কৃষি-১৮: পানি ছাড়া খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস পালন

দুরন্ত বিপ্লব
Published : 19 Sept 2011, 06:56 AM
Updated : 19 Sept 2011, 06:56 AM

অদ্ভুত এক জলচর পাখি হাঁস, পৃথিবীর সব হাঁস এসেছে বুনোপাখি ম্যালরড থেকে, আর পৃথিবীর সব উন্নত জাতের হাঁসের সৃষ্টি হয়েছে এশিয়ার জল জাঙ্গালের বুনোহাঁস থেকেই। হাঁসের চামড়ার নিচে আছে চর্বির একটা চাদর এজন্য এদের শরীরে পানি বসে না।

আমাদের দেশে লেয়ার মুরগির তুলনায় ডিমপাড়া হাঁসের খামার খুবই কম। বাজারে হাঁসের ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অনেকেই খামারের মুরগির ডিম খেতে কম পছন্দ করেন, কারণ- কখনো কখনো লেয়ার খামারে এন্টিবায়টিকসহ বিভিন্নি প্রকার ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হয়ে থাকে। যেহেতু হাঁসের রোগবালাই খুব কম, সে কারণে হাঁসের খামারে তেমন কোন ওষুধের প্রয়োজন হয় না। হাঁসের ডিম আকারে বড়, খাদ্যমান উন্নত ও খুবই পুষ্টিকর।

হাওর, বিল, নদী এলাকায় হাঁসের খামারে অতিরিক্ত খাদ্য পর্যাপ্ত লাগে না। হাঁস একেবারে প্রাকৃতিক পানি থেকেই মাছ, ঝিনুক, শামুক, পোকামাকড়, জলজউদ্ভিদ ইত্যাদি খেয়ে থাকে তাই তৈরি খাদ্যের প্রয়োজন বেশ কম। পুকুরে হাঁস চাষ করলে সার ও মাছের খাদ্য ছাড়াই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব।

হাঁসের খামার বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারিভাবে আরো জোড়াল উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের সর্বত্র চাষিরা যাতে হাতের কাছে খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের বাচ্চা পেতে পারে সে ব্যবস্থা করা জরুরি। দেশে মুরগির তুলনায় হাঁসের হ্যাচারির সংখ্যা খুব কম থাকায় চাষিরা সময়মতো হাঁসের বাচ্চা পায় না। এতে করে দেশের অনেক জলভূমির পানিজাতীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না।

শুধু মুরগির ডিমের ওপর নির্ভরতার কারণে মুরগির ডিমের দাম বেড়ে যায়, তাছাড়াও লেয়ার মুরগি পালনে রোগবালাইসহ নানা রকম দুর্যোগের ঝুঁকি রয়েছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যবিমোচনে হাঁসের খামারের গুরুত্ব অপরিসীম।

খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের সুবিধা

১. বছরে ২৮০-৩০০টি ডিম দেয়। ২-৩ বছর বয়স পর্যন্ত ডিম দেয়, সেখানে লেয়ার মুরগি ডিম দেয় দেড় বছর পর্যন্ত।
২. সবাই হাঁসের ডিম খেতে পছন্দ করেন।
৩. হাঁসের বাচ্চার দাম খুব কম ১২ টাকা সেখানে মুরগির বাচ্ছার দাম ৬০-৬৫ টাকা।
৪. হাঁসের ডিমের সাইজ বড়।
৫. ১ হাজার মুরগির চেয়ে ১ হাজার হাঁস পালন করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে।
৬. ডিম উৎপাদন কমে গেলে ৩ বছর পর হাঁসগুলো মাংস হিসেবে বাজারে বিক্রি করা যাবে। হাঁসের মাংস মুরগির চেয়ে সুস্বাদু।
৭. মুরগি সব দিন ধরে ডিম দেয় কিন্তু হাঁস সকাল ৯টার মধ্যে ডিম পাড়া শেষ করে। ফলে নজরদারির খরচ কম লাগে।
৮. খাকি ক্যাম্পবেল হাঁস ১৭-১৮ সপ্তাহ বয়সেই ডিম দেয়।
৯. নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও ফেনী সরকারি হাঁস প্রজনন খামার থেকে ১ দিনের বাচ্চা সংগ্রহ করা যাবে।

খাকি ক্যাম্পবেল হাঁসের বৈশিষ্ট্য

উৎপত্তি : ইংল্যান্ডে, পালকের রঙ খাকি, মাথা এবং ঘাড় ব্রোঞ্জ রঙের, দেহের আকার মাঝারি- ১.৫-২ কেজি, পা এবং পায়ের পাতায় রঙ হাঁসার হলুদ, হাঁসীর কালো। ঠোটের রঙ হাঁসা নীলাভ, হাঁসী কালো, ডিম দেয় ২৫০-২৭০টি বছরে।

হাঁসের বাসস্থান

মুরগির মতো ততো ভালো বাসস্থান না হলেও চলে। আলো বায়ু চলাচল ভালো থাকতে হবে। বয়স্ক হাঁসপ্রতি জায়গা লাগবে ২-৩ বর্গফুট। উঠতি হাঁসা-হাঁসীর জন্য ১ বর্গফুট জায়গাই যথেষ্ট। বন্য জন্তু বিশেষ করে শেয়ালের হাত থেকে রৰার ব্যবস্থা করতে হবে। থাকার জায়গায় মুরগির লিটারের মতো বিচুলি, তুষ, কাঠের গুঁড়া বিছিয়ে দিতে হবে, এতে আরামে থাকবে পাখিগুলো, ডিম গড়িয়ে যাবে না, ভাঙবে না।

ঘর পূর্ব-পশ্চিম লম্বা করতে হবে। বাণিজ্যিক খামারের ৰেত্রে ঘরের প্রস্থ ১৮-২০ ফুট, উচ্চতা ৬ ফুট এবং দৈর্ঘ্য হাঁসের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করতে হবে। ঘর দেশি সামগ্রী – বাঁশ, টিন, ছন, খড় প্রভৃতি দিয়ে তৈরি করা যায়। ঘরের তাপমাত্রা ৫৫-৭৫% ও আর্দ্রতা ৩০-৭০% হাঁসের জন্য অনুকূল। লেয়ার হাঁসের জন্য ১৪-১৬ ঘণ্টা আলো দরকার। ৩০০ বর্গফুট স্থানের জন্য ১টি ৬০ওয়াটের বাল্ব দরকার। ঘরের চারপাশে তারের জাল দ্বারা ঘিরে দিতে হবে।

পানি ছাড়া হাঁস পালন

মানুষের খুব একটা ভুল ধারণা আছে হাঁস পালনে পানি লাগে। প্রজননের জন্য হাঁস পুষলে পানি অবশ্যই দরকার। যে কোনো অগভীর ডোবা বা ট্যাংক, গভীরতা যার ৯ ইঞ্চি আয়তন ৫। এ ধরনের মাপে ১০টি হাঁস অনায়াসে পালন চলবে। শুধু ডিমের জন্য হাঁস পালন করলে মুরগির মতো 'ডিপলিটার' পদ্ধতিতে অর্থাৎ মেঝেতে ৩ ইঞ্চির মতো শুকনো কাঠের গুঁড়া, তুষ বিছিয়ে হাঁস পালন চলবে। এভাবে পালন করলে মুরগির মতো হাঁসকেও সেই সুষম খাদ্য দিতে হবে।

বাচ্চা ব্রুডিং

হাঁসের বাচ্চা ৩ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ব্র্বডিংয়ের জন্য ব্রুডার ব্যবস্থা করতে হয়। ব্রুডার -কাম গ্রোয়ার হাউসে হোভায়ের সঙ্গে ১০০ ওয়াটের ৩/৪টি বাল্ব সংযোজন করে তাপ উৎপাদন করা হয়। ৪ দিন বয়স পর্যন্ত ব্র্বডারে কাগজের ওপর খাদ্য দিতে হবে।

ব্রুডারের তাপমাত্রা

প্রতি লিটার পানিতে ৮০ গ্রাম গৱুকোজ ৪ গ্রাম ভিটামিন সি মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত হাঁসের বাচ্চাকে পানিতে ছাড়া যাবে না।

হাঁস কমবেশি ২২ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়ে, ২০ সপ্তাহ বয়সের পরে লেয়ার খাদ্য প্রদান করতে হবে। দৈনিক ১৫০-১৭০ গ্রাম দিতে হবে।

হাঁসের জন্য ম্যাস খাদ্যের নমুনা

সকাল ৯টায় খাবার দেয়ার সময় হাঁসের ডিম সংগ্রহ করতে হয়। ডিম সংগ্রহ করে হাঁস চড়ার জন্য ছেড়ে দিতে হবে। পরিচিত ও বিশ্বস্ত হ্যাচারি থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। খাবার ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। লিটার ভিজতে দেয়া যাবে না। বাসি, পচা খাবার খেতে দেয়া যাবে না। অসুস্থ হাঁস আলাদ করে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। মৃত হঁসকে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।

প্রতিষেধক ব্যবস্থা

৩ সপ্তাহ বয়সে : বুকের মাংসে ১ সষ ডাক পেৱগ টিকা। ১৫ দিন পর : পুনরায় বুকের মাংসে ডাকা পেৱগ টিকা। ৭০ দিন বয়সে : কলেরার টিকা ১/স অথবা ং/প। ১৩০ দিন বয়সে : ওই।

খামারের আয়-ব্যায়ের হিসাব হিন

১. স্থায়ী খরচ : ক. জমি নিজস্ব খ. লেয়ার সেড ২৫০টি হাঁসীর জন্য ৭৫০ বর্গফুট। প্রতি বর্গফুট ১০০ টাকা হিসাবে ৭৫০০x১০০= ৭ হাজার ৫০০ টাকা। গ. ব্র্বডার, খাদ্য ও পানির পাত্র ২০০০ হাজার টাকা।
২. চলতি খরচ : ক. বাচ্চা ক্রয় ৫০০x১২= ৬ হাজার টাকা। খ. ম্যাস খাদ্য ৫০ হাজার টাকা। গ. আনুষঙ্গিক খরচ ২৫ হাজার টাকা। ঘ. অপ্রচলিত খাদ্য ২৫ হাজার টাকা। মোট খরচ ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
আয় : ৫% মৃত হাঁস বাদে ৫০০-২৫= ৪৭৫টি হাঁস। ক. ২২৫টি হাঁসা বিক্রি বাবদ আয় ২২৫x১০০ = ২২ হাজার ৫০০ টাকা। খ. ২৩০টি হাঁসী থেকে শতকরা ৭০টি ডিম। উৎপাদন (১৮ মাসে) মোট ডিম ৮৬ হাজার ৯৪০টি x৫= ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ টাকা। গ. ২৪৫টি (২৩০+১৫টি হাঁসা) বাতিল হাঁস বিক্রি ২৪৫x১০০= ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। মোট আয় ৪ লাখ ৮১ হাজার ৭০০ টাকা।
নিট লাভ : মোট আয়-মোট খরচ ৪ লাখ ৮১ হাজার ৭০০-১ লাখ ৮৩ হাজার = ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭০০ টাকা।

হাঁস সাধারণত ডাকপ্লেগ, কলেরা, ভাইরাল হেপাটাইটিস, খাদ্যে বিষক্রিয়া/বটুলিজম, সর্দি কাশি ও অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যে কোনো সমস্যায় কাছের উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।

বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান বাড়াতে নানা ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিঙ পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ বাড়ছে। বাড়ছে অপরিকল্পিত আবাসন। সম্ভোগের মাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে শপিং মল, ফাস্টফুডের দোকান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল, অফিসসহ নানা স্থাপনা। প্রকৃতি কিন্তু বিপন্ন হয় নির্গত গ্যাসের কারণে। সুস্থ জীবন আজ বিপন্ন।

উন্নয়নের নামে যত বড়াই আমরা করছি, ততো আমরা ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করছি না। বহু নবায়নযোগ্য সম্পদ হারিয়ে গেছে, বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। অনেক ফুলের সুবাস আর পাওয়া যাবে না। অনেক ফলের স্বাদ আর আমরা জানব না। অনেক মানুষ প্রকৃতির এ বিপন্ন অবস্থার কারণে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। জীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ হয়ে প্রতিযোগিতার নামে আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

আমি আস্থা রাখতে চাই আমাদের কর্মে আমরা যেন নদীনালা, খালবিল, জলাশয় রৰা করি, পানির পরিমাণ ও প্রবাহ বাড়াতে যেন চেষ্টা করি। উন্মুক্ত পানি সংরৰণাগার বানাতে উদ্যোগী হই। জমির পাপ্যতা অনুযায়ী পুকুর, দীঘি তৈরির কর্মসূচি প্রণয়ন করি। দূষণমুক্ত জলাশয় রৰণে যত্নবান হই। আমরা যেন বনাঞ্চল রৰা করি। ফল, ঔষধি, ফুল, বাহারি কাঠ জাতীয় বৃৰরোপণে আত্মনিয়োগ করে বনায়ন বৃদ্ধি করি। উপকূলীয় অঞ্চলে সবুজবেষ্টনী তৈরি করি। বনদস্যুদের প্রতিহত করি। ভূমিদস্যুরা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে পরিবেশগত যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে তা প্রতিহত করে নদী, জলাশয়, পৱাবনভূমি, বনাঞ্চল, কৃষি জমিকে রৰা করেই পরিকল্পিত নগরায়ন সম্ভব করে তুলতে হবে। জলাশয়ের মতো মাঠের ওপর ভূমিদস্যদের আক্রমণ ঠেকাতে হবে। মুক্তভূমি আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। চাষাবাদে পরিবেশবান্ধব কৃষিকে প্রাধান্য দেই। উপকূল বনায়ন ও পরিবেশবান্ধব জীবপ্রকৃতির সৃষ্টিতে প্রধান্য দিতে হবে।

দেশের অভ্যন্তরে যে লবণাক্ততা লৰ্যণীয়, জোয়ার-ভাটা ফিরিয়ে এনে সেখানে পানি প্রবাহের প্রকৃতি বদলে দিতে হবে। মর্বময়তা রাজশাহী অঞ্চলে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে, পরিবেশবান্ধব কৃষির মাধ্যমে এখানে প্রাকৃতিক পরিবর্তন আনতে হবে। নদী তীর ও মোহনায় ভাঙনের জন্য মানুষের সৃষ্ট কর্মগুলো ঠেকাতে হবে। তেমনি ভূমি পাচার, ভূমি ৰয়, নদী ৰয়ের ব্যাপারে কার্যকরভাবে অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সম্পদ হলো জমি, পানি, বন ও জীববৈচিত্র্য, এগুলোকে নিয়েই মানুষের জীবন সমৃদ্ধ হয়। উন্নয়ন কর্মসূচি তাই এসব সম্পদসংরৰণে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

***
তথ্যসূত্র: ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার, ভেটেরিনারি সার্জন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস, কাউনিয়া, রংপুর