কাব্যযোদ্ধা জ্যাক হার্শম্যান: মখমলের দস্তানায় লৌহমুষ্ঠি

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 13 Dec 2019, 04:53 PM
Updated : 13 Dec 2019, 04:53 PM


ছবি: নভেম্বর ২০১৯ একুয়াদরের গুয়াইয়াকিল-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে ভক্ত অনুরাগীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত কবি জ্যাক হির্শম্যান।
পঞ্চাশের দশকে বিট প্রজন্ম সারা পৃথিবীতেই চাঞ্চল্য তৈরি করেছিলো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান, প্রথাবিরোধী জীবনযাপন, মাদকের প্রতি পক্ষপাত, যৌন জীবনে ধর্মীয় শাসনের বিরুদ্ধাচারণের কারণে। একই সঙ্গে কবিতায় ও কথাসাহিত্যে তারা অকপট, বিপ্রতীপ আর উন্মুক্ত আত্মাকে মেলে ধরেছেন এমন এক ভাষায় যা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। তর্কাতীতভাবেই এ্যালেন গীন্সবার্গ ছিলেন এদের মধ্যে সফলতম ব্যক্তিত্ব–জনপ্রিয়তায় এবং কাব্যিক সাফল্যে। কিন্তু আরও যারা ছিলেন যেমন, জ্যাক কেরুয়াক, উইলিয়াম বারোজ, লরেন্স ফার্লিংগিট্টি, গ্রেগরি কর্সো, গ্যারি স্নাইডার প্রমুখ, এদের মধ্যে যারা কবি তারা চেয়েছিলেন কবিতাকে একাডেমির বাইরে রাস্তায় নিয়ে আসতে। করেও ছিলেন তাই। বিট আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত না হলেও জ্যাক হির্শম্যানও ছিলেন বিট প্রজন্মেরই একজন, যদিও এই পরিচয়কে তিনি কখনোই মূখ্য করে তোলেননি, তুলতে চানও নি। না চাওয়ার কারণ ছিল কাব্যবিশ্বাসের ক্ষেত্রে তার ভিন্ন এক অবস্থান। বিট প্রজন্মের অন্য লেখকরা প্রথাবিরোধী হলেও বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাদের কারোরই কোনো প্রগাঢ় কোন অঙ্গীকার ছিলনা, যদিও তাদের মধ্যে বামধারার রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি অনুরাগ ছিল কিন্তু স্থায়ী কোনো বন্ধন ছিল না। জ্যাক হির্শম্যান এই জায়গাটিতে একেবারে স্থায়ী বন্ধনে অটুট হয়ে আছেন।


ছবি: ষাটের দশকে কবি এলেন গিন্সবার্গের সাথে কবি জ্যাক হির্শম্যান।
তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার শুরু হযেছিল রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি পাঠের মাধ্যমে। রুশ বিপ্লব এবং মায়াকোভস্কি তাকে চিরকালের জন্য কম্যুনিষ্ট কবিতে রূপান্তরিত করেছে। এবং ওই অবস্থান থেকে তিনি এখনও বিচ্যুত হননি। Contemporary Poets-এর ভাষায় জ্যাক হচ্ছেন "One of the left's most Prolific and consistent Poetic voices.." আর সমালোচক ডেভিড মেল্টজার-এর মতে, "ফ্রান্সে তারা তাকে বিবেচনা করেন প্রধান এক কম্যুনিস্ট কবি হিসেবে।"

রাজনৈতিক কবি হওয়া মানে সবসময়ই এক বিরাট ঝুঁকি বহন করা। রোকে দাল্তন, পাবলো নেরুদা প্রমুখ সেই ঝুঁকি বহন করেছিলেন সাহস ও সৃজনীশক্তির সমন্বয়ে। জ্যাকের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এবং এটা কোনো কাকতাল নয় যে ঠিক এই কারণেই এই দুই কবি জ্যাককে আকৃষ্ট করেছে, এদের বই ইংরেজি ভাষায় তিনি অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। রাজনৈতিক কবিতা লেখার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এই যে তা নিছক শ্লোগানের খাদে পরে যেতে পারে। নেরুদা, দাল্তন এবং জ্যাক–তিনজনই সেই খাদ এড়িয়ে যেতে পেরেছেন কাব্যশক্তি ও কল্পনার সহায়তায়।

জ্যাক হির্শম্যানের প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থগুলোয় এই রাজনৈতিক অঙ্গীকারের তীব্রতা না-থাকলেও তার আভাস ছিলো গণমুখিতার কারণে। নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনালেখ্য, ন্যায় ও সাম্যের জন্য লড়াকু মানুষের সংগ্রামকে তিনি কবিতার বিষয় করে তুলেছেন। মানুষের কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত মানুষের যে লড়াই সেখানে তিনি লেখক শিল্পীদের ভূমিকা সম্পর্কে পরিস্কারভাবেই বলেছেন যে "It is vitally important at this time that all poets and artists collectivize and form strong socialist cadres in relation to working-class cultural internationalism.."
জ্যাক-এর বক্তব্য আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে কার্ল মার্ক্সের সেই উক্তি:"দার্শনিকরা এত কাল শুধু পৃথিবীটাকে ব্যাখ্যা করেছেন, এখন কাজ হলো এটাকে বদলে দেয়া।"– মার্ক্সের এই বিপ্লবী বাক্যটি যে জ্যাকের প্রধান প্রেরণা তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, আর এ কারণেই তাকে দেখা যাবে র‌্যালি, প্রতিবাদসভা আর রাস্তায় দাড়িয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে। তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক না হয়েও জ্যাক নেরুদা-কথিত তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের সেই ইতিহাসের বোঝা বহন করেন। চেশোয়াভ মিউশের মতো তিনিও হয়তো বিশ্বাস করেন: "কাকে বলে কবিতা, যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষ?" (অনুবাদ: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপধ্যায়) কিন্তু রুশ বিপ্লোত্তর সেই সব গৌন কবি-শিল্পীর মতো জ্যাক কবিতাকে বিপ্লবের দাস করতে চাননি, I take no slaves, তিনি এমনই শিরোনাম দিয়েছিলেন তার এক কবিতার। তিনি চান কবিতা শৈল্পিক শর্ত পূরণ করেই তা মানুষের মুক্তির মন্ত্র হয়ে উঠুক।


ছবি: ষাটের দশকে কবি জ্যাক হির্শম্যান।
২.
জ্যাক হির্শম্যানের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক শহরে, যে-শহরটিকে নিয়ে তিনি অসামান্য একটি কবিতা লিখেছেন বহু বছর পর। একেবারে ১৮/১৯ বছর বয়সেই তিনি যোগ দিযেছিলেন নিউ ইয়র্কের Associated Press নামক এক সংবাদ সংস্থায়। সে সময়ই আর্নেস্ট হোমিংওয়ের অনুকরণে লিখছিলেন গল্প। হোমিংওয়ের অভিমত জানার জন্য তিনি তখন দুটি গল্প পাঠিয়েছিলেন। হেমিংওয়ে সঙ্গে সঙ্গে চিঠি লিখে যা জানালেন তা বিরোধাভাসে উজ্জ্বল এক ভাষ্য: " I can't help you, kid. You write better than i did when i was 19. But the hell of it is, you write like me. That is no sin. But you won't get anywhere with it." এই চিঠি পাওয়ার পর জ্যাক হেমিংওয়ের অনুকরণ তো বর্জন করলেনই, এমন কি গল্প লেখাও ছেড়ে দিলেন, যদিও পরবর্তীকালে তার কবিতায় গল্পের আখ্যানধর্মী বৈশিষ্ট্য বারবারই এসেছে, এসেছে অসামান্য দক্ষতায়। জ্যাককে লেখা হোমিংওয়ের ওই চিঠির একটা কপি থেকে গিয়েছিল তার কর্মক্ষেত্র এসোসিয়েটেড প্রেসেই। আর ১৯৬১ সালে হেমিংওয়ে যখন আত্মহত্যা করলেন তখন ওই চিঠিটাই এসোসিয়েট প্রেস "Letter to a young Writer." শিরোনামে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল বিরল সংগ্রহ রূপে।


ছবি: নভেম্বর ২০১৯ সালে একুয়াদরের গুয়াইয়াকিল-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে ভক্ত অনুরাগীদেরকে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন কবি জ্যাক হির্শম্যান।

এই চিঠির সুবাদে জ্যাক হির্শম্যান অনেকেরই মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন। জ্যাকের জীবনে আরেকটি বড় ঘটনা ভিযেতনাম যুদ্ধ। ৫০ ও ৬০ এর দশক তিনি অধ্যাপনা করেছেন ডার্টমাউথ কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলস (UCLA)-এ। এই অধ্যাপনা জীবনে তিনি The Doors-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং লিড ভোকালিস্ট জিম মরিসনকে পেয়েছেন ছাত্র হিসেবে। অধ্যাপক হিসেবে জ্যাক-এর সুনাম ছিলো গোটা ক্যাম্পাসেই। এই সফল পেশাটিও তাকে ছাড়তে হয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সরকারের বিরোধিতার কারণে। কবি ডেভিড মেল্টজার-এর ভাষায় হির্শম্যান ছিলেন " A great teacher who refuses to work in the university, a scholar of great merit who refuses to publish in the mainstream presses. " সততা ও আদর্শনিষ্ঠা তাকে সুবিধা গ্রহণে বিমুখ করেছে বটে কিন্তু সেটাই তাকে দিয়েছে চরিত্রের এমন এক বৈশিষ্ট যা তাকে গৌররান্বিত করেছে মনুষ্যগুণে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে শিক্ষকতা পেশা হারারার পর তিনি আর কখনোই অন্য কোনো পেশায় যুক্ত হননি। এরপর থেকে পূর্ণ সময় তিনি নিয়োগ করেছেন লেখালেখি, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের অব্যাহত কর্মকান্ডে। ইতিমধ্যে তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। পাশাপাশি রযেছে বিপুল পরিমাণ অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থ। বর্ণমালাভিত্তিক শিল্পচর্চার পাশাপাশি জ্যাক রংয়ের রাজ্যেও সমানভাবে সক্রিয়। চিত্রশিল্পী ও কোলাজ শিল্পী হিসেবে জ্যাকের পরিচিতি কম নয়। জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালিয়, রুশ, আলবেনিয় এবং গ্রীক ভাষা খেকে ইতিমধ্যে গোটা পঁচিশেক বই অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন। তার অনূদিত ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে নেরুদা, আন্তোনিন আর্তো, পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, রোকে দাল্তন এবং বামপন্থী লেখক শিল্পীদের প্রবন্ধের বই Art on the line.


ছবি: ষাটের দশকে City lights প্রকাশনীর কর্নধার ও কবি লরেন্স ফালিংগিট্টির সাথে কবি জ্যাক হির্শম্যান।

হির্শম্যানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় যার একটি ভূমিকা লিখেছিলেন কবি কার্ল শাপিরো। জ্যাকের স্বাতন্ত্র্য তিনি বরণ কর নিয়েছিলেন প্রশংসার মাধ্যমে: " What a relief to find a poet who is not afraid of the vulgar or the sentimental, who can burst out laughing or cry his head off in poetry–who can make love to language, or kick it in the pants. "। জ্যাক বিট-প্রজন্মের হয়েও বিট থেকে তার পার্থক্য এই যে বিট-প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে প্রথাবিরোধিতা আছে কিন্তু বিশেষ কোনো একটি রাজনৈতিক আদর্শে তাদের কারোরই স্থায়ী কোনো অঙ্গীকার নেই, কিন্তু জ্যাক অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে ১৯৮০ সালের পর থেকে তিনি পুরোপুরি কম্যুনিষ্ট কবি রূপে ইউরোপে ও আমেরিকায় বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।


যে বছর হির্শম্যান সান ফ্ল্যান্সিস্কোর পয়েট লরিযেট হিসেবে অভিষিক্ত হন, সে-বছরই অর্থাৎ ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ The Arcanes, ইতালি থেকে প্রকাশিত সহস্র পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি বিপুলতার কারণেই মহাকাব্য নয়, বরং এর অন্তর্গত বৈশিষ্ঠ্যের জন্যই এটি মহাকাব্যধর্মী। ৩৪ বছর ধরে তিনি ১২৬টি দীর্ঘ কবিতার মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলেছেন মহাকাব্যধর্মী এই অসামান্য গ্রন্থটি। The Arcanes কেবল জ্যাক হির্শম্যানের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থই নয়, এটি ইংরেজি সাহিত্যেই একটি মাইলফলক হয়ে উঠেছে। বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক এলান কউফম্যান এটির আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন;
"In fact, "The Arcanes" is in every way as unlikely and historically significant a literary production as, say, the appearance of Walt Whitman's "Leaves of Grass" or James Joyce's "Ulysses." Had this been another, more literate age, "The Arcanes" might very well be as universally acclaimed. For, like Whitman's and Joyce's masterpieces, it traces the progress of an individual consciousness through landscapes teeming with the horrible glory of modern life. And like "Ulysses," it is a poetic evocation of a voice so authoritatively essential that the brilliance and beauty of these poems might shake the world, if only someone were listening. "
জ্যাক হির্শম্যানের মানসিক বিবর্তনটি বুঝবার জন্য The Arcanes পাঠ করাটা জরুরী। জ্যাককে শুধুই কম্যুনিস্ট কবি হিসেবে যারা একটি নির্দিষ্ট তকমায় সীমিত করে ফেলতে চান, তারা লক্ষ্য করলেই দেখবেন, এতে কাবালা মরমীচেতনা কিভাবে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। প্রচলিত আখ্যান ও ইতিহাস, যেমন কাউন্ট কাগলিওস্ত্রো ও সেইন্ট-জাার্মেইন, কাব্যিক রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনায় হাজির হয়েছে এই মহাকাব্যে।


ছবি: জ্যাক হির্শম্যানকে নিয়ে রচিত ম্যাথিউ ফুরেই-এর তৈরি করা ডকুমেন্টারির পোস্টার।

এটা অসম্ভব নয় যে এই গ্রন্থে মরমীচেতনা কিংবা ধর্মীয় বিষয় ব্যাবহারের কারণে শুস্ক কেতাবি কম্যুনিষ্টরা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে যেমন অভিযুক্ত করতে পারেন, তেমনি বিশ্বাসীরা তাকে ছদ্মবেশী কস্যুনিস্ট বলে নিন্দাও করতে পারেন। কিন্তু মানুষের মন যে শুধুই সাদা বা কালো রংয়ের হয় না, হলে সেটা হবে নিছকই সীমাবদ্ধ মনের এক রূপ। তার চেয়ে বড় কথা হলো, জ্যাক এই কাব্বালা মরমীচেতনাকে প্রকরণের এক প্রতীকি ব্যঞ্জনা হিসেবেই ব্যবহার করেছেন তার এই মহাকাব্যে। যেমনটা এর আগেও কেউ কেউ করেছেন। এখখুনি আমাদের মনে পরবে হোর্হে লুইস বোর্হেসের কথা। জ্যাকের এই আপাত পরস্পরবিরোধী সমন্বয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সমালোচক এলান কউফম্যান বলেছেন:
" God is a dirty word to a communist. But great literature revels in great contradictions. " স্ববিরোধ বড় মনের এক স্বাভাবিক রূপ। এটা হুইটম্যানও জানতেন বলেই বলতে দ্বিধা করেননি:
"Do I contradict myself? Very well, then I contradict myself, I am large, I contain multitudes."
বড় শিল্পী এই স্ববিরোধের এক বিশাল ও স্বর্ণময় উন্মোচনে এগিয়ে আসেন। জ্যাক হির্শম্যানও তাই করেছেন তার এই মহাকাব্যে। আজ ১৩ ডিসেম্বর এই মহান কবির জন্মদিন। এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ আর তার কিছু কবিতা বাংলায় তর্জমার মাধ্যমে তাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। কবি ও কমরেড হির্শম্যান দীর্ঘজীবী হোন, আয়ু আর সৃষ্টির দৈর্ঘে তিনি বিস্তৃত হোন– এই কামনা করি।

ভাষ্য ও ভাষান্তর: রাজু আলাউদ্দিন

স্তোত্র ( Hymn)
আমি ঘরে
তুমি ঘরে
ভেতরে

শিশুরা
ঘুমে
তাদের রুমে

ভেতরে, আমি
কাজ করি
কবিতার
প্রদীপের
নিচে

গেরিলারা (Guerrillas)
তারা পাহাড়ের গুহায় ঘুমায়;
দৃঢ়চিত্ত মানুষের দল।
তৃষ্ঞার পানিহীন,
শিশু কিংবা নারীদের উষ্ঞতা হীন।
বেয়নেট দিয়ে গড়া খাটের পায়া,
বালিশ লোহার।


নভেম্বর একুয়াদরের গুয়াইয়াকিল-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে জ্যাক নিজের কন্ঠে 'নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক' শীর্ষক কবিতাটি মূল ভাষায় পাঠ করে শোনান

নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক ( NY, NY)
এ যে সুবিশাল
এ যে কুৎসিত
ঘৃনা করি তাকে
ভালো বাসি তাকে
আমি মুক্ত
ওহে
কথা বল তুমি
শোন না আমাকে
আমি তাকে ফেলে দিতে পারছি না
তার জন্য করবো সবই
সে যে কি বিশাল
নোংড়া সে খুব
কী যে সুমধুর
ভালোবাসি তাকে
আমি থেকে যাবো
ছাড়বো না তাকে কখনো আমি
সে আমার মাঝে
সে যে নিষ্ঠুর
ঘৃণা করি তাকে
ভালোবাসি তাকে
সে তো আমারই
সে আমার ধন
সে তো আমারই
আর বারবার
বলি আমি ঘৃণা করি যুদ্ধ
ভালো বাসি তাকে
বিবমিষাকর
অদ্ভুত সে যে
ভালোবাসি তাকে
আমি সরবো না
এ আমার পন
সে যে সুন্দরী
কথা বল শুনি
শুনতে পাও না
হে প্রিয়তমা
ওহো কি নিদয়া
ও যে ঘিনঘিনে
কথা বল শুনি
বল তো আমায়
কী করা উচিৎ
যে-কোনো কিছু
সে যে অপরূপ
তার প্রতি প্রেম
থামবে না কভু
কখনো নয় কখনো নয়
কখনো নয় কখনো নয়
কোনোদিন নয়।

অন্তরীপ (Headlands)
একজন বেরিয়ে গেল
একা হতে সমুদ্রের গর্জনের পাশে

অন্যজন একই সময়
উঠে বসেছিল

অন্যজন হয়ে গেল সহস্ত্র
ধ্যানের আসন

অন্যজন নেমে এলো সুউচ্চ
শিলাখণ্ড বেয়ে আর
ঢুকে গেল ফেনায়
এবং গোড়ালি স্রোতে

অন্যজন বেরিয়ে গেল
একা হতে ঝোপঝাড়ে
লুকায়িত সুবিশাল
সমুদ্রের গর্জনের পাশে

অন্যজন তুলে নিল
বেআক্র ভূমির শেষ ফুলগুলি

অন্যজন হয়ে গেল একটি
সারস

অন্যজন হযে গেল
স্রোতে ভাসা একটুকরো কাঠ

কবিতার প্রারম্ভের কাছাকাছি
একজন
হয়েছিল ঢেউ
অন্যজন ছিল মৃত্তিকার

সারসটি হয়ে গেল
এমন এক তিমি
আমাদের সবাইকে যে উগড়ে দিল
আমাদের বাহুর উপর

যোগাসনগুলো সব হযেছিল
তোমাদের জন্যে তোলা
পুষ্পের
পরাগ-নয়ন

যে-তোমরা ছিলে কেন্দ্র মহাসমুদ্রের
কণ্ঠস্বরের

জগতের সব 'কিছু'
পরিচিত রূপ নিয়ে
ফিরে এসেছিল ফের
আমাদের জীবনের মাঝে
শিলাখন্ডে
বারবার আছড়ে-পরা তার
তার জীবননাট্য আর গিরিচূড়াসমূহের
স্থবিরতা

আর ক্ষতবিক্ষত
খাঁড়িসমূহ
অবিশ্বাস্য পুনরুজ্জীবন
চিরন্তন কণ্ঠের
কামোন্মওতার
পরিকীর্ণ স্বচ্ছ ফেনা
বৈদ্যুতিক ইথারের
মূল
শান্ত হয়ে আছে আজ
আমাদের মাঝে
ধাবমান মৌমাছিগুলো
সিক্ত হয়ে বসে আছে
আমাদের মুখের উপর
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের
ঝড়ো স্বাধীনতা
আর অভিযাত্রার
স্বপ্নময় ভাষারাশি

নিরবতার
অক্ষরের
প্রান্তের
মানবতরীর মতো
ভূখন্ডে ভাসমান
আমরা ছিলাম
স্বয়ং সমুদ্র

জেলেদের
এই পৃথিবীতে
কোমলতার
দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘতম
চরকি। (সংক্ষেপিত)


নভেম্বর একুয়াদরের গুয়াইয়াকিল-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে জ্যাক নিজের কন্ঠে 'মা' শীর্ষক কবিতাটি মূল ভাষায় পাঠ করে শোনান
মা (Mother)
বহুদিন হয়ে গেল
আমরা এই পৃথিবীতে নেই
একদা ঘটেছিল, এখন তা শেষ হয়ে গেছে:
পৃথিবী, যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ।
এসবের মধ্যদিয়ে
হাত ধরে নিয়ে গেছি তোকে
ছোট্ট এক হাত, ছো্ট্ট এক তারা।
নড়চড়া করিসনি তুই
আমি ছিলাম মৃত, তুইও মরে গিয়েছিলি।
শোকের খোলা মুখে
একটি মোমের শিখা।

আমি নই আমার প্রশ্বাসের সাথে
আমি ধীরে চামড়া-ছাড়ানো কেউ
আমার দুচোখে দেখা
সকল মৃত্যুর সাথে আমি
মধুমাখা কদলীর চুল্লীর পাশে
আমি এক হাসিমাখা গাছ
রূপালি চামড়ার সেক্সি পোষাক
আর হাই হিল পরেছি আমি
আমি তাই হয়ে গেছি
যা-তোকে নিচে নামিয়েছে
হয়েছি সে-ভাষা তুই
খুঁজেছিলে যা
হয়ে গেছি থুথুু
এবং বখাটে,
নিহত ও অপরাজয়ের,
চাঁদের আলোর এক বেদম কুকুর
মাদকাসক্ত নারীদের অন্তরালে
করুণার কষাঘাত
সকল দন্ডিতকে
মুক্ত করতে লাল সুতো
তোর চুমুকগুলোয় ভারসাম্য আনে অঙ্গুলিত্রান
ঘুমপাড়ানি গানের দুঃস্বপ্নগুলি
কালিম্বা জড়িয়ে রাখে
শিশুর মৃত্যুকালে
জন্মের পরাক্রম।

বহুদিন হয়ে গেল
আমরা এই পৃথিবীতে নেই
একদিন ঘটেছিল, এখন তা শেষ হয়ে গেছে:
পৃথিবী, যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ।
এসবের মধ্য দিয়ে
হাত ধরে নিয়ে গেছি তোকে
ছোট্ট এক হাত, ছোট্ট তারকা।
এখন আর কান্না কেন
এখন তো অন্ধকারে প্রবেশ করেছিস।
আমার চতুর্দিকে আমার মতোন অনেকে,
আমাদের ইথারের সীমা নেই কোনো
আমরা যদি আর কখনোই কথা না বলি
তুমি লিখো আমাদের কথোপকথন।
আমার কন্ঠ যদি তোমার প্রাণের কাছে ব্যর্থ হয়ে যায়
(যদিও তা অসম্ভব
তুই তো এখনও এক দারুণ শিশু
জানালার ধারে আমি কাঁদছি),
অন্য কন্ঠগুলো তুলবে আমাকে
আর তারা নেবে তাকে তোর
প্রশ্বাসের কেন্দ্রের দিকে।

হে আমার আদরের ধন যখন বিস্ফোরিত হলি তুই অগ্নিশিখায়,
যখন তোর হাড়গুলো ছিল ফোস্কার মতো
ঠিক সে সময়
কে তোকে উরুর তীব্র ঝড়ের মধ্যদিয়ে নিয়ে গেছে
আর ব্যাকুল ডিম্বগুলোকে
দিতে চেয়েছিল গৌরব?
যখন তুই জেগে উঠলি এমন এক কিতাবের মতো
যা এই মুনাফার দোজখের অন্যায়ের বিরদ্ধে
ক্রদ্ধ এক পুস্তকে রূপান্তরিত হলো,
যখন তোর মন ভেঙে পরেছিল
যখন তোর লিঙ্গ-পরিচয়
কোরিয়া, ভিয়েৎনাম রূপে
উত্তর দক্ষিণ পরিচয়ে বিভক্ত হলো,
যখন জহর এলো আনন্দের সাথে
এবং গিয়েছে মরে বিষহর,
তখন কে কাটে হা্ওয়ায়
যেন মুচড়ে-দেয়া মুরগীর ঘাড়?
পালকগুলোকে কে ছিন্নভিন্ন করেছিল
তোর পতনকে করতে কোমল?

আমি সেই জীব যে কিনা রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে
মস্করার বিপরীতে চিৎকার করে বলে তোর নামখানি
আমি আত্মহননের ঘুম, সুপ্রাচীন চুলের এক ঝর্ণাধারা
অচেতন হৃদয়ে আমি মুক্তির আঘাত
বধিরের জন্য কবিতা।
শ্রম আর আনন্দের
শারীরিক গভীরতা থেকে
তোর হাসিকে দেবে ফিরিয়ে
একাকীত্ব, দয়া আর হাসি।
আসে শুধু আর্চনাসংগীতের স্পন্দন
মহাজগতের আত্মার বিজড়িত ধ্বনি।

বহুদিন হয়ে গেল
আমরা এই পৃথিবীতে নেই
একদা ঘটেছিল, এখন তা শেষ হয়ে গেছে:
পৃথিবী, যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ।
এসবের মধ্যদিয়ে
হাত ধরে নিয়ে গেছি তোকে
ছোট্ট এক হাত, ছো্ট্ট এক তারা।
একদা ঘটেছিল, এখন তা শেষ হয়ে গেছে:
পৃথিবী, যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ।
এসবের মধ্যদিয়ে
হাত ধরে নিয়ে গেছি তোকে
ছোট্ট এক হাত, ছো্ট্ট এক তারা।


নভেম্বর একুয়াদরের গুয়াইয়াকিল-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে জ্যাক নিজের কন্ঠে 'একদিন' শীর্ষক কবিতাটি মূল ভাষায় পাঠ শেষে রোকে দাল্তনের Act শীর্ষক কবিতাও পাঠ করে শোনান

একদিন (One Day)
একদিন আঁকাআঁকি ছেড়ে দিয়ে গাইবো কেবল
একদিন গান গাওয়া ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবো শুধু
একদিন বসা ছেড়ে শুধুমাত্র নিঃশ্বাস নেবো
একদিন নিঃশ্বাস নেয়া ছেড়ে মরবো কেবল
একদিন মৃত্যুকে ছেড়ে দিয়ে ভালোবেসে যাবো
একদিন ভালোবাসা ছেড়ে দিয়ে লিখবো কেবল