বজ্রপাত, তালগাছ , বিজ্ঞান, ধর্ম ও গবেষণা

ড. কাজী আব্দুল মান্নান
Published : 21 May 2017, 00:26 AM
Updated : 21 May 2017, 00:26 AM

বাংলাদেশসহ বিশ্বে একযোগে চার হাজার বজ্রপাত ইত্তেফাকের প্রবন্ধটি ও সরকারের দশ লক্ষ তালগাছ লাগানোর পৰিকল্পনায় আজকের এই লিখাটি। আমার মনে হয় বজ্রপাত সম্পর্কে আজকের দিন পর্যন্ত বিজ্ঞান তাকে তার বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। এমন কি আমরা সবাই জানি আবহাওয়া এখনও বিজ্ঞান না, এটা বিদ্যা। আবহাওয়া বিজ্ঞান হবে ঠিক সেদিন যেদিন তারা বলতে পারবে সবকিছু সুনিদৃষ্ট বিজ্ঞানসম্মত ভাবে। যেমন ছোট্ট একটা উদাহরণ, বৃষ্টি ঠিক কখন, কতটুকু জায়গায়, কত সময়, কত সেন্টিমিটার ইত্যাদি। আবহাওয়া বিদ্যা বৃষ্টির মতো একটা সহজ জিনিসকেই বিজ্ঞান বানাতে পারেনি, আর বজ্রপাততো ধরাছোয়ার অনেক দূরে। বৃষ্টি যেদিন বিজ্ঞান (যদি) হবে, সেদিন দুনিয়া আর থাকবে না। এখানেই আমাদের বিরাট অজ্ঞতা রয়েছে এবং দিন দিন বাড়ছে। যাক সেদিক নিয়ে আর নয়, যতটুকু জানি বজ্রপাত নিয়ে:

সংস্কৃতি ও কিছু ধর্ম (ইসলাম ব্যতীত)

বহু সংস্কৃতির বহুধর্মী লোকেরা একটি বজ্রধ্বনি দেবতা, বজ্রপাত এবং বিদ্যুতের বাহিনীর মূর্তি বা উত্সের বর্ণনা দিয়েছেন; একটি বাজ ঈশ্বর একটি আদর্শ চিত্রণ নেই, এবং সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হবে। ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে, বজ্রধ্বনি দেবতা প্রায়শ দেবতার প্রধান বা রাজা হিসাবে পরিচিত, উদাহরণস্বরূপ, হিন্দুধর্মের ইন্দের, গ্রিক পুরাণে জিউস, এবং প্রাচীন স্লাভিক ধর্মে পেরুন; বা তার নিকটবর্তী সম্পর্ক, যেমন নর্স পুরাণে ওডিনের পুত্র থোর। ইয়োরাবিয়া ধর্ম এবং আফ্রিকান ডায়াস্পোরার সমকক্ষ ধর্মসম্পাদনা যেমন সান্তেরিয়া (কিউবা, পুয়ের্তো রিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যান্ডম্বলে (ব্রাজিল) এও এটি সত্য। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে, ইলীয়ান ক্ষেত্রগুলি, বা ইলাসিয়ান প্লেইন, বীরত্বপূর্ণ এবং ধার্মিকদের আত্মার চূড়ান্ত বিশ্রামস্থল স্থান, বাজ, এনিয়িসিয়ন, এনিয়িসিয়াস দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত একটি স্থান বা ব্যক্তির একটি পদ থেকে উদ্ভূত। এটি বাজ/জুপিটারের জিউসের একটি রেফারেন্স হতে পারে, তাই "বাজ আঘাতপ্রাপ্ত" বলছে যে ব্যক্তিটি জিউসের (আতশবাজি/সৌভাগ্য) দ্বারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক কারণ
চতুর্থ শতাব্দীর খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্লের প্রথম রেকর্ডকৃত তত্ত্বটি প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে এটি মেঘের সংঘর্ষের কারণে ঘটেছিল। পরবর্তীকালে, অনেক অন্যান্য তত্ত্ব প্রস্তাবিত ছিল। ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, গ্রহণযোগ্য তত্ত্বটি ছিল যে বাজ একটি ভ্যাকুয়াম তৈরি করে। বিংশ শতাব্দীতে বায়ুমন্ডল চক্রের মধ্যে আকস্মিক তাপীয় সম্প্রসারণের কারণে বজ্রধ্বনি একটি শক ওয়েভ দিয়ে শুরু হয়। ঘূর্ণায়মান বজ্রধ্বনি ফলাফল যখন মেঘ এবং স্থল ঘূর্ণায়মান একটি তাপমাত্রা বিপর্যয়ের সময় ঘটতে। যেমন একটি বিপর্যয় মধ্যে, স্থল কাছাকাছি বায়ু উচ্চ বায়ু তুলনায় শীতল। শব্দ শক্তি উল্লম্বভাবে dispersing থেকে বাধা হিসাবে এটি একটি অ-বিপরীত এবং এভাবে ঘনিষ্ঠ – স্থল স্তর মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা হয়। বক্রতা প্রায়ই দেখা দেয় যখন উষ্ণ আর্দ্র বাতাস একটি ঠান্ডা ফ্রন্টের উপরে যায়; ফলে বজ্রধ্বনি শব্দটি উল্লেখযোগ্যভাবে জোরে জোরালো হতে পারে যদি অ-বিপর্যয় অবস্থাতে একই দূরত্বের মধ্যে শোনা যায়।

বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী 'সায়েন্স' জানায়, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ডেভিড রম্প ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০০০ সালে যেখানে বছরের একটি নির্ধারিত সময়ে দুইবার বজ্রপাত রেকর্ড করা হয়েছে, সেখানে এখন ওই একই সময়ে তিনবার বজ্রপাত হচ্ছে। তার হিসেবে তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের হার বাড়ে ১২ শতাংশ। জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, অত্যধিক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার, গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধির কারণে গোটা বিশ্বেই বজ্রপাত বাড়ছে। অধ্যাপক রম্প মনে করেন, উল্লিখিত কারণে ভূ-মণ্ডলে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। এই গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ওজোন স্তর এবং মিথেনের মতো ক্ষতিকর গ্যাসও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তখন বজ্রপাতের হার কমতে পারে। রম্প আরো বলেন, একবিংশ শতাব্দীর শেষে ধরিত্রীর তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে বজ্রপাতের হার আরো বাড়তে পারে।

দূরত্ব গণনা
বজ্রধ্বনির কিছু সময়ের পরে বাজ, একটি ফ্ল্যাশ দেখায় যে শব্দ আলো তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর ভ্রমণ এই পার্থক্যটি ব্যবহার করে, কেউ হয়তো পূর্বাভাস দিতে পারে যে বিদ্যুতের বাটনটি ফ্ল্যাশ ও শ্রবণের বজ্রধ্বনি দেখতে সময় ব্যবধানের কতটুকু দূরে। শুষ্ক বায়ুতে শব্দটির গতি প্রায় ৩৪৩ মিটার/১২৭ফুট/সেকেন্ড বা ৭৬৮ মাইল (১২৩৬কিমি/ঘণ্টা) ২0 ° সে (৬৮ ° ফু)হয়। আলোর গতি যথেষ্ট উচ্চ যে এই তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট দূরত্ব এই গণনা হিসাবে অসীম হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। অতএব, দৃশ্যমান ফ্ল্যাশ এবং বজ্রধ্বনি (বা প্রতি ৫ সেকেন্ডের জন্য এক মাইল) এর প্রথম শব্দের মধ্যবর্তী সময়ে প্রতিটি ৩ সেকেন্ডের জন্য বাজ প্রায় এক কিলোমিটার দূরবর্তী। একই পাঁচ সেকেন্ডে, আলোর চন্দ্র দূরত্ব চার বার ভ্রমণ করতে পারে। (এই গণনাতে, প্রাথমিক শক ওয়েভ, যা গতির গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে দ্রুত ভ্রমণ করে, কিন্তু প্রথম ৩0 ফুটের বাইরের দিকের দিকে অগ্রসর হয়, উপেক্ষা করা হয়)।

পবিত্র আল কোরআন যা বলে:
সূরা : বাকারা
(১৮) তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না। (১৯) আর তাদের উদাহরণ সেসব লোকের মত যারা দুর্যোগপূর্ণ ঝড়ো রাতে পথ চলে, যাতে থাকে আঁধার, গর্জন ও বিদ্যুৎচমক। মৃত্যুর ভয়ে গর্জনের সময় কানে আঙ্গুল দিয়ে রক্ষা পেতে চায়। অথচ সমস্ত কাফেরই আল্লাহ্ কর্তৃক পরিবেষ্ঠিত। (২০) বিদ্যুতালোকে যখন সামান্য আলোকিত হয়, তখন কিছুটা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। যদি আল্লাহ্ ইচছা করেন, তাহলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিতে পারেন। আল্লাহ্ যাবতীয় বিষয়ের উপর সর্বময় ক্ষমতাশীল। (২১) হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে।

সূরা : নিসা
(১৫৩) আপনার নিকট আহলে-কিতাবরা আবেদন জানায় যে, আপনি তাদের উপর আসমান থেকে লিখিত কিতাব অবতীর্ণ করিয়ে নিয়ে আসুন। বস্তুতঃ এরা মূসার কাছে এর চেয়েও বড় জিনিস চেয়েছে। বলেছে, একেবারে সামনাসামনিভাবে আমাদের আল্লাহকে দেখিয়ে দাও। অতএব, তাদের উপর বজ্রপাত হয়েছে তাদের পাপের দরুন; অতঃপর তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ-নিদর্শন প্রকাশিত হবার পরেও তারা গো-বৎসকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল; তাও আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম এবং আমি মূসাকে প্রকৃষ্ট প্রভাব দান করেছিলাম।

সূরা : রাদ
(১২) তিনিই তোমাদের সামনে বিজলী চমকান, যা দেখে তোমাদের মধ্যে আংশকার সঞ্চার হয় আবার আশাও জাগে। (১৩) তিনিই পানিভরা মেঘ উঠান। মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং ফেরেশতারা তাঁর ভয়ে কম্পিত হয়ে তাঁর তাস্‌বীহ করে। তিনি বজ্রপাত করেন এবং (অনেক সময়) তাকে যার ওপর চান, ঠিক সে যখন আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত তখনই নিক্ষেপ করেন। আসলে তাঁর কৌশল বড়ই জবরদস্ত।

পবিত্র কোরআন জ্ঞানীদের গভীর চিন্তা ও গবেষণা করা ফরজ করে দিয়েছে। একমাত্র আত্মা ছাড়া যে কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে কিছু না কিছু জ্ঞান দুনিয়াতে বৃদ্ধি পাবেই, তাই আমি সাধুবাদ জানাই যারা এ বিষয় গবেষণা করছেন। আমরা এমন ভাবেও চিন্তা ভাবনা করতে না পারি যে:

১. দুনিয়ার সমস্ত দূষিত পানি বাষ্প হয়ে আকাশে যায়, তা আবার বিশুদ্ধ ও উর্বর হয়ে মাটিতে ফিরে আসে। এই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ার একটি প্রকৃতিক অন্যতম শোধনাগার হিসাবে কাজ করছে;
২. বজ্রাশক্তিকে কোনোভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে কোন কাজে লাগানো যায় কিনা? যেমন আমরা সূর্য থেকে সৌর বিদ্যুৎ পাচ্ছি;
৩. প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যে আল্লাহ যে ধরণের একটা শাস্তির ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা খুব সহজে মেনে নেয়া;
৪. বাংলাদেশে যে পরিমান বজ্রপাত হয়েছে তা যদি তাল গাছ টেনে নিতে পারতো তবে শত বছরের তালগাছ থাকতো না, এমনকি একটি তালগাছও খুঁজে পাওয়া যেত না;
৫. দুনিয়ার সবজায়গায়ই কমবেশি বজ্রপাত হয়, কিন্তু সব দেশে তালগাছ হয় না; ইত্যাদি অনেক চিন্তা করতে পারি এবং যে যে বিষয় গবেষক সে তার সমস্যা নিয়ে গবেষণা করতে পারি।