কৃষি-১৯: সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সার ব্যবহার

দুরন্ত বিপ্লব
Published : 22 Sept 2011, 11:56 AM
Updated : 22 Sept 2011, 11:56 AM

ফসল উৎপাদনে সারের বিকল্প নেই। কেননা উদ্ভিদের খাদ্যই হচ্ছে সার। সার সমস্যা বাংলাদেশে আজ আর নতুন কিছু নয়। রাসায়নিক সার ৫০ এর দশকে এদেশের ফসলে ব্যবহার শুর্ব হয় আর তখন সার ব্যবহারের কথা বলা হলে চাষিরা চমকে উঠতেন। যদিও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সার ব্যবহারে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে সাফল্য এনেছেন। কিন্তু আজও আমরা ফসলের জমিতে সার ব্যবহারের নিয়মনীতি মেনে চলি না বলে অনেকেই পরিমাণের চেয়ে বেশি সার প্রয়োগ করে থাকি। বিপত্তিটা এখানেই।

গাছের পুষ্টি, বৃদ্ধি, বংশবিস্তার, ফুল, ফলধারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিসহ মাটিকে সুস্থ এবং উর্বর রাখতে হলে সুষম ও পরিমিত উপায়ে সার ব্যবহার করতে হবে। কারণ অপরিমিত উপায়ে ও মাটি পরীৰা না করে সার ব্যবহার করলে একদিকে যেমন উৎপাদন কম হয় অন্যদিকে খরচ বাড়ে। এ ছাড়া মাটির স্বাস্থ্য, উর্বরতা ও পরিবেশ নষ্ট হয়। ফসল উৎপাদনে মুখ্য খাদ্য উপাদান নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম-এর মধ্যে কৃষকরা নাইট্রোজেন জাতীয় ইউরিয়া সার ব্যবহারকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। মোট সার ব্যবহারের প্রায় ৭৫ ভাগ নাইট্রোজেন, ফসফরাস শতকরা প্রায় ১২ ভাগ এবং পটাশিয়াম শতকরা প্রায় ৬ ভাগ মাত্র।

মাটিতে সার ব্যবহারের আগে যা জানা দরকার বছরের যে কোনো সময় কোনো ফসল চাষ করতে হলে প্রথমে মাটি পরীৰা করে মাটির গুণাগুণ সম্পর্কে জানতে হবে অর্থাৎ মাটিতে কোন পুষ্টি উপাদান কি পরিমাণে আছে। মাটিতে কি ফসল চাষ করা হবে, সে ফসলের সারের চাহিদা উপজেলা নির্দেশিকা বা কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।

ওই জমিতে পূর্ববর্তী কি ফসল চাষ করা হয়েছে তা জানতে হবে এবং কী কী সার ব্যবহার করা হয়েছে তাও জানা দরকার।

কিভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার কমানো যায়?

বাংলাদেশের প্রেৰাপটে অল্প জমিতে বেশি ফলন পেতে হলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহার কমানো যায় পাশাপাশি ফলন বেশি পাওয়া যায়।

প্রয়োগের সময় ও পদ্ধতির উপরই প্রয়োগকৃত সারের কার্যকারিতা বাড়ে। নাইট্রোজেন সারের জন্য বিশেষভাবে গুর্বত্বপূর্ণ। কেননা পানিতে সহজে দ্রবণীয় বলে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োগকৃত নাইট্রোজেনের প্রায় ৭০% নানাভাবে মাটি থেকে ধুয়ে ফসলের নাগালের বাইরে চলে যায় এবং পরিবেশকেও দূষিত করে।

ইউরিয়া সার মাটিতে অত্যন্ত ৰণস্থায়ী এবং মৌসুম শেষে মাটিতে তা একেবারেই অবশিষ্ট থাকে না বা সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। কাজেই ইউরিয়া সার ফসলের চাহিদামাফিক গাছের আংশিক বৃদ্ধির ধাপে ধাপে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হয়।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্রপ ফিজিওলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা ধান গাছের বিভিন্ন দৈহিক পর্যায়ে কখন কতটুকু নাইট্রোজেনের প্রয়োজন বা কখন নাইট্রোজেনের চাহিদা বেশি তা নিরূপণ করেছেন। সে হিসেবে সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় ইউরিয়া প্রয়োগ করলে প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ ইউরিয়ার অপচয় রোধ করা সম্ভব। সবুজ সার প্রয়োগের পর (হেক্টরপ্রতি ১২ ১৫ টন সবুজ ধৈঞ্চা) ধান ফসলের নাইট্রোজেন সারের মাত্রা ২৫-৩০ কেজি/হেক্টর কমানো যায়। শুঁটি জাতীয় দানা ফসলের পর (যদি ফসলের পরিত্যক্ত অংশ মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়) তাহলে নাইট্রোজেন সারের মাত্রা প্রয়োগ মাত্রা ৮-১০ কেজি/হেক্টর কমানো যায়। এলসিসি ব্যবহারের মাধ্যমে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে ধানের ফলন ঠিক রেখে হিসেবে দেখা গেছে, রোপা আমন ধানে শতকরা ২৫ ভাগ এবং বোরো ধানে শতকরা ২৩ ভাগ ইউরিয়া সার কম লাগে।

সার প্রয়োগের নিয়মকানুন

বর্তমান বাজারে সার যেমন দুষপ্রাপ্য তেমনি অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটা উপকরণ। এজন্য ফসলের ৰেতে প্রয়োগকৃত সারের যেন সুফল পেতে পারি তার প্রতি সচেষ্ট হওয়া উচিত।

০ রাসায়নিক সার কোনো বীজ, নতুন শিকড় ও লতাজাতীয় গাছের কাণ্ডের খুব কাছাকাছি বা কোনো ভিজা কচিপাতার ওপর ব্যবহার করা উচিত নয়। ঘনীভূত লবণ বিধায় এগুলো গাছের নাজুক সব বাড়ন্ত অংশকে পুড়িয়ে দিতে পারে।

০ ধান, গম, পাট, সরিষা, ভুট্টা, ফসলে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে রাখলে অর্ধেকও গাছের কাজে লাগে না। তাই সার দেয়ার পর কাদা জমিতে হাত দিয়ে অবশ্যই মিশিয়ে দেয়া দরকার। শক্ত ও কাদাবিহীন মাটিতে নিড়ানি দিয়ে মাটির সঙ্গে সার মিশানো যায়। সারি করে এসব ফসলের চাষ করলে নিড়ানি যন্ত্রের সাহায্যে সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশানো যায় এতে সারের এক বিরাট অংশ অপচয়ের হাত থেকে রৰা পায়, ফলনও বেড়ে যায়।

০ ইউরিয়া সার বেশি দাঁড়ানো পানিতে প্রয়োগ করা ঠিক নয়। এতে বেশির ভাগ নাইট্রোজেন ধুয়ে যেতে পারে। জমিতে ছিপ ছিপে পানি থাকা অবস্থায় ইউরিয়া ছিটানো যেতে পারে।

০ জৈবসার, টিএসপি ও এমপি বীজ বপন বা চারা রোপণের আগে প্রয়োগ করতে হয়। বেলেমাটিতে এমপি সার কয়েক দফা উপরিপ্রয়োগ করলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়। ইউরিয়া সার কয়েক কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করলে গাছ অধিক হারে সার গ্রহণ করে অধিক ফলন দেয়।

এ ছাড়া কোনো কোনো ফসলে বিশেষ মুহূর্তে সার দিলে ফলন বেশি হয়। যেমন- ধানের প্রথম কুশি বের হওয়ার সময়, কাইচ থোড় জন্মের কয়েক দিন আগে এবং গমে মুকুট শিকড় বের্বলে, ভুট্টায় যখন চারা হাঁটু সমান উঁচু হয় এবং স্ত্রী ফুল বের হওয়ার এক সপ্তাহ আগে সার উপরিপ্রয়োগ করা উপকারী।

০ বোরো ধানের বেলায় ১ গ্রাম ওজনের ৩টি এবং রোপা আমনের ৰেত্রে ২টি গুটি ইউরিয়া পুঁততে হয়। চারা রোপণের ৫-৭ দিন পর দু'সারির কাছাকাছি চার গোছার মাঝখানে গুটি ইউরিয়া মাটির সাড়ে ৭.৫০ থেকে ১০ সেন্টিমিটার বা ৩-৪ ইঞ্চি নিচে প্রয়োগ করা দরকার। মাটির ওপরে যখন পানি থাকবে না তখনই গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
০ জিংক ও ফসফেট সার একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিত নয়। কেননা, এ উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে আবদ্ধ হয়ে যায় এবং ফসলের জন্য তা গ্রহণোপযোগী হয় না। ফসফেট সার জমি তৈরি শেষ হওয়ার ২-১ দিন আগে চাষ দেয়ার সময় প্রয়োগ করা উচিত।

০ জমি তৈরির শেষ চাষে পটাশ, গন্ধক ও জিংকজাতীয় সারগুলো প্রাথমিকভাবে একবারে প্রয়োগ করা চলে।
০ সুষম মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার ব্যবহারের ওপর ফসলের ফলন বিশেভাবে নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহার করলে দস্তা, গন্ধক ও অন্যান্য অনুখাদ্যের অভাবও অনেকাংশে পূরণ হয়।
০ আগাছা সার গ্রহণে পারদর্শী এবং ইউরিয়া সার পেলে দ্র্বতগতিতে বাড়ে। তাই ৰেতের আগাছা পরিষ্কার না করে ইউরিয়া সার দিলে সারের কার্যকারিতা কমে যায় ফলনও দার্বণভাবে হ্রাস পায়।

তথ্যসূত্র: এস. এম. আহসান হাবিব, এআইসিও. কৃষি তথ্য সার্ভিস, খুলনা