ভর্তুকির মারপ্যাঁচ বনাম তড়িতাহত জনগন

জাগো বাহে জাগো
Published : 31 March 2012, 01:51 AM
Updated : 31 March 2012, 01:51 AM

অবশেষে সে খবরটি এলো। যে সংবাদটির অপেক্ষায় দিন গুনছিলো মানুষগুলো একমাস ধরে। এ অপেক্ষাটা কোন সুসংবাদ শোনার অপেক্ষা নয়। তাদের জীবন যাত্রার অন্যতম প্রয়োজনীয় জিনিস বিদ্যুৎ এর মূল্য বৃদ্ধি এর জন্য এ অপেক্ষা। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় এ সংক্রান্ত আভাস পাওয়া যায়, তবে খবরটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার দায়িত্বে যে সংস্থা, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) ঘোষনাটা বাকি ছিলো। ১৯ মার্চ গনশুনানির দিনে(পাইকারী বিদ্যুতের জন্য)স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো যে শীঘ্রই তারা জনগনকে আবার এ উপহারটি দিতে যাচ্ছেন।

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ২৯ তারিখ বিকেলে বিইআরসি'র চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন দাম বৃদ্ধির ঘোষনাটা প্রকাশ করলে, মানুষগুলো বুঝতে পারে যে, অল্প সময়ের ব্যবধানে সরকার তাদের দ্বিতীয়বারের মতো তড়িতাহত করতে যাচ্ছেন।

এর আগে গত ২২ ডিসেম্বর সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়। দুই ধাপে ওই মূল্যবৃদ্ধির শেষ ধাপ গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়। ওই সময় সাত দশমিক ০৯ ভাগ হারে দাম বেড়েছিল। মার্চে এসেই আরও এক দফা দাম বৃদ্ধির ধাক্কায় এক মাসের ব্যবধানেই গ্রাহকের বিদ্যুৎ বাবদই খরচ বেড়ে গেল ১৩ দশমিক ৩৪ ভাগ।

গ্রাহক পর্যায়ে সব শ্রেণীর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো ৩০ পয়সা। একই সঙ্গে পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ২৮ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৩২ পয়সা। পাইকারি মূল্য ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়ে গড়ে ৩ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বেড়ে ৪ টাকা দুই পয়সা হয়েছে। একই সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দামও ১৩ পয়সা বাড়ানো হয়েছে।

প্রতিবার বিদ্যুৎ এর দাম বাড়ানোর সময় সংবাদ-মাধ্যমে যে বক্তব্য দেয়া হয় এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উপরন্ত 'কি করিলে কি হইতো এবং কি হইতে পারে'এ সংক্রান্ত জ্ঞানও সাংবাদিকদের বিতরণ করে গেছেন বিইআরসি এর সম্মানিত চেয়ারম্যান সাহেব। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন জরুরী এবং কেন বিদ্যুতের দাম তারা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন তার ভাল ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন।
কিন্তু গ্রাহককে কেন চলতি মাস থেকেই বর্ধিত হারে বিল দিতে হবে তার সদুত্তর দিতে পারেননি। কমিশনের আইন অনুসারেই যেখানে দাম বাড়ানোর আগে গনশুনানি করা বাধ্যতা মূলক সেখানে খুচরা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি, করা হয়েছে পাইকারী বিদ্যুতের ক্ষেত্রে। এরও তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।

তথ্য অনুসারে, উৎপাদন ব্যয় এর সাথে বিক্রয়মূল্যের ব্যবধানের জন্য গত বছর চারহাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে সরকারকে। বিশাল ক্ষতি নিঃসন্দেহে।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে সরকার কি করতে পারে। সরকার তো আর ইচ্ছে করে এমনটি করছে না। একান্ত বাধ্য হয়েই না করছে। মানলাম খুব বাধ্য হয়েই করছে।

জ্বালানী তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য বেড়েছে কয়েক দফায় এটাও মানলাম। কিন্তু এর প্রভাব শুধু একচ্ছত্র আমাদের দেশেই পরিলক্ষিত হবে, জনগন এর দায়ভার গ্রহন করবে! পৃথিবীর অন্য কোন দেশে ৩ বছরের মধ্যে ৫ বার এবং এক মাসের ব্যবধানে দুবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মতো এমন মহান রেকর্ড কি আছে!

এদিকে কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ বেশিরভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তেলের উপর নির্ভরশীল বলে জনগনকে এর মাশুল দিতে হচ্ছে। তড়ি-ঘড়ি করে প্রায় অর্ধশতাধিক কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে চুক্তি করে সরকার। ইতোমধ্যে ১৮ টি কেন্দ্র তাদের উৎপাদন শুরু করলেও দেশের চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। উপরন্ত তাদের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার জের টানতে হচ্ছে জনগনের পকেট থেকে। এখন বলা হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নাকি সুবিধা আমাদের জন্য। এ চিন্তা থেকে সরকার দেশের বিভিন্ন স্হানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যৃৎকেন্দ্র নির্মানে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের একটি নীতি পরবর্তীতে কি ফল বহন করবে তা বাস্তবায়ন করার আগে চিন্তা করা হয় না। সে চিন্তাটুকু করা হলে আজ বিদ্যুৎ নিয়ে এমন বেহাল অবস্থায় পড়তে হয় না। তড়িঘড়ি করে কুইকরেন্টাল এর মতো কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র গুলো ভবিষ্যতে কি অবস্থায় পড়বে তা যাচাই বাছাই করা হচ্ছে কিনা জানা নেই। তা না হলে সুন্দর বন সংলগ্ন এলাকায়(বাগেরহাটের রামপাল এ)কয়লা ভিত্তিক বড় ধরণের প্রকল্পে হাত দেবার সাহস কি করে পায় নীতি নির্ধারক গন এটা ভাবতে আশ্চর্য লাগে!

নিম্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত বিশেষ করে দেশের ভাড়াটিয়া শ্রেনী, তারা বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাবার আতংকে দিন কাটাচ্ছে। এমনিতেই ইতোমধ্যে বাড়ি ভাড়া অনেক বেড়েছে তারপর যদি মাস গেলে মোটা অংকের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় তাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হবে। শিল্প-কলকারখানার কথা না হয় বাদই দিলাম, কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। কৃষি খরচের মূল্য বাড়া মানে সমস্ত দেশের কৃষিজাত দ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধি পাওয়া। এর প্রভাব সারা দেশের বাজারেই পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। জনগনের জন্য আর বেশি ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাও নাকি ভতুর্কি প্রথার বিরূদ্ধে। এ ভর্তুকিতে সরকারের উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হয়, দেশ নাকি ক্ষতিগ্রস্থ হয় চরম ভাবে। তাই সরকারের এ সচেতন চিন্তা এবং তার প্রয়োগকে অনেকেই হয়তো সাধুবাদ জানাবেন।

কিন্তু সাধারণ মানুষ ভর্তুকি বুঝে না, বুঝে না বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক সমীকরণ, বুঝে না সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয় এর খাত, বুঝে না বৈদেশিক সাহায্যের মারপ্যাঁচ। অর্থনীতির বড় বড় বই না পড়েও তারা অর্থনীতির একটা জিনিস জনগন খুব ভালো বুঝে তা হলো 'মুল্যস্ফীতি' । বাজারে দাম যখন বাড়ে আর পকেট থেকে টাকা যখন বেশি ঢালতে হয়, তখন তারা নিজের চিন্তা ভাবনার দ্বারাই দেশের সরকার ব্যবস্থাকে অনুভব করার চেষ্টা করে, দেশের অর্থনীতিকে বুঝার চেষ্টা করে। প্রতিটি সেবা বা দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিই জনগনকে রীতিমতো ব্যাথিত করে, ক্ষুব্ধ করে। বিদ্যুৎ এর ব্যবহার হয়তো কমানো সম্ভব কিন্তু বিদ্যুৎ বিহীন তো থাকা সম্ভব না। জীবনের সাথে আমৃত্যু জড়িত হয়ে গেছে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়টি। তাই পরপর বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি আহত করেছে জনগণকে। তারা রীতিমতো হয়েছে তড়িতাহত। তাদের নিয়তি এখন এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, কিছুদিন পর পর ভর্তুকি কমানো কার্যক্রমের ফলস্বরূপ তাদের এরকম ভাবে তড়িতাহত হয়ে যেতেই হবে।

× ছবি: ইন্টারনেট থেকে নেয়া।