বাড়ছে মানুষ, কমছে ফসলি জমিঃ প্রয়োজন বিকল্প শস্য ভাণ্ডার

Published : 11 August 2015, 04:50 AM
Updated : 11 August 2015, 04:50 AM

৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৬ কোটি (মতান্তরে ১৮ কোটি) মানুষ। প্রতি বর্গমাইলে ২৮৫৭ জন। বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২ % বা তার কাছাকাছি। নিরন্তর বাড়ছে মানুষ আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে কমছে ফসলী জমি। এখন যদিও বলা হচ্ছে আমরা খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ন, কিন্তু কথাটায় বিশাল শুভংকরের ফাঁক আছে। খাদ্যে যদি আমরা স্বয়ং সম্পূর্নই হবো তাহলে ব্রাজিল থেকে হাজার হাজার টন গম (পচা) আমদানী করা হল কেন? মোদ্দা কথা হল আমরা হয়তো ধান উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ন কিন্তু অন্যান্য খাবারে আমরা প্রকৃতপক্ষে আমদানী নির্ভর। আবার দিন দিন ধান উৎপাদন বাড়লেও সেটা একসময় এক জায়গায় এসে স্থবির হতে বাধ্য। তারপর পাল্লা দিয়ে এটাও কমবে। ইতোমধ্যেই আমরা ডাল, তেল, পিয়াজ, চিনি সহ আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি খাবারই আমদানী করছি। মানুষের মৌলিক চাহিদা গুলোর অন্যতম হল খাদ্য। বাংলাদেশে জনসংখ্যা এবং শিল্পায়ন বৃদ্ধির তোড়ে যেভাবে দিন দিন ফসলী জমি কমছে, তাতে করে পুরোপুরি খাদ্য আমদানী নির্ভর হতে আমাদের আর খুব একটা বাকী নেই। তখন আমাদের কি হবে?
সরকার আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশকে পরিনত করতে বদ্ধ পরিকর। দেশের বৈদেশিক আয়ের সিংহ ভাগ আসে গার্মেন্টস খাত থেকে। এরপর রয়েছে বিদেশে কর্মরত বিশাল জনগোষ্ঠির প্রেরিত রেমিটেন্স। সামান্য কিছু ঔষধ, সিমেন্ট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আর অপ্রচলিত দ্রব্যাদি রফতানি করেও কিছু টাকা আসে। আরও একটা বিশাল টাকা আসে জাতিসংঘ বাহিনীতে নিয়োজিত সেনা-নৌ-বিমান এবং পুলিশ বাহিনীর বেতন –ভাতা এবং সরঞ্জামাদির ভাড়া থেকে। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে শান্তি রক্ষী বাহিনীর সদস্য সংখ্যার বিচারে এক নম্বর স্থানে আছে। বছরে ব্যাটালিয়ন প্রতি গড়ে ২২ হতে ৩০ মিলিয়ন ডলার পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। এই সংখ্যা এবং ডলারের পরিমানও এক সময় কমে আসবে। যে পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা আমরা শুধুমাত্র খাদ্য আমদানীর পেছনে ব্যয় করছি, সেটা অথবা তার পেছনের খরচ কমানো গেলে হয়তো সরকারের কাংখিত সময়ের আগেই দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হতে পারে।
আফ্রিকার দেশ উগান্ডাতে এসেছি বছর খানেক হতে চলল। উগান্ডার পূর্বে কেনিয়া, উত্তরে দক্ষিন সুদান, পশ্চিমে ডি আর কঙ্গো, দক্ষিনে রুয়ান্ডা, তানজানিয়া। উগান্ডা এবং তার আশে পাশের দেশ গুলোতে ভূমির তূলনায় জনসংখ্যার পরিমান অনেক অনেক কম। এখানে লক্ষ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জমি অনাবাদী পড়ে আছে। মানুষ নেই, চাষাবাদ করবে কে? যেটুকু জমিতে চাষাবাদ হয়, তার মাত্র শতকরা ৫-১০ ভাগ চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি'র ছোয়া আছে। বাকিটা শারিরীক শ্রম আর প্রকৃতির দয়া নির্ভর চাষাবাদ। আর প্রকৃতিও এখানে অত্যন্ত সদয়। উগান্ডার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যেখানে এখন আমার বসবাস সেখানে সহ আশে পাশে হাজার হাজার বর্গমাইল এলাকায় আমি কোন সেচ নির্ভর চাষাবাদ দেখিনি। এখানকার মাটি খুব উর্বর। আর এখানে এতো ভাল এবং সময়োপযোগী বৃষ্টিপাত হয় যে, মাটিতে কিছু একটা লাগিয়ে দিলেই হল, সময় মত ঠিকই ফসল ঘরে উঠবে। বাংলাদেশ থেকে মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ঢেড়স সহ নানা জাতের সবজি'র বীজ এনে লাগিয়েছিলাম। এক ফোটা পানি দেইনি কোন গাছে। অথচ এত ভাল সবজি হয়েছে, চোখে না দেখলে নিজেই বিশ্বাস করতাম না। কাম্পালা থেকে শখের বসে ক্যাপসিকাম এর বীজ এনে লাগালাম। সেটাও বাম্পার ফলন। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জুমের ধানবীজ এনে লাগিয়েছি। ধানের চারা বেশ বড় আর সতেজ হয়েছে। আশা করছি আগামী এক-দেড় মাসের মধ্যে ধান গাছের শীষ দেখতে পাব। স্থানীয়রা প্রচুর কাসাভা, আখ, আর বিভিন্ন ধরনের সীমের বিচি

(Beens)

চাষাবাদ করে। কিছু কফি আর প্রচুর ভুট্টাও হয় এখানে। অথচ মাইলের পর মাইল ফাকা জমি পড়ে আছে। মানুষ নেই।
আমি যতটুকু জেনেছি, এখানে চাইলেই সরকার থেকে যে কাউকে চাষাবাদের জন্য জমি লীজ দেয় কিছুদিন আগে কঙ্গোর অরিয়েন্টাল প্রদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে চাষাবাদ তথা বড় ফার্ম তৈরীতে আমার আগ্রহ দেখে আমাকে ৫০০ একর জমি নামমাত্র মূল্যে লীজ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। যদি বাংলাদেশ থেকে কোন প্রতিষ্ঠান এখানে এসে আবেদন করে পরীক্ষামূলক ভাবে ১০ হাজার একর জমি নিয়ে খামার প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে আমার বিশ্বাস সেই খামার ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে লাভের মুখ দেখবে। আর এসব খামারে উৎপাদিত ফসল যদি বাংলাদেশ থেকে আমদানী করে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে সোনায় সোহাগা। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই। কিন্তু এটুকু বুঝি যে, এখানে চাষাবাদে বিনিয়োগ করে সেই চাষের ফসল যদি আমাদের দেশেই নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ঘুরে ফিরে দেশের টাকা দেশেই থাকলো। আর আমাদের একটা বিকল্প খাদ্য ভান্ডার এবং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও হল। এক ঢিলে অনেক পাখী। অথচ এমন সুযোগের কথা দেশে কেউ ভাবছে বলে আমার মনে হয় না। আমার দেশের ভাইয়েরা নৌকা অথবা জাহাজের খোলে চড়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছে, অনেকে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। আর এখানে আফ্রিকায় কি সুবর্ন সুযোগ! দেশে যেই কাজে আমরা দক্ষ অর্থাৎ কৃষিকাজ, এখানেও শুধু পরিবেশ আর আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়ে একই কাজ করা।
আসলে দেরী হয়ে যাচ্ছে। এশিয়ায় আমাদের পার্শ্ববর্তী দুয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে এখানে এসে গেছে। এখানে সরকার থেকে জমি নিয়ে বিশাল বিশাল আগ্রিকালচারাল ফার্ম গড়ে তুলছে। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি আর স্বপ্ন দেখি। হয়তো একদিন আমার দেশের মানুষও আসবে। এখানে আফ্রিকার কালো মাটিতে সোনা ফলাবে।
যদি বাংলাদেশের আগ্রহী কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান এখানে এসে কৃষি খামার গড়ে তুলতে চান, তাহলে এসে ঘুরে, দেখে যোগাযোগ করে যান। তারপর শুরু করে দেন। এখনই সময়। গেল সপ্তাহে চ্যানেল আই'য়ের জনাব শাইখ সিরাজকে দেখলাম কাম্পালায় এসেছিলেন। কেন এসেছিলেন জানিনা, তবে ধারণা করছি, কৃষি বা চাষাবাদ সংক্রান্ত কোন বিষয়ই হবে হয়তো।
দেশ থেকে কিছু অসহায় মানুষ ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে আসছে উগান্ডা, কেনিয়া আর জাম্বিয়াতে। এসে প্রতারিত হচ্ছে। অনেকে ধরা পড়ছে, অনেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। গেল সপ্তাহে দুইজনকে দেশে ফেরত যেতে সাহায্য করলাম। অনেকে আবার এখান থেকে আরও উত্তর পশ্চিমের কয়েকটি দেশ হয়ে ইউরোপে যাবার দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় এখানকার সম্ভাবনাগুলো শেষ হয়ে যাবে। কোন বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীকে আর ঢুকতে দেবে না। যেমন জাম্বিয়াতে আমাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না কারন আমাদের দেশী ভাইয়েরা জাম্বিয়া হয়ে এত বেশী পরিমান মানুষ দক্ষিন আফ্রিকাতে পাচার করেছেন যে, জাম্বিয়া সরকার আমাদের দেশকে কালো তালিকাভূক্ত করে রেখেছে।
আমি চাতক পাখীর মত চেয়ে আছি, যেন বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যাক্তিরা একটু উদ্যোগ নেন যাতে আমাদের দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া মানুষের পরিবর্তে ভাল বিনিয়োগকারীরা এসে এখানে বিনিয়োগ করেন এবং এর সুফল আমরা দেশে নিয়ে যেতে পারি।
আফ্রিকার অনেক দেশে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছেন, অনেকে এখনও আছেন। তাদের অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তাদের যোগাযোগের সুবিধাও আমরা চাইলে নিতে পারি। প্রয়োজনে প্রাক্তন শান্তিরক্ষী যারা এখানে কাজ করেছেন কিন্তু বর্তমানে অবসরে আছেন, তাদেরকেও এই ধরনের বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে এসব দেশে পাঠানো যায়। আসল কথা হলো সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে আমার দেশের উন্নতির কোন সুযোগ যেন আমরা হাতছাড়া না করি। সময় এবং সুযোগ বারবার আসে না। আমি মনে করি আমাদের জন্য সুবর্ন সুযোগ এখনই। নাউ অর নেভার।