হাতি-মানুষের সংঘাত ও আমাদের জনঘনত্ব

সুরেশ কুমার দাশসুরেশ কুমার দাশ
Published : 17 Feb 2012, 01:56 PM
Updated : 10 Dec 2021, 06:14 PM

দক্ষিণ চট্টগ্রামে হাতি ও মানুষের সংঘাত দিনে দিনে বাড়ছে। থানা-পুলিশ পর্যন্ত হচ্ছে। হচ্ছে জেল-জরিমানাও। আবার ক্ষতিপূরণও দেয়া হচ্ছে। হাতি হত্যা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতেও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। থানা পুলিশ হওয়া, জেল জরিমানা সচেতনতার অংশ। তবে একইধরনের সচেতনতা বাংলাদেশে জন্মহার নিয়ন্ত্রণে হলে সব দিক থেকে ভালো হতো। কারণ, জনঘনত্ব না কমলে হাতি ও মানুষের সংঘাত দিন দিন আরো বাড়বে। কয়েক বছরে হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু ও হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। আর নভেম্বর মাস এলেই হাতির সাথে সংঘাত বেশি হচ্ছে মানুষের। হাতি লোকালয়ে নেমে এসে খাদ্যের জন্য ছুটছে দিকবিদিক। এরা আগে মাঠের ধান খেত, পছন্দের ফসল খেয়ে সাবাড় করত। এখন গোলার ধান লুট করার মতো– গেরস্থের গোলা ভেঙ্গে ধান খাচ্ছে। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনায় থানায় জিডি করেছেন বোয়ালখালীর এক কৃষক। হাতির এমন বন্যতায় দিশেহারা কৃষক ও এলাকার মানুষের হাতে নির্মমভাবে মারা পড়ছে হাতি। বাঁশখালীতে বৈদ্যুতিক ফাঁদে হাতি মারা হয়েছে কয়েকদিন আগে। ২০১৯ সালেও বাঁশখালীতে বিষ খাইয়ে হাতি হত্যা করা হয়েছিল। গত এক মাসে বাঁশখালীতে দুটি হাতির মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে গত এক মাসে পাঁচটি হাতির মৃত্যু হয়েছে। শেরপুরে নভেম্বরে দুটি হাতি মারা গিয়েছে। এভাবে গত এক মাসে দেশে অন্তত ৯টি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে– যেখানে কৃষকরা ফসল রক্ষা করতে গিয়ে নানা কৌশলে হাতি হত্যা করছেন। এভাবে গত এক বছরে দেশে ৩১টি হাতি মারা গিয়েছে। এর আগের বছর মারা গিয়েছিল ১৮টি। যেখানে দেশে মোট হাতি দুই-আড়াইশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেরপুরে গত ২৭ বছরে ৩১টি হাতির মৃত্যুর পাশাপাশি ৫৮ জন মানুষও মারা গিয়েছে। বৈদ্যুতিক ফাঁদে, গুলিতে ও ধারাল অস্ত্রের আঘাতে হাতিগুলোর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশে দু'একটি হাতি বার্ধক্য ও অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেলেও বেশিরভাগ হাতি মারা পড়ছে মানুষের হাতে।

২০১৯-২০ সালে হাতির আক্রমণে মারা গিয়েছে ৩৫ জন। আহত হয়েছে ১৭ জন। হাতির আক্রমণে ১৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। বাড়িঘর, গাছপালা, ফসলের ক্ষতি সাধনের ঘটনা ঘটছে। এর বেশির ভাগ হচ্ছে– পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, শেরপুর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে।

৩৩টি পরিবেশবাদী সংগঠন জোট বেধে সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বনভবনের ফটকে হাতি হত্যার বিচারের দাবিতে অবস্থান নিয়েছিল। হাতির মৃত্যুতে মূলত বনবিভাগও শঙ্কিত। তাদের পর্যবেক্ষণগুলো উন্নয়ন কার্যক্রমের দিকে আঙ্গুল তুলছে। বনভূমি ধ্বংস করেই যদি উন্নয়নের নতুন নতুন পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয় তাহলে হাতি নয় তা সমস্ত প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে ছলনা করার মতো। কিংবা পরিবেশ বিষয়ে অজ্ঞতা কিংবা পরিবেশের বিরুদ্ধে শত্রুতার নামান্তর।

কক্সবাজার থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত এশিয়ান হাতির আন্তর্জাতিক চলাচলের পথ। সেই পথের বিভিন্ন অংশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে ঘুনধুমে রেলপথের কাজ হচ্ছে। বন্যহাতির চলাচলের পথের ওপর দিয়ে যাচ্ছে এই রেলপথ। চুনতি, ফাঁসিয়াখালী, মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে। এই প্রকল্পে অন্তত হাতি পারাপারের ২১টি পথ রয়েছে। মাত্র প্রকল্পের কাজ চলছে। কাজ শেষ হবার পর রেললাইন চালু হলে প্রাণ-পরিবেশ ও হাতির কী পরিস্থিতি হবে? সরকার এসডিজি স্বাক্ষরে বনভূমি ধ্বংস না করার অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু বনভূমি আর বনের পরিবেশ ধ্বংস করেও কি এসডিজি অর্জন করা সম্ভব? এসডিজির শর্তের সাথে আমাদের বাস্তবতার সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। এসডিজির সাথে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় করা দরকার।

এটাও সত্য পার্বত্য যেসব এলাকায় হাতি মারা পড়ছে সেসব এলাকায় এক সময় বাঘ-ভালুকও ছিল। কিন্তু আজ বাঘ-ভালুক না থাকলেও আমরা আছি। উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। আর বাঘ-ভালুকের কথা ভুলেই গিয়েছি। হয়ত একদিন এসডিজিও পূরণ হবে সেদিন হাতির কথা ভুলে যাব। এই প্রসঙ্গে বলি, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত বনাঞ্চলে বেঙ্গল টাইগার ছাড়ার সরকারি চিন্তাভাবনা বিষয়ক বিবিসির এক রিপোর্টের মন্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাঘ গবেষক মনিরুল এইচ খান বলেছেন, 'পার্বত্য অঞ্চলে বাঘের উপস্থিতি আছে সেখানে এমন প্রমাণ আছে।' আর স্থানীয় মানুষেরা কয়েক যুগ আগেও সেখানে বাঘ দেখার কথা বলেন। তাহলে পার্বত্য এলাকার বাঘ-ভালুক অদৃশ্য হবার কারণ খুঁজি না কেন আমরা। সব হাতি হত্যার পরও বাংলাদেশের হাতি নেই কেন– এটা নিয়ে ভবিষ্যতে আর কেউ প্রশ্ন করবে না। যেমন আজ পার্বত্য এলাকায় বাঘ-ভালুক নেই কেন, সেই প্রশ্ন কেউ করে না। কারণ ৩১টি হাতি মারতে যদি ১ বছর লাগে তাহলে শ তিনেক হাতি মারতে মাত্র ১০ বছর লাগবে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খানের কথাকে একটু ভিন্ন মাত্রা দিয়ে বলি, ইঁদুর, টিকটিকি, তেলাপোকা কেন হারিয়ে যাচ্ছে সেই নিয়ে হাহুতাশ করতে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের ১০০ বছরও লাগবে না।

কক্সবাজারের যে এলাকায় হাতির বিচরণ এলাকা সেখানে গড়া হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তারা শুধু বসত করছে তা নয় পার্শ্ববর্তী হাতির আবাসস্থল, বনজঙ্গল, খাদ্যের উৎপাদন স্থান ব্যাপকভাবে ধ্বংস করছে। হাতির চলাচল ব্যাহত করা হয়েছে। ২০১৯ সালে হাতির সাথে সংঘাতে ১৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে– এত জন মানুষ মারা যাবার মতো সংঘাত কোনো ছোটখাট ঘটনা নয়। এতে বোঝা যায় পরিস্থিতি কত ভয়াবহ।

রোহিঙ্গাদের কথা না বলে যদি আমাদের কথাই বলি। শরণার্থী রোহিঙ্গারা যেমন কম জায়গায় অনেক লোক বাস করছে তেমনি পৃথিবীর সপ্তম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। বৈশ্বিক দৃষ্টিতে তাই আমরাও দুর্বিসহ দূষণ ও দুর্যোগের মধ্যে বাস করছি। বাংলাদেশের বন-জঙ্গল, সাগর-নদী এমন কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা নেই হয়ত যেখানে মানুষের পা পড়েনি বা মানুষের বিচরণ নেই। তাহলে বন্যপ্রাণীর জন্য নিরুপদ্রব-নিরাপদ জায়গা কোথায়? তারপরও বন্যপ্রাণী কমলেও সংঘাত বাড়ছেই। কারণ মানুষ বন্যপ্রাণীর খাদ্য, বসবাস ও তাদের চলাচলের পথ আরও আরও ভাগ বসাতে চায়। আফ্রিকার মতো সবচেয়ে কম জনঘনত্বের দেশেও মানুষের সাথে বন্যপ্রাণীর সংঘাত হয়। সেই এত কম জনঘনত্বের দেশের চেয়ে আমাদের উদ্বেগটা অনেকগুণ বেশি হবার কথাই।

যদিও বনবিভাগ হাতি বাঁচাতে সব পন্থাই অবলম্বন করছে। বৈজ্ঞানিক পন্থা থেকে শুরু ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সচেতনতা কার্যক্রম সবই। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কোনো সুরাহা না হলে অন্যান্য গৃহীত ব্যবস্থাগুলো থেকে বিরূপ ফলও আসতে পারে।

উন্নয়ন, কৃষি, আবাসন বাড়ছে কেন, জনসংখ্যা বাড়ছে বলেই। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২০০ জন মানুষের বাস। এটা সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি। সেখান ভারতে ৩৪৬ ও চীনে ১৪২ জন। দেশে প্রতি মিনিটে ৪.২টি শিশু জন্ম নিচ্ছে। এই হিসাবে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ৪৭৯ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এটা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ২০১৫ সালের তথ্য। লাগামছাড়া জন্মহার যেমন আমাদের কাছে মানুষের প্রাণকে মূল্যহীন করে তুলছে, তেমনি হাতির জন্য মায়াকান্না করে হাতিকেও রক্ষা করতে পারছি না। এজন্য দেশের মানুষের জন্মহারে লাগাম টানতে হবে। তাহলে হাতির জন্য, প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছি বলে মনে হবে না। এসব বিষয় যদি পরিবেশ আন্দোলনকারীরা বিবেচনায় না আনে তাহলে বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন থেকে কোনো সুফল আসবে না। পরিবেশ ইস্যু কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নয়, রাজনৈতিক আন্দোলনও নয়।

আইসিইউএন ও অন্যান্য সকল বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদেরই এক কথা– জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নয়ন আর কৃষির বিস্তৃতি, শিল্পায়ন, সম্প্রসারিত আবাসন হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলেছে আর অনেক বন্যপ্রাণীর অস্তিত্বই নেই। তাই আমাদের অধিক জনসংখ্যার সকল বিষ-বর্জ্য-দূষণ হজম করতে হচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতিকে। হাতি প্রতিআক্রমণ করছে বলে আমাদের চোখে বেশি লাগছে। কিন্তু এর বাইরে শত-সহস্র প্রাণ ও উদ্ভিদ প্রজাতি আমরা ধ্বংস করেছি, হয়তো যাদের প্রতিআক্রমণের শক্তি ছিল না।

হাতি চলাচলের ২১টি গমনপথের ওপর দিয়ে রেললাইন যাওয়ার প্রকল্প যখন পাশ হয় সেসময় পরিবেশ অধিদপ্তর কোথায় ছিল? তাদের দায়িত্ব কী ছিল? আর পরিবেশবাদীদের ঘটনা ঘটার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ মৃত হাতি আর মৃত মানুষকে তো বাঁচানো যাবে না। প্রকৃতিকেও পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।

হাতি তুলনামূলকভাবে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী এবং শক্তিমানও। হাতি বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছে কিনা বুঝতে হবে। মানুষ যেমন বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য ঘাটতি মেটাতে প্রাকৃতিক পরিবেশে হামলে পড়ছে, তেমনি বন্যপ্রাণীও তাদের খাদ্য সঙ্কট ঘোচাতে মানুষের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে। আপাত অর্থে মনে হচ্ছে মানুষের খাদ্যে ভাগ বসাচ্ছে। নাকি তারা পৃথিবীতে বসবাসের অধিকারের বিষয়টা জানান দিচ্ছে। নাকি মানুষ ও প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান চাইছে? ভারতে কিছু পর্যবেক্ষণে হাতি নিয়মিত মানুষের বসতিতে এসে খেয়েদেয়ে ঘুরেফিরে আবার নিজেদের বসতিতে ফিরে যেতে দেখা যাচ্ছে। এসব আচরণ কি ইঙ্গিত করছে তা দেখতে হবে। সেজন্য আমাদের আদি ব্যাধবৃত্তি মানসের পরিবর্তন করতে হবে।