বিভীষিকার সেদিন ২১শে আগস্ট ২০০৪, দানব নেমেছিলো যেদিন!

আকাশের তারাগুলি
Published : 6 July 2011, 04:43 AM
Updated : 6 July 2011, 04:43 AM

মুহুর্তেই ফাঁকা হয়ে গেলো জনসমাবেশ। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, মানুষের গগন বিদারি চিৎকার, কান্না। চারিদিকে ছুটছে মানুষ, যে যেদিকে পারছে, কেউ কেউ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই মিনিট খানেক আগের কথা, মহাসমুদ্র হয়েছিলো জনতার। ধোঁয়া সরে যাবার আগেই চোখে পড়ে জুতো, স্যান্ডেলের স্তুপ সারা রাস্তায়। চোখ যায় চারিদিকে, বিশ্বাস হয় না, একি রক্তের বন্যায় লাল হয়ে আছে রাজপথ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ। একটা নয় দুইটা নয়, অনেক অনেক গুলো লাশ। কারো পা নেই, হাত নেই। পা খানি উড়ে গেছে অদূরে। একজনের হাতটি এখনো বিচ্ছিন্ন হতে বাকি, একটু একটু কাঁপছে মনে হলো রক্তাক্ত শরীরে কই মাছ নড়াচড়া করছে। একটু সামনে এগোই একি সবই চেনামুখ গুলো কেমন অচেনা নিস্তব্ধ, নিথর। প্রায়ই এদের দেখি নিয়মিত বা অনিয়মিত ভাবে। বুক ফেটে কান্না পেয়ে যায়, একি হলো, এতো রক্ত, এতো লাশ।

একটু ভালো করে তাকাই কে যেন একজন দু'পা আলাদা হয়ে আছে শরীর থেকে, মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। আর কি কি যেন বলতে বলতে নীরব। তুলে নিয়ে যাওয়া হলো বাঁচানোর আশায়। ফর্সা মুখখানি দেখে বুঝা যায়, ইনিই আমাদের আইভি আপা, সকলের আপা। সদা হাসি খুশি, কখনো কর্মী সমর্থকদের আলাদা করে রাখতে পারতেন না। আগলে রাখতেন। স্টেজের চাইতে কর্মীদের কাতারে যিনি নিজেকে ভাবতে ভালো বাসেন।

একটা টিফিন ক্যারিয়ার পড়ে থাকতে দেখা যায়, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, তাই খাবার বয়ে বেড়ানো। সে কি খাবার গুলো খেয়ে নিতে পেরেছে, হয়তো পেরেছে অথবা ভেবেছে সভা শেষে খেয়ে নিবে।

শত শত লোক, নারী পুরুষ, যুবক, তরুন, তরুণী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যা পাওয়া যায় রিক্সায়, ভ্যান গাড়িতে, কিংবা স্কুটারে, যা পাওয়া যাচ্ছে সবার গন্তব্য একটাই হাসপাতাল। কাউকে পাঁজাকোলে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কে জানে ততক্ষণে বেঁচে যাবে কিনা।

এরই মধ্যে শোরগোল, কোন একটা বস্তুর দর্শনে, হ্যাঁ গ্রেনেড, উপস্থিত সাংবাদিকরা ছবি তুলছে। একাধিক গ্রেনেড পাওয়া যায়। এগুলো নাকি আর্জেস গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। ছুড়ে মারার আগে সঠিক পন্থা সম্ভবত অবলম্বন করা হয় নাই। যদি সফল হতো কি হতো? আসলে কি হতো না? লাশের সংখ্যা বেড়ে হয়তো দ্বিগুন হতো, বেশিও হতে পারতো। আহত হতো আরো…….।
১টি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত পড়ে থাকতে দেখা যায় স্টেজের কাছাকাছি, ট্রাকের উপর তৈরী করা হয় স্টেজ।

একটু আগেই এখানে ছিল বিশাল জনসভা। সন্ত্রাস ও জংগীবাদ বিরোধী জনসভা। সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজি করে রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা হয়। বেছে বেছে আওয়ামীলীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যার মাধ্যমে আওয়ামি লীগকে ধংস করার প্রক্রিয়া এগোতে থাকে চারদলীয় ঐক্যজোট।

গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী, আহসানুল্লাহ মাষ্টার,মনজুরুল ইমাম সহ প্রগতিশীল সাংবাদিকদের হত্যা করে, দেশের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। এই ধারাবাহিকতা শুরু হয় ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তি আওয়ামী লীগ কর্মী সমর্থক ও সংখা লঘু নিধন দিয়ে শুরু করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজন ধরে ধরে হত্যা নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ শুরু করে। যুবতি, কিশোরী, তরুণী এমনকি মধ্যবয়সী নারীকে ধর্ষিতা হতে হয়েছে তৎকালীন সদ্য ক্ষমতাবান। জানোয়ারের চরিত্র ধারন করেছিলো। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা প্রতিবাদী উত্তাল জনসভায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে দাঁড়ান সমবেত সকলে উদ্দেশ্যে। বক্তব্য শেষ করবেন অনেকেই নেমে পড়েন স্টেজ থেকে। শেখ হাসিনাও নেমে পড়বেন উনার বুলেট প্রুফ গাড়ি তৈরী। ঠিক সে মুহুর্তেই গগন বিদারী বিকট আওয়াজ, আরোও একটি আওয়াজ, লুটিয়ে পড়লেন কেউ কেউ, স্টেজে এবং স্টেজে কাছে যারা ছিলেন তৈরী করলেন মানবপ্রাচীর। পর পর মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলা হয়, মনে হলো কোন দানব নেমে এসেছে পৃথিবীতে তার ধংস তান্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত শীর্ষ নেতৃত্ব সহ অনেক নেতা কর্মী। রক্তে রন্জিত হয় রাজপথ দানবীয় হামলায়। একসময় থেমে যায় গ্রেনেডের শব্দ। চারিদিকে শোনা যায় কান্নার রোল। লোকজন ঠেলে পাঠিয়ে দেন মুল টার্গেট শেখ হাসিনাকে। গাড়িতে উঠে বসেন। গ্রেনেড টার্গেট মিস হলে কি হবে? শুরু হলো গুলি হাসিনার উপর। কিন্ত ওখানে আছে হাসিনা অন্ত প্রান মাহবুব। সকল গুলি নিজের বুকে ধারন করে বাঁচিয়ে তোলে তার প্রাণপ্রিয় আপাকে। নিজে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

তান্ডবলীলা শেষ হলে দৃশ্যে চলে আসে আইন শৃংখলা বাহিনী, সেনাবাহিনী। না, ভাবার কোনো কারন নেই উনারা এখানে এসেছেন নিহত আহতদের উদ্ধারে এসেছেন। উনারা এসে সবার আগে যে কাজ টি করলেন পুরা রাস্তাটি কর্ডন করে নিলেন এবং অবিস্ফোরিত গ্রেনেড গুলো নিয়ে গেলেন। এবং রাস্তাকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে ফেললেন। উদ্দেশ্য মহৎ, সকল প্রকার চিহ্ন নষ্ট করে ফেলেছেন। নিয়ে যাওয়া গ্রেনেড বিস্ফোরন করলে গ্রেনেড সম্পর্কিত সকল তথ্য নেয়া অনেক কঠিন করে দিল। কোন সুরৎহাল রিপোর্ট করা হয়নি।

ভয়াবহ সেই দিনে ২৪টি লাশ আর কয়েকশ আহত হয়। আজ ও গ্রেনেডে স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে ঘুরছে শত শত মানব মানবী। যা শরীর থেকে বের করার অযোগ্য। আওয়ামি লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে গ্রেনেড মেরে ধংস করে আওয়ামি লীগকে নেতৃত্ব শুন্য করতে চেয়েছিলো একটি গোষ্ঠী। চারদলীয় ঐক্যজোট তখন সরকারে। আওয়ামি লীগের আহত সদস্যরা উপস্থিত সংসদে। আওয়ামি লীগের কাউকে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। নিষ্ঠুর ভাবে টিটকারী করেছে। সরকারি দল চাপিয়ে দিলো আওয়ামি লীগের উপর। তৈরী হলো সরকারি দল(চার দলীয় জোট) কর্তৃক আবিষ্কারের কাহিনী জজ মিয়া উপাখ্যান। ঘটনা প্রবাহিত হতে থাকে ২৪টি লাশ ও শরীরে স্প্রিন্টার বহনকারী সকলের সাথে নির্মম নিষ্ঠুরতার সর্বশেষ নিদর্শন রেখে ভিন্ন খাতে।

ঘটনার পর হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় হাসপাতাল গুলোতে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতাল। আসতে থাকে লাশ আর লাশ। আসতে থাকে অংগ হারা মানুষের মুমুর্ষ দেহ, আসতে থাকে স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত নেতাকর্মী। রক্তে ভেসে যায় হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগ, ঠাঁই হয় না ইমার্জেন্সিতে, ফ্লোরে শুইয়ে রাখা হয়। রক্তে ভেসে পড়ে হাসপাতালের ফ্লোর। স্বজনের আহাজারি, সহ নেতাকর্মীর গগন বিদারী কান্নার চিৎকারে ভারি হয়ে যায় হাসপাতালের আশপাশ। প্রচুর রক্তের দরকার হয়। সহকর্মী আর সমর্থকরা রক্ত দিতে থাকে লাইন ধরে। তাতেও কুলোয় না আরো রক্ত দরকার হয় আরো

আদা চাচার কথা মনে পড়ে, আওয়ামি লীগের সমাবেশে কেউ যাবে আরে আদা চাচার হাতের আদা খাবেনা সেকি হয়? আদা চাচা খুব জানতো কর্মীরা মিছিল করে দুর থেকে আসতো কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে পুড়ে সমাবেশ সফল করে। তাই তাদের একটু পরশ দেয়ার জন্য নিয়ে আসতেন ঠোংগায় ভরে নুন দিয়ে আদার মিশ্রন। কেউ চাইলেই এক বা দুই টুকরো দিতেন, অমৃত লাগতো। শেখ হাসিনা নিজেও আদা চাচার আদা চেয়ে খেতেন। সেই আদা চাচাকে ও গ্রেনেডে স্প্রিন্টার খুজে নিলো। আদা চাচা নেই। আসলে কত জনই তো নেই। রিজিয়া, হাসিনা , সুফিয়া , মোহাম্মদ হানিফ, নাসিরউদ্দিন, লিটন , বিল্লাল, মোতালেব, আমিনুল , কুদ্দুস কার কথা বলবো !!

রাজনৈতিক মোকাবেলায় দেউলিয়া হয়ে গ্রেনেডের রাজনীতি চলতেই থাকে……..

আমার সুস্পষ্ট দাবী, বুক ফাটা আর্তনাদ, আমি এর বিচার চাই, যত উপরেই থাকুক যেই থাকুক আমি এই বীভৎস নারকীয় হত্যার বিচার চাই।