ধর্মানুভূতি তত্ত্বের ভিত্তিতে খুনি ও সরকার যখন এক পক্ষ

আনোয়ার শাহাদাত
Published : 14 July 2021, 01:42 PM
Updated : 2 Nov 2015, 06:25 AM

একদিনে একই সময় দুই ভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে একই পদ্ধতিতে দুই প্রকাশককে হত্যার জন্য আক্রমণ। একজন নিহত, অন্যজন গুরুতর আহত। আহত প্রকাশক ও অন্যান্যরাও নিহত হলেন কিনা বা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেন বা যাবেন কিনা, সেটা যেমন আলোচ্য বিষয় নয়, আবার ভাগ্যালোচনাও আর নয়। নিশ্চিত পালা এসেছে বাস্তব আলোচনার।

পুলিশ বলেছে, দুই আক্রমণের ধরন ও অস্ত্রের ব্যবহার একই। তারপরও তারা নিশ্চিত নন 'মোটিফ' এক কিনা। কৌতুক মনে হতে পারে, কিন্তু পুলিশ তাই বলেছে। এর মোটিফ, আলামত, পেছনের কাহিনি ইত্যাদির জন্য আর কতটা অপেক্ষা করা দরকার? রাষ্ট্রের সবাই এর মোটিফ জানলেও যারা দায়িত্বে, অর্থাৎ সরকারি এজেন্সি, সেই পুলিশ বলে দিয়েছে, তাদের নাকি সেসব 'জানা নেই'। নাগরিকরা জানে– তা একেবারে তদন্ত, তথ্য, গোয়েন্দা, ফরেনসিক ছাড়াই– কোনো শিশুও বলে দিতে পারবে এই খুন সম্পর্কে।

এমনকি প্রধানমন্ত্রী যিনি এই মুহূর্তে জনগণ থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী, তিনিও তাঁর টিমের পূর্ব-ব্রিফিং ছাড়া বলে দিতে পারবার কথা যে, কী হচ্ছে বা হচ্ছেটা কী সে কথা। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত আগের তথ্যগুলো তাঁর জানা আছে। নিশ্চয়ই তিনি বলবেন না যে, তিনি জানেন না অভিজিত হত্যা এবং তার ধারাবাহিকতায় আরও চার-পাঁচ জনের হত্যার কথা। তাহলে আর অত পুলিশি ব্যাখ্যার জন্য আমরা থেমে রইছি কেন?

এই খুনের মোটিফ জানতে তথ্য হিসেবে এটুকুই যথেষ্ট যে, এরা দুজনই অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক। এখন কি এই অংক কষতে জাতির অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে? পরিশেষে 'রহস্যের অন্তরাল' শিরোনামে এক 'গল্পের লেজ' সামনে রেখে তারা দিনাতিপাত করবে? অথচ সারা দেশ ও জনগণ জানবে আসলে ঘটনা কী! একে বলা হয়ে থাকে 'লজ্জা' ('শেইম' শব্দটা যায় ভালো)। সেই 'লজ্জা'ও তা জনতার নয়, বরং যারা সেই জনতার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের, অর্থাৎ সেই সরকারের। সরকারের লজ্জা, সরকারি লজ্জা।

একটি শিশুও যদি বোঝে এবং প্রধানমন্ত্রীও যদি বোঝেন যে, এই হত্যা কী, তবে এর মধ্যে তো আর কোনো দূরত্ব নেই। তারপরও দূরত্ব রয়েছে। সে নিয়েই হয়তো ভবিষ্যৎ আলোচনা ও পথ খোঁজা।

সরকারকে যদি আহাজারি করতে হয়, 'ওই, গেল, গেল… রাজাকার বিচারের কারণে… সব গেল… জামায়াত-শিবির, বিএনপি, স্বাধীনতাবিরোধী ইত্যাদি সব… গেল… তা হরেদরে গেল'– এইসব 'গেল' কাহিনির সবটাই জনগণ জানে। যারা এই সরকারের পক্ষে এবং যারা এই সরকারের বিপক্ষে তারাও জানে। এর সব জানবার পরও তারা এই সরকারকে চায় এবং চেয়েছিল। ফলে জনগণ ওই 'দুঃখের বিলাপ'টি জানে, কিন্তু তারা এ-ও মনে করে, সরকারের কাজই হচ্ছে 'দুঃখের-ব্যর্থ-বিলাপ' না করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

ধরা যাক, অভিজিতের ঘটনার কথা। এই জাতীয় হত্যাকাণ্ডের প্রথম আলামতের প্রথম মাইলফলক আসলে, আমার ধারণা, তারও আগের– শাহবাগ আন্দোলনের সময়ের রাজীব হত্যাকাণ্ড। এরপর এ ধারায় হত্যাকাণ্ড চালানোটা তো ওই গোষ্ঠী এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত করেছে। অর্থাৎ একটা নির্ধারিত সময় পরপর তাদের একেক জনকে হত্যা করতে হবে এবং ঘটনা-উত্তর সরকার একটা ষড়যন্ত্রের বিলাপ-কাহিনি শুনিয়ে দেবে।

যেমন জনগণ তেমন সরকারও জানে, হত্যাগুলো কত পরিকল্পিত ও কীভাবে কী কারণে বাস্তবায়িত করা হয়। সরকারের সাধারণ সদস্যসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লোকজনের জানা আছে এবং আমি নিশ্চিত তারা উপলব্ধি করতে পারবেন পরিকল্পিত হত্যার বেদনা কী। হ্যাঁ, এই কথাটি বলতে চাইলাম যে, পরিকল্পিত হত্যার বেদনা কী তা আমরা জনতার চেয়ে বেশি কেউ আর জানে বলে মনে হয় না এখন।

খালেদা জিয়া লন্ডনে থেকে এই হত্যা ও আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই হাস্যকর অধিকাংশ মানুষের কাছে। কারণ তারা জানে, তাঁর দল ও সহযোগী দলগুলোর প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক যোগসাজশ রয়েছে ওই দলগুলোর সঙ্গে। আমার সন্দেহ জাগে, এবার খালেদার এই বিবৃতির মধ্যেও– যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভুক্তভোগী (আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশের অধিকাংশ জনসাধারণ মনে করে তারা এই ঘটনায় ভিকটিম, সামাজিক মাধ্যম বা পত্রপত্রিকার প্রতিক্রিয়া দেখে তা বুঝে নেওয়া যেতে পারে) তারা সান্ত্বনা খুঁজবেন– তা মিথ্যা হলেও।

এই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে নতুন করে সরকারকে ভাবতে হবে তাদের অবস্থান কী এবং কী হওয়া উচিত। একেবারে পরিষ্কার করে– যে পরিবারগুলো এই হত্যার শিকার তারাও হয়তো সামান্য হলেও একটু ভালো বোধ করবে খালেদা জিয়ার ওই বিবৃতিতে, যেখানে তিনি বলেছেন, 'সরকার জনতার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ…'। আর এটা সত্যি হলে তা সরকারের জন্য শুভ নয় সেটা নিশ্চয়ই সরকারের বুঝবার ক্ষমতা রয়েছে।

এ যেন একেবারে স্থায়ী গীত যে, 'রাজাকারদের বিচার হচ্ছে বলে স্বাধীনতাবিরোধীরা এই এই…'। প্রশ্ন: সরকার কি এটা আগে জানত না? যদি না জেনে থাকে তবে তা তাদের ব্যর্থতা ও দুর্বলতা হিসেবে ধরে নিতে হবে। কথা হল, সরকারের সে কথা আগেই জানা উচিত এবং নিশ্চিত করা উচিত যে জনগণের সমর্থন নিয়ে তারা ক্ষমতায় এবং যাদের ইচ্ছায় একটি বিচার করবার উদ্যোগ তাদের নিরাপত্তা দেওয়া। সে বিচার ব্যাহত করতে যদি তার জনসাধারণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তা যাতে না হতে পারে সরকার সে ব্যবস্থাই করবে। সেটাই জনগণের সাধারণ প্রত্যাশা। আর পরিস্থিতি নিশ্চিত না করতে পারলে সরকারের সে ধরনের কাজে যাওয়া উচিত নয়।

বুদ্ধিজীবী (এরা বুদ্ধিজীবী, হয়তো খ্যাতিমান নয়) হত্যার সংখ্যা এমন দাঁড়িয়েছে যা এখন যত রাজাকারের বিচার হয়েছে তার চেয়ে বেশি। এখন প্রশ্ন: যদি সরকার আগে জানতে চাইত এভাবে যে, রাজাকার হত্যার বিচার করতে গেলে এত সংখ্যার বুদ্ধিজীবীকে খুন হতে হবে (যা এখন বাস্তবে ঘটছে এবং সরকার বারবার তা বিলাপের মধ্যমে স্বীকার করে নিচ্ছে)– আমার ধারণা, তাহলে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিত জনতা তার বর্তমান নিরাপদ রাখতে। এখন রাজাকারের বিচার করতে গিয়ে জনগণের নিরাপত্তা তুলে নেওয়া হয়েছে। এটা একটা অবিচার।

সরকার সবচেয়ে যুক্তিহীন, স্পর্শকাতর জায়গাটায় নমনীয় এবং দ্বিধান্বিত অবস্থান নিয়েছে। সেটা যেমন তার জন্য, একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জন্য এবং সমগ্র জনসাধারণের জন্য বিপজ্জনক। এটা 'ধর্মীয় অনুভূতি'র নামে, যার বিপরীতে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। মৌলবাদী খুনিরা এটা চালু করতে চেয়েছে; সরকার একে মেনে নিয়েছে এবং একটা অঘোষিত প্রথা চালু করেছে। এই প্রথার আড়ালে একটি গোষ্ঠী আর একটি গোষ্ঠীকে 'নাস্তিক' আখ্যায়িত করে হত্যার গোপন অধিকার জন্মেছে বলে তা চর্চা করছে।

যেখানে এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জাতীয় মাওলানাদের দিয়ে ওই ধরনের উদ্যোগ 'বেধার্মিক' বলে প্রতিরোধ করা হচ্ছে বা আইন করা হচ্ছে, সেখানে বর্তমান সরকার শুরু থেকে এর পেছনে একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। এর ভয়াবহতা আশা করি সরকার অনুধাবন করতে সক্ষম হবে। ধর্মীয় অনুভূতি বলে কোনো অনুভূতি কেন থাকা উচিত নয়, পাশ্চাত্য সভ্যতা তা শত বছর আগে নিশ্চিত করেছে। কেননা এই অনুভূতির কোনো সীমারেখা বলে কিছু থাকে না। ফলে আইনে এই অনুভূতির অস্তিত্ব নেই। এ রকম একটা বাক্যে এটা খারিজ হয়ে যায়: "একজনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগায় আর একজনের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, এতে আর একজনের লেগেছে…'' (এই অযৌক্তিকতার কোনো শেষ নেই আসলে)।

হ্যাঁ, এটা সচেতন নাগরিকরা জানে যে, সরকারবিরোধী নেতারা– 'দুইটা-চাইরটা' লাশ চেয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে তারা লাশ পাচ্ছেও– কিন্তু কথা হচ্ছে, সেই লাশ পেতে সরকার কেন পরোক্ষ সমর্থন জানাচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতির নাম নিয়ে?

সরকারের লোকজনের একটু খোঁজখবর নেওয়া উচিত তারা কী বলে এবং তাদের বক্তব্যে কোথায় তারা খুনিদের উৎসাহিত করে। এখন এমন একটা থিওরি দাঁড় করানো হয়েছে যে, যারা ব্লগার অর্থাৎ নাস্তিক, তারা ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানে; অতএব তাদের খুন করা জায়েজ। দেখুন, এই তত্ত্বের শেষে এসে সরকার নিজে যোগ দেয় এবং খুনিদের অনুপ্রাণিত করে। এরা অর্থাৎ খুনিরা এবং সরকার তখন এক পক্ষ হয়ে যায়!

আমার বোঝার মধ্যে পড়ে না, একটি দেশে কোনো আইন না থাকা সত্বেও কীভাবে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, 'ধর্মীয় অনুভূতি এবং ইত্যাদি…'। সরকার যদি ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারে আরও পরিষ্কার ও আন্তরিক হয় তবে আইন করতে পারে (জী, ব্লাসফেমির কথাই বলা হচ্ছে) এবং জনগণ তা পছন্দ করুক না করুক মানবে। তাতে সুবিধা এই যে, এখন পরোক্ষে খুনিদের যে অধিকার দেওয়া হয় তা থেকে জনগণ মুক্ত হবে। যদি কেউ সেভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে চায়, তবে সে– শাস্তি যাই হোক না কেন– জেনেশুনেই 'অপরাধটি' করবে। অন্তত এ ধরনের গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারবে।

একটা ব্যক্তিগত ধারণা, যত বার সরকারের লোকজন ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে একটা স্টেটমেন্ট করেন, তার কদিন পরই একেকটা খুন করা হয়। কো-ইন্সিডেন্স কিনা জানি না। একটা যোগসাজশ কেন যেন মনে হয় আছে। মনে হয় একটা ক্লিয়ারেন্স দেওয়া থাকে ওইসব ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা বিষয়ে সরকারি লোকজনের বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে।

হয়তো এটা হতে পারে আমার আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের উপর নির্মিত সদ্য সব ধরনের সিনেমা এবং টেলিভিশন সিরিজগুলো অতিমাত্রায় দেখার ফল। একটা অনুসন্ধানী সংযোগ খোঁজার চেষ্টা।

এর সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই!