স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে চক্রান্ত

দীপেশ রায়
Published : 7 March 2015, 04:36 PM
Updated : 7 March 2015, 04:36 PM

উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু হলো স্বাধীনতা চেতনার জয়গান। শুরু হলো বাঙ্গালীর ঐক্যময় বিপ্লব। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছিল বাঙ্গালীর স্বাধীন সূর্য্য, নবাব সিরাজ- ঊদ-দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে।তারপর প্রায় দুইশত বছরের নির্যাতনের শৃঙ্খল পরে কেটে গেল বাঙ্গালীর নির্যাতিত জীবন। এ অভিশাপ থেকে তারা মুক্ত হলেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই ও ১৫ই আগষ্ট ব্রিটিশ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে।এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা চেতনার ফলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পতনের পর আমাদের আজকের যে স্বাধীন ভূ-খণ্ড বাংলাদেশ, এটা আমরা সহজে লাভ করিনি। এর পেছনে কিছু ঘটনা রয়েছে,  সেটা আমাদের একান্ত রক্তে মাখা ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান নামক দু'টি ভূ-খণ্ড তখন একই সরকার ব্যবস্তায় স্বাধীন রাষ্টীয় মর্যাদায় পরিচালিত হতে থাকলো।পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরনের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার বাঙ্গালীদের শুরু হলো অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। তখন থেকে পর্যায় ক্রমে ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯ পেরিয়ে এলো ১৯৭১ এর ২৬শে মার্চ।এলো বাঙ্গালীর স্বাধীনতা দিবস। সেই ইতিহাস লিখে, লেখার কলেবর বৃদ্ধি করব না। কেননা সে রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস সকল বাঙ্গালীর অস্তিত্তে জাগ্রত।

এখন আসা যাক, ২৬শে মার্চ বাঙালির স্বাধীনতা দিবস–বড় আনন্দের বড় সুখের এবং গৌরবের।আমার জন্ম গ্রহণের পর সে গৌরবের ভাগিদার হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। যখন হাটি হাটি পাঁ পাঁ করে এই বাংলার মাটিতে ডলেছি কোমর- ভাবতে পারিনি যে আমি এত বড় ভাগ্যবান সন্তান।তারপর বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে যখন পড়াশুনার সাথে যুক্ত হলাম তখন ধীরে ধীরে স্বাধীন বাংলা দেশের রক্ত মাখা অশ্রু সজল বেদনায় বিপ্লাবীত বিল্পবের ইতিহাস জানতে পারলাম। রেডিও ও টেলিভিশনে এই সকল স্মরনীয় দিন গুলি যখন উদযাপন হতে দেখতাম তখন শরীরের পশম গুলি কাটা দিয়ে উঠতো। কেউ আমাকে শিখিয়ে দেয়নি যে আমার বাংলাদেশকে ভালবাসতে হবে বা বাংলাদেশের ইতিহাসকে জানতে হবে।

স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের এক জন নাগরিক হিসাবে আমি নিশ্চয় বিচার করে দেখার স্বাধীনতা রাখি যে আমরা বাঙালি, পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্ত হয়ে আজ যে স্বাধীন দেশে বসবাস করছি, সেই স্বাধীনতা আজ আমাদের সমাজের প্রতিটা স্তরে তার আদর্শ কতটা প্রভাববিস্তার করতে পেরেছে এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই স্বাধীন ভূ-খণ্ডে মানুষের জন্য কি বয়ে নিয়ে আসতে যাচ্ছে? একাত্তরের চির পরাজীত শক্তি স্বাধীনতা লাভের আজ একচল্লিশ বছর পরে এসে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সর্ব স্তরে এই স্বাধীনতার ইতিহাস উল্লেখযোগ্য চর্চার অভাবে স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম আজ স্বপ্নের রূপকথা বলে মনে করে।

আজ বাংলার মাটিতে "পাকিস্তান জিন্দাবাদ" শ্লোগান শোনা যায়। এর কারণ কী? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? তবে আমার যেটা মনে হয় ১৯৭১ এ ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভের পর সদ্য যুদ্ধ বিদ্ধস্ত স্বাধীন দেশটিকে পূণর্গঠনের কাজ করে এ গিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাঙ্গালী পরিবারের অবিভাবক বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল ১৯৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট। এরপর থেকে অবিভাবক হীন বাঙ্গালী জাতির জীবন তথা সংস্কৃতি ও মুক্তি যুদ্ধের আদর্শ লাঞ্ছিত হতে শুরু করল।ক্ষমতার পালাবদলে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেন। বাঙ্গালী জাতি তার স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাপ্ত আদর্শ চর্চার সুযোগ পেলেন।আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেলেন বাঙ্গালীর মাতৃভাষার স্বীকৃতি।মাতৃভাষা এবং মাতৃ সংস্কৃতির জন্য রক্ত দেয়ার ইতিহাস কেবল আমাদেরই আছে।বিশ্বের আর কোন জাতির ইতিহাসে তা নেই। সে দিক থেকে আমরাই বিশ্বের সকল জাতির আদর্শ স্বরূপ।মাতৃভাষা এবং মাতৃ সংস্কৃতিকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় বিশ্বের সকল জাতি আজ আমাদের কাছ থেকে তা শিখেছে। বাঙ্গালীর এই গর্বের ইতিহাস কে পৌঁছে দিল বিশ্ব দরবারে ?  জাতীর জনকের উত্তরসূরী, গণ-মানুষের নেত্রী বতর্মান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আমরা একটা জিনিস লক্ষ্য করি–এ দেশের সরকারের রদ-বদলের সাথে সাথে আমাদের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত যে বিষয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্য থাকে,  সেটার একটা বিকৃতি আসে। সে কারনে স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের সঠিক ইতিহাস জানা সম্ভব হয় না। যেমন একটি বিষয় উল্লেখ করা যাক– "স্বাধীনতার ঘোষক কে?" এ প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরা দুই ধরনের জানে।-

১. স্বাধীনতার ঘোষক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

২. স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

জানিনা শিক্ষার্থীদের তৃতীয় আর একটি উত্তর, 'স্বাধীনতার ঘোষক গোলাম আজম' ভবিষ্যতে শিখতে হবে কিনা। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠনের শিক্ষার্থীরা সেটাই শিখছে পাচঁ বছরের পালা বদলে এই বিকৃত ইতিহাস।এই বিষয়টি নিয়ে প্রকৃত ইতিহাসের আলোকে আমি যেটা বুঝি – শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা একেবারে যুক্তিহীন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা পত্রের পাঠক মাত্র।যাদের বাংলা ভাষা বোধ আছে তারা কখন সেটা বলবে না। দলীয় স্বার্থেও না। কেননা একটা জীবন্ত সত্যের স্থান সকল স্বার্থের উর্দ্ধে।আমরা কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে ভয়েজটি শুনতে পাই সেটি তা প্রমাণ করে।তথাকথিত শিক্ষাহীন মেধাহীন রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে সত্য ইতিহাস আজ মৃত্যুর মুখে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৭১ দেখিনি চর্ম চোখে। দেখিনি সেদিনের গণ-হত্যা,  নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা, বিভৎস্য সে সব দৃশ্য। পড়েছি ইতিহাসের পাতায়।২০১২-২০১৩ বা তার পূর্ব থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দেখেছি। চলমান এই রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে খাকলে তা ১৯৭১কে ও হার মানাবে। বতর্মানে রাজনীতির নামে যেটা চলছে সেটা কোন সুস্থ রাজনৈতিক নীতিমালার মধ্যে পড়েনা। এটা রাজনীতির নামে পৈশাচিকতা ছাড়া কিছু নয়।

একটা স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গেলে হরতাল হবে, মানুষ পুড়িয়ে মারা হবে, ‍ দেশের সম্পদ ক্ষতি করা হবে–মুক্তি যুদ্ধের আদর্শ আমাদের সে শিক্ষা দেয় না। বরং মুক্তি যুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল,  সেই পরাজয়ের তিক্তগ্লানীর ক্ষোভ উক্ত আচরণের মধ্যে তাদের মৃত বিবেকের নগ্ন আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার অপচেষ্টা করে যচ্ছে। চেষ্টা করে যাচ্ছে কিভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচান যায়। কিন্তু মুক্তি যুদ্ধের চেতনা এতটা হেয়ালী আবেগ নয় যে,'গণ-জাগরণ মঞ্চ' এর মত কোন নতুন প্রজন্ম সংগঠিত হতে পারবে না। নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতা উত্তর যুগে প্রকৃত স্বাধীনতার  আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে আজকের'গণ-জাগরণ মঞ্চ'।

ভুলে যায়নি বাঙালি গোলাম আজমের জামায়াতি ইসলামির অঙ্গ সংগঠন ইসলামি ছাত্র ‍শিবির আজ বিশ্বের তৃতীয় স্বসস্ত্র স্বন্ত্রাসী রাজনৈতিক সংগঠন বলে পরিচিত। এ কৃতিত্ব গোলাম আজমের। গোলাম আজমের মুক্তি যুদ্ধের বিরোধীতার কথা ভুলিনি বাংলাদেশ। ভুলিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনমত গঠনের যে অপচেষ্টা।তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন এবং বিরোধী পাকিদের পরাজয়ের চরমব্যর্থতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর স্বাধীন দেশে ফিরে এসে মসজিদে নামায পড়তে গিয়ে জুতাপেটা খাওয়ার ইতিহাস ভুলে যায়নি বাংলাদেশ।যতই চেষ্টা অপচেষ্টা চালানো হোক না কেন ভবিষ্যতে স্বাধীনতার ঘোষক কে?  এই প্রশ্নের তৃতীয় উত্তরটি গোলাম আযম হওয়া নিশ্চয় সম্ভব নয়।বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এটা ঐতিহাসিক সত্য।

দীপেশরায়।