটা নিয়েই দুর্নীতি হতে পারে বলে ধারণা পেয়েছে। সূত্র হিসেবে বলা হলো- এসএনসি-লাভানিনের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে তারা একটি ডায়েরি পেয়েছে যাতে বাংলাদেশের কাকে কত পার্সেন্ট ঘুস দেওয়া হবে এমন সাংকেতিক বিবরণ ছিল। মোট ব্যয়ের ১০ পার্সেন্ট কয়েক ব্যক্তিকে দেওয়া হবে। এ নিয়ে তুমূল হৈ চৈ চলে। পরে জানা যায়, এমন ডায়েরির অস্তিত্বই নেই।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়, সে অভিযোগ অনেক দিনের। গরীবদের এ অর্থ পাচারের সুযোগ নেই। তাদের তো আর সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকে না! অঢেল অর্থ থাকলে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য বারমুডা যে স্বর্গরাজ্য, সে তথ্যও তাদের অজানা। কিন্তু আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং তার পরিবারের সদস্যদের সেটা ভাল করেই জানা। প্যারাডাইস পেপারস- এ নাম আসার পর তিনি ডেইলি স্টার পত্রিকাকে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক তেল কোম্পানি ইউনোকল ও শেভরনের শেয়ার ছিল তার পরিবারের সদস্যদের। এ কারণেই হয়ত নাম এসেছে।

বাংলাদেশ তেল-গ্যাসের ওপর ভাসছে- এটা বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্ন যখন আসে তখন শর্ত দেওয়া হয়- ভারতে গ্যাস রপ্তানি করতে দিতে হবে। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যখন ঢাকা আসেন, তিনি শেখ হাসিনার কাছে তার নিজ দেশের তেল-গ্যাস কোম্পানির পক্ষে ওকালতি করে একই দাবি জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আগে অনুসন্ধান শেষ হোক। গ্যাস পেলে প্রথমে ৫০ বছরের মজুদ বাংলাদেশের জন্য রাখব। এরপর যদি উদ্বৃত্ত থাকে, রপ্তানির বিষয় ভাবা যাবে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নাখোশ হন। তিনি যা বলবেন, সেটাই মেনে নিতে হবে শেখ হাসিনাকে, এমন মনোভাব দেখান। তার কাছে এটা ছিল 'অবাধ্যতা'। এ জন্য শাস্তিও নির্ধারিত হয়- ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে তাকে সরিয়ে অতিশয় বাধ্য বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। কলকাঠি নড়তে শুরু করে। শেভরন কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক। রাতারাতি হয়ে গেলেন বিএনপির নেতা। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরদিনই সাইফুর রহমান বিবিসিকে বলেন, 'মাটির নিচে গ্যাস রেখে লাভ নেই। রপ্তানি করাই ভাল।'

আবদুল আউয়াল মিন্টু ডেইলি স্টারকে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রচুর গ্যাস আছে, এটা জেনেই তিনি ইউনোকলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। গ্যাসের ওপর ভাসছে দেশ, তাই রপ্তানি করা উচিত।

তিনি এটাও স্বীকার করেন, অন্য দেশে তার ব্যবসা আছে। এ কারণে অফসোর কোম্পানি খোলা হয়েছিল। এভাবে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, কর ফাঁকির স্বর্গ রাজ্য বারমুডায় তার কোম্পানি অর্থ লেনদেন করেছিল। আর এ লেনদেন থেকেই তো অর্থ পাচার হয়।
নির্বাচন পরিচালনার জন্য দায়বদ্ধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন বা ইসি। জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে প্রার্থীরা হলফনামা দেয়। আয়-ব্যয়ের হিসাব, মামলা-মোকদ্দমা আছে কীনা, জেল খেটেছে কীনা- এসব জানাতে হয় লিখিতভাবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল কি প্যারাডাইস দুর্নীতিতে তার নাম থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন? পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হতে পারে- এ অভিযোগ ছিল নিছক গালগল্প ও গুজব। কিন্তু প্যারাডাইস পেপারস মোটেই তেমন কিছু নয়। তদুপরি তাবিথ আউয়ালের পিতা এ তালিকায় তার ও পরিবারের সদস্যদের নাম থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তাহলে তাবিথ আউয়াল কীভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকার মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী থাকতে পারেন?

নির্বাচন কমিশনের কি কিছুই করার নেই? দুদকই বা কী বলবে?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্যারাডাইস পেপারস-এ বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্ণধারদের নাম থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্তদের শাস্তিও দাবি তারা তুলেছিল। এমন অপরাধে যুক্তরা কীভাবে ঢাকা সিটির মেয়র পদে নির্বাচন করতে পারে, তাদেরও সে প্রশ্ন তোলা উচিত।

অর্থ পাচারে যুক্ত ব্যক্তিকে মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে বিএনপিই বা কী বার্তা দেশবাসীকে দিতে চাইছে? আবদুল আউয়াল মিন্টুকে দলে নিয়ে তারা এ বার্তা দিয়েছিল- বাংলাদেশের স্বার্থ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের তেল-গ্যাস কোম্পানির স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য। রংপুরের একটি আসনে উপনির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার খুনে জড়িত খায়রুজ্জামানের স্ত্রী রিটা রহমানকে ধানের শীষে পার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েও তারা একটি বার্তা দিয়েছিল, ১৫ অগাস্টের নৃশংস খুনিদের সঙ্গে বিএনপি রয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনে ১৯৭১ সালের গণহত্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের ধানের শীষ প্রতীক ব্যবহার করতে দিয়েও তারা বার্তা দিয়েছিল তারা গণহত্যায় অংশগ্রহণকারীদের পক্ষে।

বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারে জড়িত এক ব্যক্তিকে প্রার্থী করার মাধ্যমে তারা দেশবাসীকে এটাই সম্ভবত বলতে চাইছে, ক্যাসিনো কাণ্ড, অর্থপাচার, ব্যাংকের ঋণ ফেরত না দেওয়া, কোনো কিছুতে সংশ্লিষ্টতা তাদের কাছে অপরাধ নয়।

নির্বাচন কমিশনও কি সেটাই মনে করে?