কৃষি-৪২: বহুস্তরি মিশ্র ফল বাগান

দুরন্ত বিপ্লব
Published : 4 Dec 2011, 10:53 AM
Updated : 4 Dec 2011, 10:53 AM

বাংলাদেশে বিচিত্র রকমের ফলের প্রজাতি রয়েছে। ফল ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অন্যতম উৎস। মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ ও খনিজ লবণের গুরম্নত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশের ফল মৌসুমভিত্তিক। অধিকাংশ ফলই যেমন- আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, আনারস এসব বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পরিপক্ব হয় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই এদের প্রাপ্যতা শেষ হয়ে যায়।

দেশীয় অনেক অপ্রচলিত ও স্বল্পপ্রচলিত ফল যেমন : কুল, আমড়া, আতা, আমলকী, বেল, জলপাই, সফেদা, ডালিম, কামরাঙা ইত্যাদি বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎপাদিত হয়ে থাকে। কাজেই প্রধান ফলের সাথে এসব অপ্রধান ফলের মিশ্র বাগান তৈরি করা গেলে একদিকে যেমন অল্প জমিতে অধিক ফল পাওয়া যাবে তেমনি সারা বছর ফল ও পুষ্টি জোগানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনেও তা সহায়ক হবে।

কিভাবে মিশ্র ফল বাগান তৈরি করবেন

মিশ্র ফল বাগান তৈরির আগে যে বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে- এ বাগান থেকে সারা বছরই যাতে কোনো না কোন ফল সংগ্রহ করা যায়, বাড়তি আয় করা যায় এবং পারিবারিক পুষ্টি সরবরাহ করা যায়। এজন্য আগাম, মধ্য ও নাবী জাত লাগিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ফল সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। নিচের ছকে এ ধরনের কিছু জাতের উলেস্নখ করা হলো।

বহুসত্মর বিশিষ্ট ফল বাগান কাঠামো

আমাদের দেশের ক্রমহ্রাসমান মাথাপিছু জমির কথা চিনত্মা করে এই বহুসত্মরী ফল বাগান তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এই বহুসত্মরী মডেলের প্রবর্তক। এখানে ফলদ ও বনজ গাছের সাথে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের মিশ্র চাষের সমন্বয় ঘটানো হয়। এতে কয়েকটি সত্মর বিশিষ্ট উলম্ব চাষ বিন্যাস রূপানত্মরের মাধ্যমে বহুসত্মর বিশিষ্ট ফার্ম বাগান তৈরি করা হয়। এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বৃড়্গরাজি বিভিন্ন সত্মর থেকে সূর্যালোক গ্রহণ করে এবং এদের মূল বিভিন্ন গভীরতা থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে থাকে। ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের (আলো, পানি, পুষ্টি উপাদান) সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রড়্গা পায়।

বাংলাদেশের জন্য উপযোগী বহুসত্মর বিশিষ্ট বাগান হতে পারে এরকম- ভূমিসংলগ্ন লতাপাতা সমৃদ্ধ নিম্নসত্মর, বৃড়্গ সমৃদ্ধ উপরের সত্মর এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সত্মর নিয়ে বসতবাড়ির বহুসত্মর বাগান।

নিচের সত্মরটিকে দু'টি ভাগে ভাগ করে ১ মিটারের কম উচ্চতা বিশিষ্ট সর্বনিম্নসত্মরে শাকসবজি ও ঔষুধি গাছ এবং ১-৩ মি. উচ্চতায় কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু এসব চাষ করা যেতে পারে। উপরের সত্মরে সু-উচ্চ কাঠাল ও ফলদী বৃড়্গ যেমন- আম, কাঁঠাল, নারকেল ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে।

নারকেল বাগানে ৩ সত্মর বিশিষ্ট ফসল চাষ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ এই ৩ সত্মর বিশিষ্ট বাগান তৈরি করেছে। এতে ১ম সত্মরে আদা/হলুদ/আনারস, ২য় সত্মরে কলা এবং ৩য় সত্মরে নারকেল গাছের সমন্বয়ে ৩ সত্মর বিশিষ্ট বাগান তৈরি করা হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে অত্যনত্ম লাভজনক।

চার বছর গবেষণার পর দেখা গেছে নারকেল থেকে প্রতি বছর হেক্টরপ্রতি প্রায় ৪০ হাজার টাকার মত আয় হতো। সেই একই বাগানের বহুসত্মরী ফসল বিন্যাস (নারকেল+কলা+আনারস/ আদা/কচু) থেকে প্রায় ১,৩০,০০০-১,৮০,০০০/- টাকার মতো আয় করা যায়।

আম বাগানে তিন সত্মর বিশিষ্ট ফসল চাষ আম বাগানে পেঁপে এবং আনারস ভালো জন্মে। আম বাগানে পেঁপে গাছের নিচে আনারস সফলভাবে ফলানো সম্ভব হয়েছে। এতে আর্থিক লাভও প্রচুর।

চার বছর গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রতি বছর শুধুমাত্র আম থেকে হেক্টরপ্রতি ৮০ হাজার টাকার মতো আয় হয় কিন্তু বহুসত্মর বিশিষ্ট ফল বাগান (আম+পেঁপে+আনারস) থেকে আমের অনুৎপাদন মৌসুমে ১ লাখ ৩০ হাজার এবং উৎপাদন মৌসুমে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার মতো লাভ পাওয়া যায়।
উদ্ভিদ/ফসল নির্বাচন

বহুসত্মর বিশিষ্ট ফল বাগানের উদ্ভিদ নির্বাচন অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। এরূপ বাগানের কিছু গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয় নিচে উলেস্নখ করা হলো-
০ যেন তেন নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ না করে সফল মাতৃগাছের বাগান থেকে চারা কলম সংগ্রহ করা উচিত।
০ নির্বাচিত বিভিন্ন ফসল/উদ্ভিদ এর সমন্বয় এমন হওয়া দরকার যেন ফসল উৎপাদন চক্র এবং মাত্রা সারা বছরই বজায় রাখতে পারে।
০ বাগানে ছায়া পছন্দকারী বা ছায়াসহ্যকারী উদ্ভিদ/ফসল রাখতে হবে।

পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা

সর্বাধিক ও সারা বছর ফল পেতে বহুসত্মর বিশিষ্ট ফল বাগানের ব্যবস্থাপনা অত্যনত্ম জরম্নরি। চারা রোপণ থেকে সর্বশেষ ফসল সংগ্রহ পর্যনত্ম সঠিক উদ্যানতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা আবশ্যক। গাছের নিয়মিত অঙ্গ ছাঁটাই, সার, সেচ, পানি নিষ্কাশন ইত্যাদি কাজগুলো সঠিকভাবে করা গেলে প্রতিটি গাছ থেকে এর ফলও বিভিন্ন উপজাতসহ সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যাবে।

ফল, জ্বালানি, আসবাব তৈরির কাঠ ও বহুবিধ কৃষি সামগ্রী পাওয়ার সাথে সাথে পরিবেশগত ভারসাম্য রড়্গার জন্য বসতবাড়িতে এবং ফলের বাগানে বহুসত্মর বিশিষ্ট ফসল চাষ করা দরকার। উদ্ভাবিত মডেল বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের আম, পেয়ারা, সুপারি এবং লিচু বাগানে, পূর্বাঞ্চলের কাঁঠাল বাগানে এবং বাংলাদেশের বনাঞ্চলের জন্য অত্যনত্ম উপযোগী।

তথ্যসূত্র: কৃষিবিদ মো. রেজাউল হক