ড. ইউনূসকে নিয়ে নাটক নয়, চাই ক্ষুদ্রঋণের সু-ব্যবস্থাপনা

জাগো বাহে জাগো
Published : 23 Feb 2012, 01:55 PM
Updated : 23 Feb 2012, 01:55 PM

কাল একটি সংবাদে চোখ আটকে গেলো । ভাবছিলাম, সত্যি দেখছিতো? সংবাদটি ইতোমধ্যে বোধহয় সবাই জেনে গেছেন । ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান করার জন্য সফরকারী ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলকে প্রস্তাব করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তার এ প্রস্তাবের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন নাকি খোদ প্রতিনিধি দল ।

বিশ্বব্যাংকের মতো একটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট হতে পারলে দেশের জন্য তিনি বিরল সম্মান আনতে পারবেন আর দরিদ্র দেশগুলোও বিশেষ সুবিধা পাবে বলে কেউ হয়তো ধারণা করছেন। আর কেউ হয়তো আরো বাড়িয়ে, প্রস্তাবের বিষয়টিকে তার উদারতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করবেন ।

এখন প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি মনে-প্রানে সচেতনভাবেই ড. ইউনূসকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান হিসেবে দেখতে চান ?

এখানে দুটো বিষয় আমরা দেখি । ড. ইউনূসের সাথে গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে সরকারের টানাপোড়েন আর পদ্মাসেতুর কথিত দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের টানাপোড়েন । ড. ইউনূস এর ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বড় কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তেমন কোন মন্তব্য আমরা শুনিনি যতক্ষণ না তিনি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনীতিতে নামার ঘোষণা দিলেন । ২০১০ এর শেষদিকে যখন নরওয়ের টিভিতে ড. ইউনূসের গ্রামীন ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হলো তারপর এ ইস্যুটি ভিন্ন মাত্রা পেলো । তখনতো এমন হয়ে দাড়ালো ইউনূসের নাম আর 'সূদখোর' কথাটি একার্থক করে ফেললো সরকারী দলের বড়ো বড়ো নেতা কর্মী থেকে শুরু করে খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত । তখনকার অনেক বক্তৃতায়ই তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ 'সুদখোর' কে নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন । 'গরীব মানুষের রক্ত চুষে খেলে ধরা খেতে হয়' তার এ উক্তিটি হয়তো অনেকেরই মনে আছে । সুদখোরদের নিয়ে তার ঐ উপলব্ধিকে তখন অনেকেই বেশ পজিটিভ ভাবে নিয়েছিলো এ ভেবে যে ক্ষদ্রঋণ পদ্ধতির অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে দেশে 'রক্তচোষা'রা কিভাবে রক্ত চুষে যাচ্ছে তা নিয়ে এবার তদন্ত হবে । কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে অপারগ ব্যক্তির বাড়ির টিন কেন খুলে নেয়া হচ্ছে, হাঁস-মরগী খোঁয়ার সহ তুলে নেয়া হচ্ছে বা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কেন দরিদ্র মানুষ আত্মহত্যা করছে তা আর দেখা হয় না, এবার বোধহয় দেখা হবে । তখন মনে হয়েছিলো, ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় বিরাজমান অব্যবস্থাপনায় শোষনের যে পথ তৈরি হয়েছে তার অবসানে বোধহয় প্রধানমন্ত্রী একটা কিছু করতে যাচ্ছেন ।

কিন্তু আদালতের রায়ে ড. ইউনূস গ্রামীন ব্যাংক থেকে অপসারিত হলে সবকিছু আবার হালকা হয়ে যায় । পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে যে সমস্যা চলছে, সরকারের ধারণা এতে নাকি ড. ইউনূসের হাত রয়েছে । তাহলে এমন কি হলো যে ইউনূসকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাটকীয় ইচ্ছা জাগ্রত হলো ! যিনি 'সুদখোর' 'গরীবের রক্তচোষা' হিসেবে তার কাছে প্রমানিত তাকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করার প্রস্তাব তিনি কি করে দেন ! দু দবার নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীর এ জ্ঞানটা ভালোই থাকার কথা যে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান কখনো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে কখনো হয়নি এবং তারা তা করবেও না । আর তার প্রস্তাবটা কিন্তু আমেরিকান কোন সিনেটর বা প্রতিনিধিদলকে করা হয় নি, করা হয়েছে জিন ল্যাম্বার্টের নেতৃত্বে একটি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট দলের কাছে ।

মজার বিষয়, ইউরোপীয়দের কাছে কিন্তু আইএমএফ এর নিয়ন্ত্রন, বিশ্বব্যাংকের নয় । এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রধান হবার দৌড়ে যারা যায় তাদেরকে একটা রীতিমত নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় । একজন মুখে মুখে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয় এমন কোনপক্ষকে প্রস্তাব দিলো আর তাকে বিশ্বব্যাংকের প্রধান করে ফেলা হবে তা কিন্তু নয় ।আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাঝে মধ্যেই মজা করে কথা বলেন । বিশেষ করে এটা তিনি করেন দলীয় সাংসদ বা মন্ত্রী-আমালাদের সাথে । তার প্রানবন্ত, প্রাঞ্জল অনেক বক্তব্য আমরা বিভিন্ন সময়ে উপভোগ করেছি । কিন্তু তিনি ড. ইউনূসকে নিয়ে এ ধরণের প্রস্তাব ইউরোপীয় প্রতিনিধিদলের কাছে দিয়ে নিশ্চয়ই মজা করতে চাননি । কেন তিনি এটা করেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন ।

আমাদের দেশের গরীব জনগনকে ঠকিয়ে বা তাদের সর্বশ্বান্ত করে এ যুগের কাবুলীওয়ালারা আখের গোছাবে তা হতে পারে না । এখনই সময় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ।

ড. ইউনূসকে নিয়ে নাটকীয়তা না করে তার আবিস্কৃত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম নিয়ে যে অব্যবস্থাপনার কথা বলা হয় তা ঠিক করতে হবে আগে । আজ সারা বাংলাদেশে অর্থ ঋণ দেয়ার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে । বড়ো কিছু এনজিও'র সাথে সাথে অসংখ্য ছোট ছোট ঋণদান প্রতিষ্ঠান পুরো দেশটাকে গ্রাস করে ফেলেছে । গ্রামে গঞ্জের হাট-বাজারে গেলেও দেখা যাবে লোকজনকে টাকা ধার দেবার জন্য অনেক মালটিপারপাস, বিভিন্ন রকম সমিতি বসে আছে । জমানত ছাড়াই তারা টাকা দেবে আর সুদে-আসলে তা আদায় করে নেবে উচ্চ হারে । টাকা দিতে অপারগ হলে নিগৃহীত হতে হবে তাদের হাতে ।

আমাদের দেশের গরীব জনগনকে ঠকিয়ে বা তাদের সর্বশ্বান্ত করে এ যুগের কাবুলীওয়ালারা আখের গোছাবে তা হতে পারে না । এখনই সময় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ।