জাবি উপাচার্যের দুই বছর: শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য আসলেও সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ ও দুর্নীতিতে ১ম

দ্বিতীয় জীবন
Published : 8 May 2011, 05:13 PM
Updated : 8 May 2011, 05:13 PM

গত ২৪ ফেব্রুয়ারী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দুই বছর সময় পূর্ণ হয়েছে অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবিরের। গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটলেও ক্ষমতার চুড়ান্ত অপব্যবহার করে, দলীয়করণ ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ, ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণ, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অঞ্চলভিত্তিক একটি বিশেষ পক্ষকে নগ্নভাবে সমর্থন এবং শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের অভিযোগ রয়েছে তার নামে।

দুই বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য এবং আবাসিক সমস্যার সমাধান:
২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর সন্ত্রাস ও সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার ঘোষনা দেন। গত ২ বছরে প্রশাসনের উল্লেখ্যযোগ্য অর্জন ছিল সেশনজট কমানো, পুরনো ভর্তি পরীক্ষার (লিখিত পরীক্ষা) বদলে ইউনিট ভিত্তিক এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহন এবং ¯^í সময়ে ফলাফল প্রকাশ। এছাড়া আইবিএ এবং আই আই টি ইন্সটিটিউট সহ বানিজ্য অনুষদের অধীনে চারটি বিভাগ ও জীব বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু হয়েছে এ দুই বছরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য শহীদ রফিক-জব্বার হল নির্মান করা হয়েছে এবং ছাত্রীদের জন্য শেখ হাসিনা হল নির্মানের প্রস্তুতি চলছে।গত ৩০ মে ২০০৯ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের বিশেষ সভায় 'ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে সরকার এই গবেষণা কেন্দ্রের জন্য ১০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও নতুন প্রশাসনিক ভবন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মুল প্রবেশদ্বার নির্মাণ ছিল বর্তমান প্রশাসনের উল্লেখ্যযোগ্য অবদান। তবে একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল ও পিএইচডির ভর্তি ফিও কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতা:
গত ২ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে প্রায় ১৪০জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ¯^í সময়ে এতো বেশি সংখ্যক শিক্ষক এর আগে কখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি।তবে এ ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে যে, মেধার অবমূল্যায়ন, দলীয়করণ ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে এসব শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ।

দুই বছরে উপাচার্য নির্বাচন হয়নি:
বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ উপাচার্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালের ২০ মার্চ। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান।তিনি ২০০৮ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্বে বহাল ছিলেন। এরপর গত ৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোন নির্বাচিত উপাচার্য আসেননি।বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট অনুসারে প্রতি ৪ বছর পর পর উপাচার্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির দলীয় ভিত্তিতে দায়িত্ব গ্রহন করার পর গত দুই বছরে উপাচার্য নির্বাচন না দেয়াকে অন্যতম ব্যর্থতা হিসেবে দাবি করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

মুক্তমঞ্চে হামলা:
গত ২৬ জানুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আলদ্বীন মুক্তমঞ্চে হামলা করে ছাত্রলীগের প্রশাসনের মদদ পুষ্ট একাংশের নেতাকর্মীরা।এ ঘটনায় ৫ ছাত্রলীগ কর্মীকে ৩ মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হলেও বহিষ্কৃতরা নির্ভয়ে ক্যাম্পসে অবস্থান করছে বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন সমুহের কর্মীরা।

লোড শেডিং এবং প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণ:
গত দু্ই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোডসেডিং বৃদ্ধি এবং খাদ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পেলেও এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরব ভুমিকা পালন করেছে বলে অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী।বিভিন্ন ছুটি চলাকালীন সময়ে সৌন্দর্য বর্ধনের অজুহাতে ক্যাম্পাসের প্রায় শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া অসময়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জলাধারে অপরিকল্পিত ভাবে মাছ চাষ করার কারনে ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ফলস্বরূপ এ বছর শীতে ক্যাম্পাসের অন্যতম আকর্ষন অতিথি পাখি আসতে অনেক দেরি করে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক- শিক্ষার্থী।

একটি বিশেষ পক্ষকে সমর্থন এবং শতাধিক বহিস্কার:
সরকার সমর্থক ছাত্র সংঠন ছাত্রলীগের একটি পক্ষকে বারবার নগ্ন ভাবে সমর্থন দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচর্যের বিরুদ্ধে।এছাড়া, গত ২ বছরে সহিংসতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করা হয়। বহিষ্কারের তালিকায় রয়েছে ছাত্রলীগ জাবি শাখার বর্তমান সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন, সাধারন সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য, সাবেক যুগ্ন-সম্পাদক জাহিদ পারভেদ খান পুলক, মনোজ মন্ডল জয়, ছাত্রদল জাবি শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক গালিব ইমতিয়াজ নাহিদ, ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সহ-সভাপতি মাহী মাহফুজ প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসকল শিক্ষার্থী উপাচার্যের বিরুদ্ধাচারণ করেছে শুধু মাত্র তাদেরই বহিস্কার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী। ২০১০ সালের ১৯ মে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার ৫ দিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাওলানা ভাসানী হলে ছাত্রলীগের নব নিযুক্ত সহ-সভাপতি রাশেদ রেজা ডিকেনের উপর অতর্কিত হামলা চালায় উপাচার্য 'মদদ পুষ্ট' ছাত্রলীগ যুগ্ন-সম্পাদক আজগর আলী।এ সময় ডিকেন সহ ৮ ছাত্রলীগ কর্মী গুরুতর আহত হলেও এ বিষয়ে প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ করে হামলায় আহত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।একই বছর ৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আলবেরুনী হলে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন, সাধারন সম্পাদক নির্ঝর আলম সাম্য সহ ২৩ ছাত্রলীগ কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। তবে বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দাবি করে বলেন, কমিটি স্থগিত করে প্রশাসন মদদপুষ্ট ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত করতে উপাচার্য নিজে নির্দেশ দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতারা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের রোষানলে পড়ে এবং ক্যাম্পাসে নিরাপত্তার অভাবে প্রায় দেড় শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী বর্তমানে ক্যাম্পাসের বাহিরে অবস্থান করায় তাদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতামত:
এ সকল বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনু মোহাম্মদ বলেন, শিক্ষক নিয়োগে, যৌন নিপীড়ক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা গ্রহনে শৈথিল্য, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং মুক্তমঞ্চের উপর সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের হামলা উপাচার্যের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী পন্থী শিক্ষক এবং পরিসংখ্যান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. এম এ মতিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য সময়ের চেয়ে এ দু বছরে সবচেয়ে বেশি দূর্নীতি হয়েছে।তিনি আরো বলেন, ২ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা উপাচার্য নির্বাচনের কোন প্রস্তুতি দেখিনি। তিনি বলেন, এছাড়া রাজনৈতিক কারনে ক্যাম্পাসের বাহিরে যে সকল শিক্ষার্থী অবস্থান করছে তাদের ফিরিয়ে আনারও কোন ব্যাবস্থা উপাচার্য করেননি। এসব বিবেচনা করলে খুব স্পষ্ট যে বিশ্ববিদ্যালয় ভালো নেই।

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতামত:
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ জাবি শাখার সভাপতি রাশেদুল ইসলাম শাফিন বলেন, উপাচার্য নিজ অঞ্চলের ছাত্রনেতাদের ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংঘর্ষ ঘটান এবং মুল ধারার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাস থেকে বহিস্কার করেন, ৫ জুলাইয়ের ঘটনা যার উৎকৃষ্ট উদাহরন।তিনি বলেন, উপাচার্যের পক্ষপাতের কারনে বর্তমানে মূলধারার ছাত্রলীগের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে নিরাপত্ত্বার অভাবে শিক্ষা জীবন সম্পন্ন করতে পারছে না।ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি রাশেদ রেজা ডিকেন বলেন, উপাচার্য মদদপুষ্টরা অপরাধ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কখনোই প্রশাসন কোন ব্যাবস্থা গ্রহন করে নি। ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে আসা ছাত্রনেতাদের মদদ দিয়ে উপাচার্য প্রমান করেছেন তিনি নিরপেক্ষ নন।এ বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিন প্রিন্স বলেন, গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও সাংস্কৃতিক এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।তিনি বলেন, ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণ, শিক্ষক নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হতে পারে। ক্যাম্পাস থেকে সন্ত্রাস নির্মূলে তিনি সম্পূর্ন ব্যর্থ।

উপাচার্যের বক্তব্য:
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির বলেন, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ঘটনার তদন্তপূর্বক দায়ীদের বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। শিক্ষক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে নিয়োগ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। তিনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধুমাত্র শিক্ষা, গবেষণা ও ভৌত অবকাঠামোগত কর্মকাণ্ডই নয়, ক্যাম্পাসের পরিবেশ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও তিনি কাজ করেছেন। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত সহ জলাশয়গুলো পুন:খনন করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারা রোপন করা হয়েছে।