খাদ্য ও পুষ্টির অন্যতম উৎস ফল। ফল মানুষের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ যোগান দেয়। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ ধরনের ফল আছে। এরমধ্যে মাত্র অল্প ক'টি ফল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হয়, যা চাহিদার তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
অন্যদিকে সংগ্রহ এবং সংগ্রহোত্তর অব্যবস্থাপনার জন্য নষ্ট হয়ে যায় শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ফল।
খুব সাদামাটা ধারণায়- ফলের বীজ বা চারা/কলম বপন/রোপণ/পরিচর্যার পর নির্দিষ্ট সময়ে ফল ধরবে, পরিপক্ব হবে। যথানিয়মে ফল পাড়ব এবং খাব বা ভোগ করব, ব্যস। এতে আবার সংগ্রহ এবং সংগ্রহ পরবর্তী কৌশল আসে কোত্থেকে? আসলে তা নয়। ফল উৎপাদনে ফল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। প্রথমেই আসা যাক ফল সংগ্রহের বিষয়ে।
ফল সংগ্রহকালে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে ফলে আঘাত না লাগে। কারণ আঘাতপ্রাপ্ত ফলের শ্বসন ও প্রস্বেদন ক্রিয়া বেড়ে যায়, ইথিলিন বেশি উৎপন্ন হয়, ওজন কমে যায়। সাথে সাথে রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং গুণগতমান কমে যায়। এ ছাড়া সংগ্রহের সময়ও আলাদাভাবে নির্ধারণ করতে হয়। যেসব ফলের বোঁটা থেকে কষ বের হয় যেমন- আম, কলা, পেঁপে এসব ফল বিকেলে সংগ্রহ করা উচিত।
ফল সংগ্রহের পর পরবর্তী ব্যবস্থাপনা হলো সংগ্রহ বা সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা। এ ব্যবস্থাপনার ধাপগুলো হলো ধৌত বা পরিষ্কারকরণ, বাছাই, গ্রেডিং, শুকানো, প্যাকেজিং, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ।
সাধারণত ফলের বাহ্যিক গুণাগুণ এবং খাওয়ার উপযুক্ততার ওপর ভিত্তি করে সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস'াপনা নেয়া হয়ে থাকে। কেননা ফল সংগ্রহের পরেও ফলের জৈবিক কার্যাবলী চলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে মানের অবনতি হতে থাকে। এ অবনতির হার একেক ফলের ক্ষেত্রে একেক রকম। অধিক পচনশীল ফলের ক্ষেত্রে এ অবনতির হার বেশি। ফল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমত দৈহিক অবয়বগত ক্ষতি। এ ক্ষতির ফলে ফলের দৈহিক বিকৃতি ঘটে বা রোগ জীবাণুর আক্রমণে অপচয় হয়। ফল সংগ্রহোত্তর দ্বিতীয় প্রকার ক্ষতি হলো গুণগত মানের ক্ষতি। এ ক্ষতির কারণে ফলের শারীরতাত্ত্বিক এবং উপাদানগত পরিবর্তন সাধিত হয়।
ফল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো ধৌত ও পরিষ্কারকরণ। গাছ থেকে সাবধানে ফল সংগ্রহের পর পানিতে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে নিতে হয়। এতে ফলের গায়ের ময়লা ও রোগ জীবাণু দূর হয় ও তাপমাত্রা কমে যায়। কষমুক্ত ফলের কষ পড়া বন্ধ হয় এবং ফলের গায়ের কষও পরিষ্কার হয়।
ফল ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার পর অপরিপক্ব, বিকৃত আকারের, গাদওয়ালা, রোগাক্রান্ত, পচা, পোকামাকড় দ্বারা নষ্ট এসব ফল বাছাই করে আলাদা করে নিতে হয়। এরপর বাছাইকৃত ভালো ফলগুলোকে চাহিদা অনুযায়ী আলাদা করে নিতে হয়।
প্যাকেজিং
ফল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় আর একটি বিশেষ ধাপ হলো প্যাকেজিং। এর উদ্দেশ্য হলো- আঘাত থেকে ফলকে রক্ষা করা। সাথে সাথে পরিবহন ও বাজারজাত সহজতর করা এবং ফলকে আকর্ষণীয় করা। প্যাকেজিংয়ের জন্য ফসল ভিত্তিতে কার্টনের বাক্স, কাঠের বাক্স বা প্লাস্টিকের বাক্স, চটের ব্যাগ, বাঁশ বা বেতের ঝুড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। বিদেশে রফতানি করতে হলে বাক্সের সাইজ ও তাতে ফলের সংখ্যা ও ওজন অবশ্যই আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী হতে হবে। প্যাকেটের ভেতর দুটি ফলের মধ্যে কাগজ বা বোর্ড দ্বারা লাইনিং ব্যবহার করা উচিত যাতে ঘর্ষণে ফল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
বাংলাদেশে সাধারণত ফল পরিবহনে ট্রাক, ভ্যান, রিকশা, নৌকা, গরুর গাড়ি, সাইকেল এসব ব্যবহার হয়ে থাকে। স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য মানুষ কাঁধে ফল নিয়ে আসে। কিন' ফলের বাহ্যিক অবয়ব ও গুণগত মান ঠিক রাখার জন্য প্যাকিং করার পর প্যাকেটটি অবশ্যই কুলিং ভ্যান এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ও আপেক্ষিক আর্দ্রতায় পরিবহনের ব্যবস'া নিতে হবে।
সংরক্ষণ
পচনশীল বলে অধিকাংশ ফল আমরা মাঠ থেকে সংগ্রহ করার সাথে সাথে কিংবা কয়েকদিনের ভেতরে খেয়ে ফেলি। সময়মতো না খেলে এগুলো পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাই মৌসুমে উৎপাদিত ফল দেরীতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা কিছু সংরক্ষণ কৌশল অবলম্বন করতে পারি।
আমরা জানি উদ্ভিদের (পাতা, কাণ্ড, ফল) বিপাক প্রক্রিয়াসমূহ বিভিন্ন জারক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই কোনো প্রকারে জারক দ্রব্যের এবং জীবাণুর কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারলেই পচনশীল দ্রব্য দ্রুত পচনের হাত থেকে রক্ষা পায়। এ জন্য আমরা বিভিন্ন সংরক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকি।
ফল সংরক্ষণ মূলত তিন প্রকার। যথা-
১) টাটকা অবস্থায় সংরক্ষণ
২) শুকিয়ে সংরক্ষণ
৩) প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ।
(১) টাটকা অবস্থায় সংরক্ষণ
ফল সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে নিম্ন তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতায় রাখা হয়। এতে ফলের স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমান প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। নিম্ন তাপমাত্রার কারণে ফলের মধ্যকার জারকের ক্রিয়া সীমিত থাকে এবং উচ্চ আর্দ্রতার কারণে এগুলো শুকিয়ে সংকুচিত হয় না। আঙ্গুর, আপেল, আনারস, কমলালেবু, কাঁঠাল, নাশপাতি ইত্যাদি ফল টাট্কা অবস'ায় সংরক্ষণ করা যায়।
(২) শুকিয়ে সংরক্ষণ
রসাল হওয়ার কারণে ফলে দ্রুত পচন ধরে। তাই শুকিয়ে ফলে পানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলে এগুলো সহজে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় না। সঠিক মাত্রায় শুকিয়ে নিয়ে যেসব ফল সংরক্ষণ করা যায় সেগুলো হলো -আঙ্গুর, খুবানী, ডুমুর, নাশপাতি, খেজুর, কুল ইত্যাদি।
(৩) প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ
প্রক্রিয়াজাত করেও ফল সংরক্ষণের বহু পদ্ধতি প্রচলিত আছে। প্রক্রিয়াজাত করার দরুন ফলের মূল গঠন পরিবর্তিত হয় এবং পচন থেকে রক্ষা করার জন্য কোন না কোন মাধ্যম বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করতে হয়। ফল প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘদিন ঘরে রেখে খাওয়া যায়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রক্রিয়াজাত করে এটি একটি ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন তথা আত্মকর্মসংস'ানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেতে পারে। এখানে ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ বা সংরক্ষণের কয়েকটি মাধ্যম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।
ক. চিনি ও লবণের দ্রবণে ফল সংরক্ষণ : আনারস, লিচু, আম, পেঁপে, কমলা, নাশপাতি, আঙ্গুর ইত্যাদি ফল চিনি ও লবণের দ্রবণে সংরক্ষণ করা যায়।
খ. রস আকারে ফল সংরক্ষণ : লেবু, আনারস, আপেল, আম, আঙ্গুর ইত্যাদি ফলের রস তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়।
গ. জ্যাম, জেলি : আম, আনারস,আপেল, পেয়ারা, আঙ্গুর ইত্যাদি ফলের জ্যাম জেলি এসব করা যায়।
ঘ. আচার, চাটনি : আম, জলপাই, কুল, কাগজি লেবু, করমচা, তেঁতুল আমলকী ইত্যাদি ফলের আচার, চাটনি করা যায়।
ঙ. মোরব্বা : পেঁপে, আমলকী, আনারস ইত্যাদি ফলের মোরব্বা করা যায়।
বাজারজাতকরণ
ফল আবাদ উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমাদের দেশে সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ বা বিপণন ব্যবস্থাগড়ে না উঠায় উৎপাদকগণ প্রায়শই পণ্যের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।
বাজারজাতকরণের অন্তরায়
ক.অবাণিজ্যিক উৎপাদন ব্যবস্থা,
খ. ক্ষুদ্র খামার,
গ. হাটবাজারের উন্নয়ন,
ঘ. সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন,
ঙ. ফল উৎপাদন কৌশলের উন্নয়ন,
চ. সঠিক পর্যায়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ।য়
তথ্যসূত্র: কে. এম. লোকমান,উপ-পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস শক্তিশালীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প, বিভাগীয় দপ্তর, চট্টগ্রাম