কৃষি-৭: আদা চাষাবাদ

দুরন্ত বিপ্লব
Published : 13 Sept 2018, 08:13 AM
Updated : 1 June 2011, 06:54 PM

আদা সুগন্ধযুক্ত গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আমাদের দেশে মসলা হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। মসলা ছাড়াও আদা ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র আদার চাষ হয়ে থাকে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ব্যাপকভাবে আদার চাষ করা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৭ হাজার হেক্টর জমিতে আদার চাষ করা হয় যার হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৫.৫ টন। এ উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল ফলে চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে আদা আমদানি করতে হয়। লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আদার ফলন বহুগুণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। আদার উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্ত্মরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

আদার পুষ্টিগুণ
আদা উৎকৃষ্ট ভেষজ গুণসম্পন্ন মসলা জাতীয় ফসল, এতে উলেস্নখযোগ্য পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। শুকনা আদায় শতকরা ৫০ ভাগ শর্করা, ৮.৬ ভাগ আমিষ, ৫.৯ ভাগ আঁশ, ০.১ ভাগ ক্যালসিয়াম, ১.৪ ভাগ পটাশিয়াম আছে। এছাড়া প্রতি ১০০ গ্রাম আদায় ১৭৫ গ্রাম ভিটামিন 'এ' এবং ৩৮০ ক্যালরি খাদ্যশক্তি আছে।

জলবায়ু
বাংলাদেশের জলবায়ু আদা চাষের জন্য বেশ অনুকূল। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া আদা চাষের উপযোগী। সামান্য ছায়াযুক্ত স্থানে এর ফলন ভালো হয়। সমুদ্র সমতলবর্তী অঞ্চল থেকে শুরম্ন করে ১৫০০ মিটার উঁচু পার্বত্য অঞ্চলেও আদার চাষ করা যায়।

মাটি
পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা সম্পন্ন উঁচু জমি আদা চাষের উপযোগী। বেলে দো-আঁশ, বেলে ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে এর ফলন ভালো হয়।

বীজ বপনের সময়
মধ্য-চৈত্র হতে মধ্য বৈশাখ মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ স্থানীয় উন্নত জাতের বীজ আদা বোনার উপযুক্ত সময়।

বীজ আদা শোধন
পচন রোগ থেকে রড়্গা পাওয়ার জন্য বীজ আদা শোধন করা অত্যাবশ্যক। ৮ লিটার পানিতে ১৫-১৬ গ্রাম 'রিডোমিল গোল্ড' বা 'এক্রোবেট এম জেড' মিশিয়ে তাতে ১০ কেজি বীজ আদা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ভিজিয়ে তুলে ছায়াযুক্ত স্থানে বাতাসে শুকিয়ে নিতে হবে। পরের দিন জমিতে বপন করতে হবে।

মাটি শোধন
কচি Psedostem কে পোকা ও নেমাটোডের আক্রমণ থেকে রড়্গার্র্থে শেষ চাষের আগে জমিতে ১৭ কেজি/হেক্টর হারে দানাদার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

জমি তৈরি ও বীজ বপন
জমি ৫-৬টি আড়াআড়ি চাষ দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। তারপর ৫০ সেমি. দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ২৫ সেমি. দূরত্বে ৮ সেমি,. গভীরতায় বীজ বপন করে মাটি দ্বারা ঢেকে দিতে হবে। বীজ আদার ওজন ৪০-৫০ গ্রাম হওয়া উচিত। অতঃপর সারির উপর উভয় দিকে ২০ সেমি. জায়গা জুড়ে ৫-৬ সেমি. পুরু করে খড় বা শুকনা পাতার আচ্ছাদন দিতে হবে। দ্বিতীয়বার ৬ সপ্তাহ ও তৃতীয়বার ১০ সপ্তাহ পর পাতার আচ্ছাদন দেয়া খুবই উপকারী।

বীজ হার
বীজের আকারের ওপর নির্ভর করে প্রতি হেক্টরে বীজের প্রয়োজন হয় ৩.২-৪.০ টন।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
ভালো ফলন পাওয়ার জন্য আদা চাষে হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ সার প্রয়োগ করতে হবে। উপরে বর্ণিত মাত্রা জমির উর্বরতার ওপর নির্ভর করে কম বা বেশি হতে পারে।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বপনের ৭ দিন আগে শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, বরিক এসিড, জিংক সালফেট ও অর্ধেক এমপি প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ৫০ দিন পর অর্ধেক ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমপি সমানভাগে ভাগ করে বপনের ৮০ দিন পর একবার ও ১১০ দিন পর দ্বিতীয়বার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
আদা লাগানোর ২০-২৮ দিনের মধ্যে চারা বের হয়। এ সময় দুই-তিনবার আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। পরিষ্কারের পর আগাছা দিয়ে আচ্ছাদন দেয়া খুবই উপকারী।

আদার রোগ
আদায় প্রধানত রাইজোম পচা রোগ দেখা দেয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে মাটি বরাবর গাছের গোড়া পচে যায় এবং পাতা হলুদ হয়ে যায় ফলে আদা পচে গিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত রস বের হয়।

সারের নাম—————————–সারের পরিমাণ/হেক্টর
গোবর———————————–১০ টন
ইউরিয়া———————————৩০০-৩২০ কেজি
টিএসপি——————————–২৬০-২৮০ "
এমপি———————————-২৯০-৩১০ "
জিপসাম——————————-১০০-১২০ "
বরিক এসিড (প্রয়োজনবোধে)——১.৮-২.২
জিংক সালফেট (প্রয়োজনবোধে)—৩.৫-৪.০

দমন ব্যবস্থাপনা
এ রোগ দমনের জন্য যে ব্যবস্থা নিতে হয় , তাহলো-
১। রোগমুক্ত বীজ আদা বপন করা।
২। একই জমিতে বারবার আদা চাষ না করা।
৩। জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা।
৪। প্রতি লিটার পানিতে তিন গ্রাম 'রিডোমিল গোল্ড' মিশিয়ে মাটি ভিজিয়ে দেয়া।
৫। রোগাক্রান্ত জমিতে ০.৩% 'রিডোমিল' বা 'সিকিউর' দ্বারা বর্ষার আগে ও পরে একবার আদা গাছের গোড়া ভিজিয়ে দেয়া।

পোকার আক্রমণ ও দমন ব্যবস্থাপনা
আদা গাছে কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এ পোকা দমনের লক্ষ্যে সেভিন ডাস্ট ২% হারে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার সেপ্র করতে হবে। আবার কোনো কোনো সময় আদার জমিতে পাতা খেকো পোকার আক্রমণ দেখা যায়। বিকেল বেলায় আদার জমিতে ১% হারে ডেসিস বা ২% হারে রাইসন সেপ্র করলে এ পোকার উপদ্রব কমে যায়।

ফসল তোলা
চৈত্র থেকে বৈশাখ (মধ্য -মার্চ থেকে মধ্য-এপ্রিল) মাসে লাগানো আদা অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ (মধ্য-ডিসেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারি) মাসে তোলার উপযোগী হয়। মাটির উপরের অংশ সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে গেলে আদা ফসল তোলা যাবে। কোদাল দিয়ে খুঁড়ে আদা তোলা হয়। আদা তুলে মাটি পরিষ্কার করে সংরক্ষণ করতে হবে।

জীবনকাল
আদা বপন থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত ২৪০-২৭০ দিন সময় লাগে।

বীজ আদা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
বীজ আদা সংগ্রহের জন্য সতেজ ও রোগমুক্ত মাতৃগাছ নির্বাচন করা প্রয়োজন। নির্বাচিত গাছ সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে যাওয়ার ১৫-২০ দিন পর বীজ আদা সংগ্রহ করতে হবে। সংরক্ষণের আগে শতকরা ৩ ভাগ 'ডাইথেন এম-৪৫' দ্বারা বীজ শোধন করলে পচন থেকে আদা রড়্গা করা যায়। সংগৃহীত আদা পরিষ্কার করে নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা উত্তম।

ক. গর্ত খনন করে সংরক্ষণ
উঁচু জমিতে ৪৫০ সেমি. লম্বা, ৩০০ সেমি. চওড়া এবং ১৮০ সেমি. গভীর গর্ত করে শুকিয়ে, গর্তের চারপাশে খড় বিছিয়ে, থলিতে ভরে একে একে সাজিয়ে মাটির আবরণ দিয়ে ঢেকে আদা সংরক্ষণ করা যায়।

খ. শুকনা বালুর সাহায্যে সংরক্ষণ
এ পদ্ধতিতে প্রথমে ৩-৪ সেমি. শুকনা বালির স্থরের ওপর বীজ আদা (১০-১২ সেমি. পুরু স্থর) রেখে প্রথমে সবুজ পাতা ও পরে বালির আস্থরণ (২-৩ সেমি.) দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। বীজের পরিমাণ বেশি হলে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে স্থরে স্থরে রাখা যেতে পারে।

ফলন
হেক্টরপ্রতি ফলন ২০-২৫ টন। শুকালে বা শোধন করলে এ থেকে শতকরা ২০-২৫ ভাগ আদা পাওয়া যায়।

***
তথ্যসূত্র: মো. মনিরুজ্জামান, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্যানতত্ত্ব), আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বিএআরআই, মাগুরা