কৃষি-২৪: সবজি ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার

দুরন্ত বিপ্লব
Published : 28 Sept 2011, 01:56 PM
Updated : 28 Sept 2011, 01:56 PM

ফসল উৎপাদনে নাইট্রোজেন একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে এদেশে প্রধানত দানাদার ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। অধিক ফলনের আশায় অনেক কৃষকই অতিরিক্ত পরিমাণে ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। ফলে প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সার বিভিন্ন উপায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপচয়সহ মাটিতে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট ও গাছের সুষম বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সমপ্রতি বাংলাদেশে ধান ও কিছু সবজি ফসলে দানাদার ইউরিয়া সারের বিকল্প হিসেবে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার শুরু হয়েছে যা ইউরিয়া সার সাশ্রয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং গাছের সুষম বৃদ্ধির জন্য সহায়ক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এখানে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি সহায়তা দিতে হচ্ছে। এর ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় সাধিত হয়। ইউরিয়া সার সঠিকভাবে ব্যবহার করে আমরা এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি।

খরচ কমাতে গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার
আমাদের দেশে ইউরিয়া সারের অপচয় সর্বাধিক। প্রয়োগকৃত ইউরিয়া সারের মাত্র শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ফসলের কাজে আসে। ইউরিয়া সার জমিতে প্রয়োগ করার পর সহজেই তা দ্রবীভূত হয় এবং বৃষ্টি ও সেচের পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে বা মাটির গভীরে চলে যায়। এ ছাড়া ডিনাইট্রিকিকেশন ও উদ্বায়নের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে মিশে পরিবশে দূষণ করে। ফলে এর সামান্য অংশ গাছ গ্রহণ করতে পারে। নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের অপচয় কমানোর জন্য এর প্রয়োগ পদ্ধতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দানাদার ইউরিয়া সারের পরিবর্তে গুটি ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে ধানসহ বিভিন্ন সবজি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন উচ্চ মূল্যের সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে দানাদার ইউরিয়া সারের চেয়ে বেশি ফলন পেয়েছে যা কৃষি ৰেত্রে আশাব্যঞ্জক সাড়া মিলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে দানাদার ইউরিয়া সারের চেয়ে বেশি ফলন পেয়েছে যা কৃষি ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাড়া মিলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ কম ইউরিয়া সার কম লাগে এবং সবজির গুণাগুণ ও ফলন বৃদ্ধি পায় যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।

গুটি ইউরিয়া কী?
গুটি ইউরিয়া ইউরিয়া সারের একটি রূপান্তর মাত্র। দানাদার ইউরিয়াকে ব্রিকেট মেশিনের মাধ্যমে চাপ দিয়ে বড় আকারের সাইজ করে গুটি ইউরিয়া তৈরি করা হয়। গুটি ইউরিয়া দেখতে অনেকটা ন্যাফথেলিনের মতো। এর উপাদান সাধারণ ইউরিয়ার মতোই। গুটি ইউরিয়া দুটি ভিন্ন নামে পাওয়া যায়। প্রথমত ইউরিয়া সুপার গ্রানিউল বা সংৰেপে ইউএসজি যার প্রতিটির ওজন ০.৯ গ্রাম। এ ওজনের গুটি বাজারে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি ওজনের গুটি ইউরিয়াকে ইউরিয়া মেগা গ্রানিউল বা সংক্ষেপে ইউএমজি বা মেগা গুটি বলা হয়। যার ওজন সাধারণত ১.৮ গ্রাম ও ২.৭ গ্রাম হয়ে থাকে।

গুটি ইউরিয়া সারের উপকারিতা
* গাছে দীর্ঘ সময় ধরে আস্তে আস্তে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে এবং গাছ চাহিদা মাফিক নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে। গুটি প্রয়োগের পর মাটি দ্বারা ঢেকে দেয়া হয় বিধায় উদ্বায়নের মাধ্যমে অপচয় হয় না এবং গ্রাস আকারে নাইট্রোজেন বাতাসে মিশতে না পরায় পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে।
* দীর্ঘ সময় ধরে সুষম মাত্রায় নাইট্রোজেন সরবরাহ পাওয়ায় ফসলের গুণগতমান ও ফলন বৃদ্ধি পায়।
* ইউরিয়া সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় বিধায় প্রতি একর জমিতে কম পরিমাণ সারের প্রয়োজন হয় এবং সার কম লাগায় বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়।
* দানাদার ইউরিয়া প্রয়োগের পর অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি মূল, পাতা বা গাছের অন্য অংশে লেগে সংশ্লিষ্ট স্থানে ক্ষত সৃষ্টি করে। গুটি ইউরিয়া মাটির গভীরে প্রয়োগ করা হয় বিধায় এ জাতীয় ক্ষত সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে না।
* মাটির দুই থেকে তিন ইঞ্চি গভীরতায় প্রয়োগ করা হয় বলে পানির স্রোতে এক জমি থেকে অন্য জমিতে ইউরিয়া স্থানান্তর হতে পারে না।
* গুটি ইউরিয়া দিলে জমিতে আগাছা কম হয়। এতে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয় এবং সর্বোপরি ফলন বাড়ে।
* অনুমোদিত মাত্রার দানাদার ইউরিয়া সারের চেয়ে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ ইউরিয়া সারের প্রযোজন হয় এতে কাঙিত ফলন পাওয়া যায় এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয়।

বিভিন্ন সবজিতে গুটি ইউরিয়া প্রয়োগপদ্ধতি

১. আলু
মাটির পুষ্টিমান, উর্বরতা এবং আলুর জাত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ইউরিয়া সারে পরিমাণ নিরূপণের পর প্রতিটি গাছের জন্য গুটি ইউরিয়ার সংখ্যা বের করে নিতে হবে। জমি তৈরির সময় শেষ চাষে ইউরিয়া ছাড়া অন্য সব সার আলুর সারির দুই পাশে নালা টেনে নালাতে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। জমিতে আলু লাগানোর সময় লাইনে প্রতিটি আলুর পাশে নিরুপিত গুটি ইউরিয়া সমান ভাগে ভাগ করে বসাতে হবে। গুটিগুলো আলু থেকে উভয় পাশ দুই থেকে তিন ইঞ্চি দূরের নালাতে বসাতে হবে। এর পর আলু ও গুটি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

২. কলা
কলার জাত ও মাটির উর্বরতা অনুযায়ী গাছপ্রতি গুটি ইউরিয়ার পরিমান নির্ণয় করে সমান কিস্তিতে রোপণের ৬০ দিন, ১২০ দিন এবং ফুল আসার আগে গাছের গোড়া থেকে যথাক্রমে ৩০, ৬০ এবং ৯০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ৫-৮ সেন্টিমিটার গভীরে রিং আকারে প্রয়োগ করতে হবে। একই সাথে টিএসপি ও এমওপি সারের অবশিষ্ট অংশ প্রয়োগ করতে হবে।

৩. বেগুন
মাটি পরীক্ষা করে ইউরিয়ার সঠিক পরিমাণ থেকে গুটি সংখ্যা বের করে নিরুপিত গুটি ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমাণ এবং অবশিষ্ট এমওপি সার চারা রোপণের ২০-২৫ দিন পর প্রতি গাছের গোড়া থেকে ৪ ইঞ্চি দূরত্বে রিং পদ্ধতিতে ২-৩ ইঞ্চি মাটির গভীরে প্রয়োগ করে ঢেকে দিতে হবে। ৬০-৬৫ দিন পর বাকি অর্ধেক গুটি ইউরিয়া একইভবে প্রয়োগ করতে হবে। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পর পরই জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে হালকা সেচ প্রদান করতে হবে।

৪. বাঁধাকপি ও ফুলকপি
মাটি পরীক্ষা ও জাত অনুযায়ী গুটি ইউরিয়ার সংখ্যা বের করে চারা রোপণের ১২-১৫ দিন পর গাছের গোড়া থেকে ৪-৫ ইঞ্চি দূরে রিং পদ্ধতিতে ২-৩ ইঞ্চি মাটির গভীরে প্রয়োগ করে ঢেকে দিতে হবে। একই সাথে অবশিষ্ট এমওপি সার দিতে হবে।

বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার ও ফলাফল
ধানের পাশাপাশি আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, কলা, বেগুন, ভুট্টা ও টমেটো চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা যায় বিভিন্ন সবজি ফসলে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ১০-২০ ভাগ ইউরিয়া কম প্রয়োজন হয় এবং সবজির ফলন ও গুণগতমান ভালো হয়।

সবজি চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহার একটি কার্যকর ও লাগসই পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। এর ব্যবহারে মানসম্পূর্ণ ও অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব। সবজি ফসলে মাটি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে দানাদার ইউরিয়ার অপচয় রোধ করাসহ আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হওয়া সম্ভব। সর্বোপরি এতে পরিবশে দূষণ থেকে মাটি ও পানি রক্ষা পাবে। দেশের কৃষি পরিবেশ অঞ্চলে বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষকের জমিতে উচ্চ মূল্যের সবজি ও ফল চাষে গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে সফলতা পাওয়া গেছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন ইউরিয়া সাশ্রয় হবে অন্যদিকে তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ফসলের সুষম বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধি পাবে।

তথ্যসূত্র: মো. সোহাগ মাহফুজ, আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রংপুর