ক্লাশ টেন-এ পড়বার সময়ে আমাদের এক স্যার এসেছিলেন। বেজায় পান খেতেন তিনি। ফলে পানের রসে মুখ ভরে উঠত। সেই রস মুখে নিয়ে পড়াতে গিয়ে উচ্চারণ হতো অদ্ভুত। বিদ্যাসাগর বলতে গিয়ে 'বিদ্যা' টুকু ঠিকই বললেন তারপরে 'সা' বলতে গিয়ে মুখে রস ধরে রাখা হচ্ছে না বলে শেষটুকু বললেন 'হাগর'। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবার দশা। সেই থেকে ওঁর নামই হয়ে গেল 'বিদ্যাহাগর' স্যার।
ক্লাশ নাইন-টেনে কয়েকজন আপার ক্লাশ খুব ভালো লাগত। আয়েষা আপা পড়াতেন ভূগোল। ওঁর কাছে প্রাকৃতিক ভূগোলের, নরম মাটিতে শিলাময় মাটির চাপে কীভাবে ক্রমে ভঙ্গিল পর্বত তৈরি হয় পড়েছিলাম, আজও ভুলিনি। হালিমা আপা পড়াতেন ইতিহাস। গল্পগুলো চমৎকার আয়ত্ত হয়ে যেত। একবার ক্লাশ পরীক্ষা নেবেন বলে খুব তৈরি হয়ে গিয়ে লিখলাম। মনে হয়েছিল যা লিখলাম এর চেয়ে ভালো আর লেখা যায় না। অধীর আগ্রহে খাতার অপেক্ষা করতে থাতলাম। পরের ক্লাশে খাতা এনে ডেকে বললেন–"ভালোই লিখেছ। কিন্তু শুদ্ধ বাংলাতে 'তলে তলে' লেখা যায় নাকি? পড়াবার সময়ে উনি অবশ্য বলেছিলেন ওই বাক্যাংশ শিবাজির অনুচরেরা যে তাঁদের নেতাকে কারাগারে ফলের ঝুড়ি পাঠাতেন, সেই সময়ে 'তলে তলে' ফন্দি করে খালি ঝুড়িতে করে শিবাজিকে বার করে নিয়ে পালিয়ে গেলেন-এই ঘটনা বলতে আপা 'তলে তলে' ব্যবহার করেছিলেন। তবে বলার ভাষা আর লেখার ভাষা যে এক হওয়া উচিত নয়, তা আমি বুঝতে পারিনি। এই ধাক্কায় জানা হলো। আর এখন এরকম কত শব্দই সবাই অকাতরে লিখছে- তাদের শেখাবে কে।
ক্লাশ টেনে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পড়াতেন জোবেদা রহিম নামের এক মহিলা। ক্লাশটা হতো বিকালে। প্রতিদিন ক্লাসের সময় হলে
দোতলার বারান্দা থেকে আমরা দেখতাম উনি পুকুর পাড় ধরে শর্টকাট করে চলেছেন নিজের বাসার দিকে। দেখে দেখে সয় না আর। আমাদের ক্লাশের আরতি মুখোপাধ্যায় (বুড়ি) বেশ ইংরেজি বলতে পারত। ও একদিন বলল 'চলো আমরা প্রিন্সিপ্যালের কাছে গিয়ে কমপ্লেইন করি'। প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন ইডেনের আগেকার ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল মিসেস উইলস। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা। এরই নামে কাকরাইলের দিকে উইলস্ কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। উনিই স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা। তো বুড়ির পিছু আমরা কয়েকজনও গেলাম মিসেস উইলসের কাছে। মুখপাত্রই কথাবার্তা বলে ওঁকে দেখিয়ে দিল শিক্ষক বাড়ির দিকে চলেছেন এবং রোজই চলছে এরকম। দাই পাঠিয়েও তাকে ধরা গেল না। পরদিন এলেন তিনি ক্লাশে–থমথমে মুখ। শাস্তি হিসেবেই আমাদের একটি প্যারাগ্রাফের সারমর্ম লিখতে দিলেন। বাংলাতে আমার লিখতে বাধা নেই কোনো। সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিয়ে আগেভাগে জমা দিলাম। মহা রেগে গেলেন-'এসব কী লিখেছ। কীরকম ভাষা।' খাতা ফিরিয়ে এনে একই কথা সহজ চলতি ভাষায় লিখে নিয়ে গেলাম। এবার বললেন–'এই তো বেশ হয়েছে। আগে ও কী লিখেছ'। ভালো মন্তব্য লিখে দিলেন। আমি তখন মনে মনে হাসছি একই লেখা দুরকম করে লিখলে একটা ঠিক আর একটা যাচ্ছেতাই হয় কেমন করে। বন্ধুদের দুই লেখা দেখিয়ে নিজেরা নিজেরা খুব হাসাহাসি করলাম। ওই মহিলা বেজায় করিৎকর্মা ছিলেন। রেডিওর জন্যে নাটক লিখতেন। কিছুদিনের ভিতরে স্কুলের চাকরি ছেড়ে নানাবিধ কাজ করে সুখ্যাত হয়ে উঠলেন। একসময়ে শিশু একাডেমীর পরিচালকও হয়েছিলেন। ততদিনে অবশ্য আরেকটি বিবাহ করে জোবেদা রহিম হয়ে গেছেন জোবেদা রব। শিমু একাডেমী থেকে ছোটদের দলনেতা হয়ে বার্লিন টার্লিন ঘুরে এসেছিলেন। একে শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা করতে পারিনি একেবারে। সে কথা ভেবে এখন খারাপ লাগে।
স্কুলের পুকুরটির একটি বাঁধানো ঘাট ছিল। মাঝে মাঝে সেখানে নিচের সিড়ির কাছে ঘাটের পানিতে ছোট্ট ছোট্ট মাছ ঘুরে বেড়াত, দেখতাম সাগ্রহে। এ স্মৃতি মনে স্পষ্ট হয়ে আছে। ইডেন বিল্ডিংস ভবনের চেয়ে এ স্কুলের পরিবেশ ভালো ছিল।
সবসময়ের অভ্যাস অনুযায়ী স্কুলের ছোট মেয়েদের সঙ্গে বেশ ভাব হতো আমার। ক্লাশ ফাইভের মোসলেমাকে খুব ভালো লেগেছিল আমার। গান গাইত বলেই হয়তো ভাব জমেছিল। ওই বয়সেই মোসলেমা শাড়ি পরে স্কুলে আসত। দোতলা থেকে নেমে মাঠে গিয়ে ওর সঙ্গে গল্পসল্প করতাম। একদিন শুনি ওর নাকি বিয়ে। আমার মনে হতো, বিয়ে হওয়া মানে ওখানেই জীবন শেষ। লক্ষ করলাম তার কোনো আপত্তি নেই বিয়েতে। আসলে পারিবারিকভাবে এক একজন ওইরকম ভাবনাচিন্তা নিয়েই বড় হয়। বিয়ে হবে তা বেশ, সে তো হতেই পারে। ওটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার কিন্তু ওর বিয়ে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। এই মোসলেমারই বড়ো মেয়েটি চমৎকার নজরুলগীতি গাইত। ওর নাম রেবেকা সুলতানা। পরের মেয়ে আবেদা সুলতানাও সুন্দর নজরুলগীতি গাইত। পরে আবেদা চলে গেল আধুনিক গানে। মোসলেমার আরেকটি মেয়ে গিটার বাজায়। অর্থাৎ বিয়ের পরেও চমৎকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল ওর বাড়িতে। আমি অযথা ভাবনা করেছিলাম।
(চলবে )
কিস্তি-১
কিস্তি-২
কিস্তি-৩ স্কুলের দিনগুলো: ইডেন স্কুলে
কিস্তি-৪ স্কুলের দিনগুলি: ইডেন স্কুলে
কিস্তি-৬ স্কুলের দিনগুলো: কামরুনসেসা স্কুলে