মতিন ভাইকে শেষ স্যালিউট

রণেশ মৈত্র
Published : 9 Oct 2014, 02:14 PM
Updated : 9 Oct 2014, 02:14 PM

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ও দ্বিজাতিত্ত্বের ঘোর বিরোধিতাকারী ছিলেন তিনি। ভারত-বিভাগোত্তর নবগঠিত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বুকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অকুতোভয় দাবিদারও তিনিই। সেই তিনি চলে গেলেন। আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী, অগ্রজতুল্য আবদুল মতিন ৮ অক্টোবর, ২০১৪ সকাল নয়টার দিকে পরলোকগমন করেছেন। বৃহত্তর পাবনা জেলার তথা বাঙালি জাতির গৌরব মতিন ভাইয়ের ভাষাসৈনিক পরিচয়ের বাইরেও বলতে হয়, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে আজীবন লড়াই করে গেছেন তিনি।

ইতিহাসের হাত ধরে পেছনে হাঁটলে দেখতে পাই ভাষা আন্দোলনে আবদুল মতিনের বিবিধ ভূমিকার চিত্র। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সেই ভাষণের পর, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল, যে পরিষদের সদস্য ছিলেন অগ্রজতুল্য আবদুল মতিন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের এক যৌথ সভায় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হলে মতিন ভাই তার আহবায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে সমগ্র পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছিল।

মনে পড়ে, ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে পাবনা আসেন এবং সফলভাবে তা সংগঠিত করে শহরে ছাত্রদের বিশাল মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মিছিল শেষে তাঁকে গ্রেফতার করা হবে এমন আভাস পেয়ে মিছিল শেষ হবার আগেই তিনি গোপনে বেরিয়ে যান এবং গোপন পথে ঢাকায় গিয়ে পৌঁছান। এভাবেই তিনি এই দফায় নিশ্চিত গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। '৪৮ এর পাবনার ওই মিছিল থেকে আমিনুল ইসলাম বাদশা, রওশন জান চৌধুরী, আমজাদ হোসেন, মাহবুব আহমেদ খাঁন প্রমুখ ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে মিছিল বের করলে যা ঘটেছিল, তা এখন আমাদের মহান ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, গৌরবময় অতীত। পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতার কয়েকজন শহীদ হলে, সরকার তীব্র দমননীতির আশ্রয় নিয়ে রাতের অন্ধকারে ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার শুরু করে। অন্যতম প্রধান সংগঠক আবদুল মতিন এবার গ্রেফতার এড়াতে পারেননি। তিনি তখন ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ' এর অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা।

১৯৫৩ সালে কারামুক্ত হন মতিন ভাই। আজীবন সংগ্রামী এই নেতা এরপর যোগ দেন নবপ্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন'এ। এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি কো-অপ্টেড হন। সে বছরই অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আবদুল মতিন সর্বসম্মতিক্রমে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। আমাকে তখন কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচন করা হয়। পরে, ১৯৫৭ সালে, মতিন ভাই পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, যেখানে আমাকে পার্টির সদস্যপদ দিয়ে জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচন করা হয়।

রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে মতিন ভাইকে তখন কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। দেখেছি তাঁর নেতৃত্বে 'পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন' প্রদেশব্যাপী বিশাল ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রাক্কালে ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

ওদিকে, শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় নূরুল আমীনের বাসভবন বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমী। তার প্রাঙ্গনে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত একুশে বই মেলা আজ এক আর্ন্তজাতিক বই উৎসবের গৌরবোজ্জ্বল রূপ ধারণ করেছে।

ভাষা আন্দোলনের সরাসরি অবদান যতগুলি তার মধ্যে, আমার মতে, আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির আর্ন্তজাতিক মর্যাদা এক অসাধারণ উচ্চতায় স্থাপন করেছে; দ্বিতীয়ত, ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ধর্মের নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনও বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে কানাডা-প্রবাসী তিন বাঙালির প্রাণান্ত চেষ্টায় জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক শাখা ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে দিবসটি বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর কাছে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

বর্তমানে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাকে অন্যতম অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ (দাফতরিক ভাষা) হিসেবে স্বীকৃতির প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং তা সফল হলে ভাষা আন্দোলন তার সাফল্যের নতুন স্তরে উন্নীত হবে।

আজকে বাংলা ভাষার এই আন্তর্জাতিক মর্যাদার পেছনে অসামান্য অবদান আমাদের ভাষাশহীদদের রক্তের, ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগের, গ্রেফতার-জুলুম এড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবার দৃঢ়প্রত্যয়ের। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মতিন ভাইকে এই কৃতিত্বের অনেকটাই দিতে হয়।

তাঁর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে দুয়েকটি স্মৃতিচারণ করতে চাই। তিনি বিয়ে করেছিলেন ঈশ্বরদীতে। ওই সময় আমি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে আটক ছিলাম। শুনেছি, মতিন ভাই তাঁর বিয়েতে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পোশাক পায়জামা ও শেরওয়ানি-পাগড়ি পরতে অস্বীকৃতি জানান। বিষয়টি তখন এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। এ রকমই ছিলেন মতিন ভাই, নিজের আদর্শের সঙ্গে কখনও আপোস করেননি।

আজীবন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে গেছেন মতিন ভাই। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও মুসলিম পরিবারের সদস্য হওয়াতে পাকিস্তান আমলে সরকারি উচ্চপদের চাকরি করে দুধে-ভাতে দিন চালানোর সুযোগ পেতে পারতেন। কিন্তু তা না করে নিজের শ্রেণিচ্যুতি ঘটিয়ে শোষিত বাঙালির কাতারে নেমে গিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক সমিতি ও কৃষক আন্দোলন। যেখানেই যেতেন বৈঠক করতেন কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির সঙ্গে। কদাপি ক্লান্তি অনুভব করেননি।

যতদূর মনে পড়ে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মতিন ভাইয়ের জন্য নব্বইয়ের দশকে দৈনিক জনকণ্ঠ মাসিক পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা ঘোষণা করেছিল এবং তা দীর্ঘদিন বজায় ছিল। শেষতক কী হয়েছিল জানি না।

আবার ফিরে যাই পঞ্চাশের দশকে। পার্টির নির্দেশে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন মতিন ভাই। দলটিকে অসাম্প্রদায়িক করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে মিলে আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে বিপুল ভোটাধিক্যে 'আওয়ামী মুসলিম লীগ' থেকে 'মুসলিম' শব্দটি অবলুপ্ত করে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' নাম রাখা হয়। ঘটনাটি তৎকালীন রাজনীতিতে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। ওদিকে একই সঙ্গে গোপনে মতিন ভাই কমিউনিস্ট পার্টিরও নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

ষাটের দশকে বিশ্বের আন্তর্জতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টি হলে গোটা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব দৃশ্যতই বিভক্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম অধিবেশনে গৃহীত রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে ঐকমত্য ঘোষণা করে এশিয়া বাদে বাকি বিশ্বের সকল সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং সমাজতন্ত্রী ও কমিউনস্ট পার্টিগুলো। অপর দিকে, চীনের নেতা মাও জে দং-এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবে এশীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির কিছু কিছু আদর্শিকভাবে সমর্থন দিতে থাকে।

এভাবে রুশপন্থী ও চীনাপন্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি বিভক্তির কবলে পড়ে। পাকিস্তানেও তার প্রভাব পড়ে। এখানে রুশপন্থীরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় চীনাপন্থীরা পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পার্টি গঠন করতে থাকেন। ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন সবই বিভক্ত হয়ে পড়তে থাকে; সংগঠনগুলি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।

মতিন ভাই, আমি এবং আমাদের আরও অনেক সহকর্মী তখন কারারুদ্ধ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ নং সেলের দুটি খাটের একটিতে আমি থাকতাম; অপরটিতে মতিন ভাই। তিনি তখন চীনপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন, আমি ঝুঁকেছি রুশপন্থীদের দিকে। অনিবার্যভাবেই, রাতে দুজনে দীর্ঘ রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়তাম।

এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে মতিন ভাইয়ের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত একটি আলোচনার উল্লেখ করছি। কারারুদ্ধ মতিন ভাইকে প্রায় প্রতিদিনই চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হত। তখন তিনি তাঁর এসকর্ট পুলিশ বাহিনীকে হাত করে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের একাংশের (রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ) সঙ্গে বৈঠক করতেন। অভিযোগ ছিল, তিনি ওই সময়ে বিশাল ছাত্র ইউনিয়নকে মেননপন্থী (চীন সমর্থক) ও মতিয়াপন্থী (রুশ মতের সমর্থক) হিসেবে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেন।

ঘটনা যা-ই হোক, এভাবেই মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী একসময়ের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, কৃষক সমিতি সবগুলোই আন্দোলন সংগঠনের ক্ষমতা হারাতে থাকে। ওদিকে, আরও পরে, নব্বই দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙনের পরিণতিতে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে দুনিয়া-জোড়া দুর্বল হয়ে পড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।

তবু আশাবাদী ছিলেন আজীবন সংগ্রামী মতিন ভাই। তিনি মনে করতেন, আজ সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ও প্রগতির সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু জঙ্গিবাদ– যার বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুব সমাজ এগিয়ে এলে বিশ্বের অপরাপর অঞ্চলে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।

বৃহত্তর পরিসরে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নেই যিনি বলতেন, ''পৃথিবী দুইভাগে বিভক্ত– শোষক ও শোষিত– আমি শোষিতের পক্ষে।"

মওলানা ভাসানীও নেই যাঁকে একসময় 'রুশভারতের দালাল' বলে প্রতিক্রিয়াশীলেরা গালি দিলে হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, ''আমাকে আর যার-ই দালাল বল আপত্তি নেই, তবে আমাকে যেন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালাল বল না– আমি তাদের বিরুদ্ধে– সমাজতন্ত্রের পক্ষে– গরীবের পক্ষে।"

তাঁদেরই অনুসারী মতিন ভাইও চলে গেলেন। এক শূণ্যতার সৃষ্টি হল। বাংলাদেশ তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে, দেশপ্রেমিক আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিনকে হারাল। শূণ্যস্থান দ্রুত পূরণ করা আজকের তরুণ-তরুণীদেরই দায়িত্ব। আশা করি, তারুণ্যের বাংলাদেশ নতুন প্রগতির জোয়ার সৃষ্টি করে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করবে।

রণেশ মৈত্র: লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।