কোভিডের এ নিদানকালে বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের আত্মত্যাগের হাজারও গল্প আমরা সকলেই এখন জেনে গেছি। নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব ঘটনার বয়ান বিশ্বের বিভিন্ন ল্যাবে উদ্ভাবিত কোভিড–প্রতিরোধী টিকাগুলোর "ন্যায্য বণ্টন" বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। বিশ্বের মানুষ এখন মোটামুটি একমত যে, গ্রহণযোগ্য টিকা উদ্ভাবিত হলে তা পাওয়ার অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবেন জনগণকে সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা।
কোভিডের টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত কোভ্যাক্স (COVAX) উদ্যোগটির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (CEPI), গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন ইনোভেশন (GAVI) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ এই উদ্যোগে ইতিমধ্যে বিশ্বের ৮০টি দেশ যুক্ত হয়েছে। এর আওতায় "প্রাথমিকভাবে ২০০ কোটি ডোজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে, যা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগণ এবং সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সুরক্ষা প্রদান করার জন্য পর্যাপ্ত।"
কোভিড রোগের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের এগিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটির ভিত্তি মূলত নৈতিক হলেও এক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতির বিবেচনাও কম গুরুত্ববহ নয়। কোভিড চলাকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার ব্যাপারে জনগণের আতঙ্ক দূর করা- উভয়ই জরুরি। গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, টিকা কর্মসূচি এবং যক্ষ্মা ও এইচআইভির মতো দুরারোগ্য রোগের নিয়মিত চিকিৎসার জন্যও এ পদক্ষেপ জরুরি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা কোনো একক ধারা বা নিয়মকানুনের আওতাধীন পেশাজীবীর দল নন। বস্তুত তারা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও নানা শ্রেণি আর ধরনে বিভক্ত। এদের মধ্যে আছেন ওষুধবিক্রেতা (ফার্মাসিস্ট), স্থানীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন এমন ব্যক্তিবর্গ, কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী এবং পল্লী চিকিৎসক। জনসাধারণের যে অংশটির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছায় না, বা যাদের কাছে সেই সেবা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই, অথবা যারা সেই সেবা নিতে ভয়ও পান তাদেরকেই সেবা দেন উপরোক্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোভিড টিকার পরিকল্পনায় এই স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা কি অগ্রাধিকার পাবেন? কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীরা গর্ভবতী নারী, নবজাতক এবং ছোট শিশুদের সরাসরি সেবা দিয়ে থাকেন। এ কর্মীদের অধিকাংশ পল্লী ও নগর এলাকায় বসবাসরত নারী। এদেরকে প্রায় সময়ই "অদৃশ্য বাহিনী" বলা হয়ে থাকে, কারণ তাদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যাদি যেমন সংগ্রহ করা হয় না, তেমনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি ব্যবস্থার আওতা ও গণনার বাইরেই থাকছেন তারা।
প্রশ্ন হলো, ন্যায্যতার যুক্তিতে তারাও কি টিকার দাবিদার হবেন, নাকি এটা কেবল হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চিকিৎসক–নার্সদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে? প্রশ্নটি ওঠার কারণ, মূলত দ্বিতীয় ধরনের ব্যক্তিরাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হিসেবে স্বীকৃত।
এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের চিত্রটি একটু দেখা যাক। টিকাদান এবং মা ও শিশুর মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশের বড় অর্জন রয়েছে। এই অর্জনের পেছনে দেশের বহুমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবদানের কথাও স্বীকার করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থাগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় স্বীকৃত নয়।
ব্র্যাকের মতো বৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। এরা তৃণমূল জনগোষ্ঠী ও সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মধ্যে যোগাযোগের সেতু হিসেবেও কাজ করে এবং টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগের প্রতিরোধ ও চিকিৎসা প্রদানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবাকর্মী বাহিনী ৪০ হাজার নারী নিয়ে গঠিত যারা স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। মহামারী শুরু হওয়ার পরপরই এ কর্মীবাহিনী মাঠে নেমে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। সম্ভাব্য কোভিড রোগী শনাক্তকরণ এবং টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করেছেন । রোগ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক তথ্যাদিও স্থানীয় মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
কোভিডের টিকা দিতে লাখ লাখ মানুষকে টিকাদান কেন্দ্রে এনে জড়ো করাটাই হবে সবচেয়ে কঠিন পর্যায়। মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর দল এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু কাজটি তারা সফলভাবে করতে পারবেন না যদি না তাদের নিজেদের টিকা দেওয়া থাকে।
এই স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কার্যকর তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে উপযুক্ত বিধিমালার প্রয়োজনীয়তা, তদারকি বৃদ্ধি বা তাদের সেবার গুণগত মান বিষয়ে বিতর্ক করা যেতেই পারে। কিন্তু বর্তমানের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের যে বিপুল অংশ গরিবদের সেবা দিয়ে থাকেন, তাদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কিনা এবং ন্যায্যতাভিত্তিক বণ্টনের পরিকল্পনায় তারা অন্তর্ভুক্ত হবেন কিনা।
বস্তুত, একটি ন্যায্যতাভিত্তিক পরিকল্পনায় নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকবে।
১. মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী ও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে কোনো তথ্যভাণ্ডার আছে কিনা যার মধ্যে প্রয়োজনে আরো বেশি সংখ্যক এ ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিহ্নিত করে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব?
২. টিকা নিতে আগেই নাম নিবন্ধন করা এবং টিকা নেওয়ার স্থান – এ দুইটি বিষয় সকল ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জানানোর উপযুক্ত কোনও ব্যবস্থা আছে?
৩. তালিকাভুক্তদের দেওয়ার জন্য সংরক্ষিত টিকার অন্যত্র পাচার ঠেকাতে এবং টিকা বণ্টন ও পৌঁছানোর কার্যক্রম তদারকির উপযুক্ত কঠোর তদারকি ব্যবস্থা আছে?
৪. তথ্যভাণ্ডার প্রদানকারী ও টিকা প্রদানকারী নেটওয়ার্কটি টিকার জন্য জরুরি সংরক্ষণ ব্যবস্থাও কি করতে সক্ষম?
৫. প্রত্যেকটি দেশকে যে জোরালো প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হবে তা হলো, কাদের তারা সম্মুখসারির বা সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হিসেবে বিবেচনা করবে? যুক্তরাষ্ট্রে নার্সিংহোমগুলো ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সুবিধাসম্বলিত আবাসগুলোয় কর্মরত মেডিকেল সংশ্লিষ্ট নয় এমন কর্মীরা কোভিড পরিস্থিতিতে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করছেন। ভারতে রাষ্ট্রীয় 'আশা' কর্মসূচির আওতায় ১০ লাখ মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাকর্মী জনগণকে সরাসরি কোভিড সংক্রান্ত সেবা দিয়েছেন। মাঠপর্যায়ের এই কর্মীরা কি নেপথ্যের নায়ক হিসেবেই থেকে যাবেন, নাকি টিকার অগ্রাধিকার তালিকায় তাদের স্থান হবে?
৬. টিকা বণ্টনের প্রাথমিক পর্যায়ে যদি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের উচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয় তবে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ও চিহ্নিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অনেকেই সরকারি বা বড় হাসপাতালগুলোতে কাজ করেন না। তাদের অধিকাংশই হয়তো বেতনভিত্তিক কাজ করেন না, বা তাদের লাইসেন্সও নেই।
৭. স্বাস্থ্যখাতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করার কোনো সহজ পন্থা হয়তো নেই, কিন্তু এটাই যে সঠিক পথ তা অস্বীকারের উপায় নেই।
৮. কোভিড টিকার বৃহৎ মাত্রায় বিতরণের এখনও কিছুটা দেরি আছে। ফলে এই সময়ে সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের বিষয়টি আমরা গভীরভাবে বিবেচনা করতে পারি, যাতে আমাদের পদক্ষেপ সত্যিকার অর্থেই অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।