করোনাভাইরাস পরবর্তী অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে হবে নতুন করে

সায়মা হক বিদিশা
Published : 11 Jan 2012, 02:47 PM
Updated : 7 April 2020, 01:49 PM

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর কারণে সারা পৃথিবীতে ৪ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হতে পারে যা বৈশ্বিক জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। তাই আমাদের মত নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের ক্ষেত্রে বাজেট তথা অর্থ-বরাদ্দ, সংস্কার প্রক্রিয়া, নীতি সহায়তার মত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন যা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও আশাব্যঞ্জক।

স্বল্পমেয়াদে ঝুকিপূর্ণ খাত ও স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য সহায়তা ও প্রণোদনার যেমন কোন বিকল্প নেই, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে এখন থেকেই। প্রথমত, স্বাস্থ্যখাতকে অবহেলা করার কোনও সুযোগ এখন আর নেই- স্বল্পোন্নত দেশগুলোও যখন তাদের জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশেরও বেশি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে তখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হার ১ শতাংশেরও কম। ব্যক্তিগতভাবে খরচের (নিজ পকেট খরচ) দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ রাষ্ট্রগুলোর একটি- দেশের স্বাস্থ্য খরচের ৬৭ শতাংশ ব্যক্তি নিজেই বহন করে, যেখানে এই হার পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ৫৬, ভারতের ক্ষেত্রে ৬২, নেপালের ক্ষেত্রে ৪৭ এবং ভুটানের ক্ষেত্রে মাত্র ২৫ শতাংশ। 

আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সাথে সাথে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন, ব্যক্তিখাতের সেবার মানের পরিবীক্ষণসহ প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবার আওতা বাড়াতে হবে

 বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন আর এক্ষেত্রে  সরকারের জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম (এনএসএসএস) অতি দ্রত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হব। এই নীতিমালার আওতায় কম সংখ্যক কার্যক্রমের মাধ্যমে সুরক্ষা কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান ও সামাজিক বীমা কর্মসূচিকেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে যা কিনা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পেনসন এবং স্কুল স্টাইপেন্ড কর্মসূচি বাদ দিলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের পরিমাণ জাতীয় আয়ের (২০১৮-১৯) মাত্র ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ যা কিনা আমাদের সার্বিক চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। আর করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে প্রান্তিক মানুষের অবস্থা বিবেচনা করে এই বরাদ্দের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে এই বাজেট (২০২০-২১) থেকেই।

তবে মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সাফল্য মূলত নির্ভর করে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর- জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে তাই পুরো কার্যক্রমকে সমন্বিত করা প্রয়োজন। (এই প্রক্রিয়া অনেক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ এর বাজেট থেকে শুরু হয়েছে)।

সামষ্টিক অর্থনীতির প্রেক্ষিতে সবচাইতে বড় আঘাত আসার সম্ভাবনা তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাত আর রেমিটেন্সের প্রবাহের ওপর। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল যাতে কেবল শ্রমিকদের বেতন ও কল্যাণ বাবদ ব্যয় হয় সেবিষয়ে নিবিড় পরিবীক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দা আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয় রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা- তাই পরবর্তী বাজেটে হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ শিল্পসহ নতুন শিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রণোদনার ব্যাপারে নীতিসহায়তা বাঞ্ছনীয়। ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ফেরত প্রবাসী যারা কাজ হারাতে পারেন তাদের জন্য প্রশিক্ষণ, স্বল্পসুদে বিশেষ আর্থিক সহায়তার মত প্রণোদনার কথাও ভাবতে হবে

 রপ্তানিমুখী বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি ২০২০-২১ সালের বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে। স্বল্পমেয়াদে প্রণোদনা ছাড়াও স্বল্প সূদে ঋণ, ঋণ পুন: তফসিলিকরণ, কাঁচামালের উপর শুল্ক মওকুফের মত নীতি সহায়তার মাধ্যমে এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরকে সহায়তা দেয়া যেতে পারে। আশার কথা হচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা কাঠামোতে এবিষয়ে বিশেষ প্যাকেজের ঘোষণা দেয়া হয়েছে যা এধরনের শিল্পের সাথে জড়িতদের জন্য সহায়ক হবে। শিল্প আর সেবাখাত ছাড়াও কৃষিখাতে চাহিদা সংকটের কারণে কৃষকদের জন্যও বিশেষ প্রণোদনার বিষয়টিও আগামী বাজেটে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

তবে ব্যষ্টিক অর্থনীতির বিবেচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ৮৫ শতাংশ শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যাপারে। রিকশাচালক, গৃহ-সহায়িকা, মুদি দোকানদার, ক্ষুদ্র ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীসহ বিশাল এক জনগোষ্ঠী অন্তত সাময়িকভাবে কাজ হারাতে পারে যাদেরকে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে দ্রুত আনা প্রয়োজন। এছাড়া শহরের বস্তিগুলোতে নিয়মিতভাবে বিনামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিতরণ, বাড়ি ভাড়া মওকুফ ছাড়াও স্বল্পমূল্যে বড় পরিধিতে রেশন ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বর্তমানে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছাড়াও দারিদ্রসীমার ওপরের ও করোনাভাইরাস-পূর্ববর্তী সময়ে দরিদ্র নন- এমন জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ সংক্রমণ পরবর্তীতে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাবার আশঙ্কা রয়েছে

ত্রাণ ও দুর্যোগ, সামাজিক সুরক্ষা, শিল্প আর স্বাস্থ্যখাতের এই অতিরিক্ত ব্যয় বহনের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ অর্থের। উন্নয়ন সহযোগীদের আর্থিক সহায়তার বাইরেও দরকার হবে আভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। মাত্র ১০ শতাংশ রাজস্ব- জাতীয় আয়ের অনুপাতের দেশে কর-কাঠামো, বিশেষ করে ব্যক্তিখাতে আয়করের আওতায় ব্যাপক পরিবর্তনের সংস্কার কর্মসূচি নিতে হবে আর তা করতে হবে এই বাজেট থেকেই করোনাভাইরাসের আর্থিক ছোবল থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে হলে তাই বাজেট ও কর্ম-পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে- সামাজিক অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দেবার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নই হোক করোনাভাইরাস পরবর্তী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য