প্রকাশ বিশ্বাসের গল্প: আমাদের ইন্দ্রনাথ

প্রকাশ বিশ্বাস
Published : 16 May 2018, 02:53 AM
Updated : 16 May 2018, 02:53 AM

১.
গাবের ম্যাজেন্টা রংয়ের পাতা আর জামের পাতলা কিশলয়, বরুণ—বৈন্যা গাছের সাদা ফুলের ঝাড়, বান্দরনলা–সোনালু গুচ্ছের আবডাল থেকে ঝিরঝিরি বাতাস হঠাৎ বেগ পেয়ে বাউকুড়ানির রূপ নিয়ে ধেয়ে আসে। চৈত্রের এই সব দুপুরে রোদে জ্বলা দোআঁশ মাটির গ্রাম হালটের বুক পিঠে বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে নাকে মুখে, খসে যাওয়া ঝরা পাতা আর ধুলার ঘূর্ণি পমেট, ট্যালকম পাউডারের মতো আমাদের সবার কাঁচা মুখগুলো ধূসরিত করে যায়।
আমাদের গ্রামগুলোতে সে মাসে দোল আসে, শিবের গাজন, আর দেল নামে, চড়ক পূজা হয় দূরের গ্রামে, আসে মুইখ্যা কাচ (মুখোস নৃত্য) খেলার বাহার।


অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরা
আমরা তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বেজায় দুরন্ত, কেউ আলাভোলা, কেউ বা পরিপাটী কেতা দুরস্ত ভালোছাত্র। কেউ স্কুলে যাওয়ার নাম করে ঘুড্ডি উড়িয়ে বেড়ায়, কেউ মার্বেল-ডাংগুলিতে আসক্ত, গরু চড়ানোর নড়ি দিয়ে ছ্যুল খেলা খেলে, আবার কেউ সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়াবান্ধা।

আমাদের বন্ধু সহচর অখিল ছিল সে সবগুলোর মধ্যমণি। যার উপস্থিতিতে আমাদের প্রেরণা,আবেগের সৃষ্টি হতো।
সেই চৈত্রে আমাদের গ্রামে আসলো কৃষ্ণলীলার দল। পক্ষকালব্যাপী রাধা কৃষ্ণের নৌকা বিলাস, ঝুলনযাত্রা, অষ্টপ্রহর নাম কীর্তনে সুরের দোলায় আমরা ভেসে যেতাম। ধানের শুকনো নাড়ার আসনে প্রথম সারিতেই থাকতো অখিল। সে বড়দের দলে যোগ দিয়ে ফুল আর চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিতো আমাদের মতো অবুঝ ভক্তকূলকে।
তখন সে সব আসরে বড়দের ভাব ভক্তিরসের জারনে আমাদেরও জারিত হতে হতো। ভব-সংসারের অসারতা বা ক্ষণিকের এ জীবনের পরমার্থহীনতা থেকে মুক্তির উপায়ের চিন্তা আর ভক্তির করুণ রসে সিক্ত বড়দের চোখের জলে আমরাও সিক্ত হতাম।
"যমুনা এই কিরে তোর সেই যমুনা প্রবাহিনী…. যমুনা" অথবা "সন্ন্যাসী না হইয়ো নিমাই, বৈরাগী না হইও, ঘরে বসে কৃষ্ণের নামটি মায়েরে শুনাইয়ো … মায়েরে শুনাইয়ো" হারমোনিয়াম, তবলা, জুড়ি, খঞ্জনী, খোল, ঢোল, বাঁশি, পায়ে পায়ে ঘুঙুরের ছড়া, নেচে নেচে গেয়ে ওঠে পালাকার, রাধা কৃষ্ণ, বিশাখা, বলরামেরা।
এই সব গীতসুধার মাদকতায় আমরা একটু রাত বাড়তেই সব গ্রামবালকেরা ঘুমে ঢলে পড়ি।


পাটের ফ্যাস্যার বাদামী রংয়ের চিকন রশির মতো শরীর, ঠাকুরমা দিদিমাদের সঙ্গে পান-খয়েরে ভাগ বসানো অখিলের দাঁতে থাকতো সবসময় কালো দাগ। স্কুলে পড়া না পাড়লেও কথার তুবড়ি থাকতো মুখে। সব কাজের এই ওস্তাদকে আমরা সবাই বেশ মান্য করতাম।

শ্রাবণের এক ভোরে জন্মাষ্টমীর আগের দিন অনুষ্ঠান প্রস্তুতি পর্বে অখিলের সঙ্গে আমাদের বিদ্যালয়ের পাশে গোঁসাই বাড়ি দেখতে যাচ্ছি। সার সার নারকেল, সুপারি, আম গাছের বাগানের তলায় ভাটফুল, কাকটুটির জঙ্গল। পাশের বড় দিঘী থেকে ব্যাঙের ডাক আর উচ্চিংড়ের ঝিল্লীতান শুনতে শুনতে জঙ্গলের পথ পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি। অখিলের তো এই সব নিত্যদিনের কাজ আর আমাদের কাছে সেটি ছিল একরকমের অভিযান পর্ব।

জঙ্গলের চারদিকে ছোট ছোট মঠ-মন্দির পার হয়ে অবশেষে গোঁসাইবাড়ির পলেস্তরা খসে পড়া দোতলা দালান আমাদের দৃষ্টি সীমায় চলে আসলো। সদর দরজার দুই পাশে বিষ্ণুর বাহন গড়ুরের প্রণত ভঙ্গির মূর্তি। তা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ভিন্ন কোঠা ঘর। এসব ঘরের জানলার উপরে রঙিন কাচের শার্সি আর খিলান, শোলার কদমফুল ঝুলছে প্রত্যেক দরজায়। আমাদের কাছে সে এক আশ্চর্য আর বিস্ময়ের বিষয়। অভূতপূর্ব এবং অনাস্বাদিত এ অভিজ্ঞতা অখিলের মতো সকল কাজের কাজী, ডানপিটে আমাদের সেই বন্ধুর কল্যাণেই হচ্ছে তা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারি। আর সে কথা অখিলও ভালোভাবেই উপলব্ধি করে।
আমাদের দৃষ্টি প্যানোরোমা হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অখিল আমাদের পেতলের তৈরি গৌর নিতাইয়ের মূর্তি দেখিয়ে বলে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় গৌর নিতাইয়ের সোানা দিয়ে গড়া মূর্তিগুলো লুট হয়ে যাওয়ার পর এখন পেতল প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সে জানায় এসব মূর্তিগুলো সঠিক ভক্তিরসের প্রমাণ পেলে খাঁটি ভক্তের কাছে নবোদয় সূর্যের বিভূতি নিয়ে জীবন্ত হাজির হন। আর্শীবাদ করেন, বর দেন।
আমরা দেখতে পাই হামাগুড়ি ভঙ্গিতে ছুটে আসা নাড়ু গোপালের মূর্তি, রাধা গোবিন্দের যুগল মিলনের মূর্তি, আর বাঁশী হাতে মেঘের মতো,বঙ্কিম হাসির অদ্ভূত দীপ্তির কোকড়ানো কেশদাম চূঁড়ায় ময়ুর পালকের শোভাধারী পীতবসনের কৌস্তভ রত্নধারী একক অদ্বিতীয় ত্রিভঙ্গ মুরারীকে।
আমরা জীবনে প্রথমবারের মতো দেখতে পাই সে বাড়িতে জগন্নাথ দেবের রথ। কাঠের তৈরি রথের গায়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, যুযুধানে অর্জুন কর্ণের খোদাই এনগ্রেভ।

সে বাড়িতে অখিল আমাকে হরিদ্রা বর্ণের ধুতি ফতুয়া আবৃত বিশালকায় দশাসই দাদু গোঁসাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। গৌর নিতাইভক্ত দাদু গোসাইয়ের গাত্র বর্ণও ফর্সা উজ্জ্বল। ছোটদের তিনি কিশোর কৃষ্ণের জীবন ও মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে ঘরে বসেই পরিব্রাজ্যের কাজ করতেন, আমাদের অন্তরের সারল্যে আর বিশ্বাসে আপ্লুত হয়ে গোকুল আর বৃন্দাবনের কল্পলোকে চলে যেতেন। তিনি কংস রাজা, বলরাম, সুভদ্রা, বসুদেব, দেবকী যশোদার কাহিনী বলতে থাকেন। এ সময় আবেগে মমতায় আর ভক্তিতে চোখ বুজে আসে তার। আমরাও প্রবেশ করতাম হাজার বছর আগের সেই রং রূপ আর রসে।
সময় পরিভ্রমণে গোকুলে যমুনার নীল জলে শুভ্র রাজহংস হয়ে, কখনো গোধেনু পরিবৃত কদমবৃক্ষ থেকে কদম রেণু মাথায় নিয়ে আমাদের কাছে গল্প করতে করতেই শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির মন্দ্র সুরে তন্দ্রায় ঢলে পড়লে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতাম।


আমাদের গ্রামগুলোতে ঋতু ভেদে হেমন্তে আসতো গাস্সি, নবান্ন, ভুল ভূত দাবড়ানো, গাজীর সিন্নি। অখিল স্বাভাবিকভাবেই সেখানেও নেতৃত্ব দিতো। শীতের সময় আসতো যাত্রা দল। তখন ক্ষেতে ক্ষেতে খেসারী, মটর, মাসকলাই আর শর্ষের কচি চারা ফুল আর ফলের অপেক্ষায় বেড়ে উঠছে। জাবরা গ্রামে অমলেন্দু বিশ্বাসের একটি অপেরা দল ছিল। বিকালে স্কুল ছুটির পর লুকিয়ে উঁকি মেরে আমরা যাত্রা দলের রিহার্সাল দেখতাম। উদয়ন, দিপালী, আদি দিপালী, গণেশ অপেরার বিভিন্ন পালার ডায়ালগ আমরা কয়েকদিন ধরে নিজেরাই মনে রেখে রাস্তা ঘাটে, স্কুলের মাঠে,পথে প্রান্তরের বাতাসে ছড়িয়ে দিতাম। আমরা কালীগঙ্গা নদীপারে বালুচড়ে রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সন্ধ্যা থেকেই ভীড় করতাম যাত্রাপালা দর্শনের। অখিল যাত্রা দলের লোকদের দাদা কাকা ডেকে আমাদের আসনগুলো সংরক্ষিত রাখার বন্দোবস্থ করতো। যাত্রাপালা দেখায় বাড়ির বড়দের কাছ থেকে কারো অনুমতি মিলতো। কারো মিলতো না।
যাত্রপালা শেষ হতে হতে পাখী ডেকে উঠতো, সূর্য ওঠার আগের মুহূর্তে আমরা যে যার বাড়ির পথ ধরলে অখিল আমাদের ছাড়তো না। দুর্গাবাড়িতে ওদের নিয়ে গিয়ে সকালের খাবার খেয়ে কাচারি ঘরে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে শুরু হতো আরেক প্রস্থ নতুন অভিযাত্রায় বর্ণিল অভিজ্ঞান। আমরা ওদের আমের চালায় চলে যেতাম। চালার পাশের শ্যাওলা পড়া পুকুরে ডুবানো নৌকার গলুইয়ে রোদ পোয়ানো কাছিম শাবকৃুদের ঢিল ছুঁড়তেই টুপ করে জলে নেমে যেত ওরা। শির শিরে হিম বাতাসে শিমুল, পলাশ আর মাদার গাছের তলায় তিত বেগুন, কালো কেশি, ধূতরা, মটমটে, দলকলসের ঝোপ। রক্তকুচের ঝাড়ের পাশেই মাথা তুলেছে কচি তালের গাছ। সার বাঁধা উইয়ের ঢিবি। এ সব লতাগুল্মের নাম অখিলই আমাদের শিখিয়ে দেয়। ইউনিভাসির্টিতে বোটানি পড়া অখিলের ছোট কাকার কাছ থেকে সে এসবের নাম জেনেছে। বিভিন্ন অর্কিড দেখিয়ে সেগুলোর নাম শেখায় আমাদের। আমরা ঠান্ডা হাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে জামার বোতাম ভালো করে লাগাতে লাগাতে চোখ দিতাম পুকুুরের জলে। মাছের বাড়ি বানানোর জন্য জলে ডোবানো গাছের ডালপালার ওপরে মাছরাঙ্গার সঙ্গে ফড়িংয়ের খুনসুটি দেখতে দেখতে প্রকৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যাই আমরা।


আমাদের স্কুলে একবার নিয়ম হলো যারা পড়া পারতো না তাদের দিয়ে পালা করে স্কুলের পালান জমিতে টমেটো আর আলু লাগানোর। অখিলের যেহেতু পাঠ্য বইয়ের পড়া কখনোই ভালো লাগতো না সেহেতু তার কপালেই জুটতো এ চাষের কর্মটি করার। কারণ এ কাজে অখিলের কষ্ট দেখে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত। তাই আমি এবং আরো দুই একজন গোপনে স্যারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অখিলকে চাষে সাহায্য করতাম।
একবার স্কুলের মাঠে লটারি ধরে আইস ক্রীম কেনার সময় আইসক্রীমওয়ালার চালিয়াতি ধরা পড়ে। অখিলের প্ররোচনায় শাস্তি হিসাবে আমরা আইসক্রীমওয়ালার গোটা বাক্সটাই একবার হাপিস করে ফেলি।


আমরা স্কুলে উঁচু ক্লাশে উঠে যাই। আমাদের বানিয়াজুরি, দুর্গাবাড়ির সেই অখিল নামের নক্ষত্রটি বিপুল আকাশ থেকে একসময় খসে পড়ে। নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সে। আমরা শুনতে পাই কোন দুর্বৃত্ত, ঠগ তাকে গুম করে ফেলেছে। কেউ জানায় সে পালিয়ে কোন যাত্রা দলে অথবা দূর দেশের বাউল আখড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। আবার কারো সন্দেহ পালিয়ে ভারতের কোন তীর্থক্ষেত্রে ঠাঁই নিয়েছে সে।

আমরা এর মধ্যে এক সময় দলবেঁধে অখিলদের বাড়ি যাই। অখিলের কাকা আমাদের আসার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে হালটে নেমে আমাদের অভ্যর্থনা জানান।
আমাদের নিরব জিজ্ঞাসার উত্তরে কাকা অখিলের অন্তর্ধান সূত্র নিয়ে বলতে থাকেন, ভোর রাতে যখন প্রাতঃক্রিয়ার জন্য ঘর থেকে বেড়িয়ে বাইর বাড়ির দুয়ারে আসেন তখন দেখতে পান হেমন্তের হিম হাওয়ায় কাচারি ঘরের দরজার পাল্লা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে নড়ছে। বাড়ির বাইরে খড়ের পালার পাশের ছাতিম গাছ থেকে নিজস্ব সময় ধরে প্রতিদিনকার মতো তক্ষক কক্কে কক্কে সুর তুলে ডাকতে থাকে। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া চতুদর্শীর চাঁদ দেখা যায় নারকেল গাছের কোনায়, গোয়াল ঘরের আড়া থেকে প্যাঁচা অশুভ ডাক ডাকতে থাকে ক্যু ক্যু করে। দরজা খোলা দেখে কৌতূহলে কাচারি ঘরের ভেতরে ঢুকে তিনি অখিলের বিছানা শূণ্য দেখতে পান। তার চোখ চলে যায় বাড়ির পৈঠার পাড়ের ছোট পুকুরে। দৃষ্টি চলে যায় আরো দূরে পেঁয়াজ, শর্ষের ক্ষেত পার হয়ে বগাধর বিলের দিকে। কিন্তু চাঁদের আলোয় চরাচরে কারো কোন অবয়বের দেখা পাওয়া যায় না।
'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ চরিত্রের অখিলকে আমরা হারিয়ে ফেলি। আমাদের সেই গ্রামগুলোর মধ্যে আস্তে আস্তে শহর ঢুকে পড়ে। আমরাও কৈশোর বেলার বর্ষার নতুন জলের মতো সারল্য আর মমতা হারিয়ে সাইবারনেটিকস কালচারের মধ্যে ঢুকে পড়ি। জীবন আমাদের জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পড়ে। এখনো কোন কোন রাতের শেষ ভাগে ঘুম ভেঙে গেলে আমরা হারিয়ে যাওয়া অখিলকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করতে থাকি।