ফিদেলের মহাপ্রয়ান ও ট্রাম্পের বকোয়াজগিরি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 16 Oct 2011, 01:03 PM
Updated : 27 Nov 2016, 09:54 AM

বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো মাত্র বিগত হয়েছেন। নব্বই বছর বয়সে মারা যাওয়া অসামান্য জীবনের অধিকারী মানুষটি ছিলেন বিশ্বজোড়া বিপ্লব ও সাম্যবাদের পথিকৃৎ। সচ্ছল পরিবারে জন্ম নিয়েও যৌবনে দ্রোহের আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়ে ওঠা এক মানুষ। ঘরের কাছে বিপ্লবের প্রধান দুশমন দুনিয়ার সেরা শক্তি। দেশে বাতিস্তার লৌহকঠিন রাজত্ব। একবার ধরা পড়ে জেল খেটে বেরিয়ে এসেও থামেননি। গেরিলা রণকৌশলে ঠিকই জিতে নিয়েছিলেন তিনি।

সেই রণকৌশল কতটা সফল এবং নির্ভুল ছিল সেটা তাঁর জীবদ্দশায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ঘাড়ের কাছে বিষধর কালকেউটের ফণা– তাঁকে মেরে ফেলা বা বাণিজ্যিক অবরোধের নামে কিউবার বারোটা বাজানোর সব চেষ্টা একে একে ব্যর্থ করে দিয়ে দেশশাসনে টিকে ছিলেন বীরের মতো। তাঁর জনপ্রিয়তা কোনো দিন কোনো কালে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও হুমকির মুখে পড়েনি।

সবটাই কি একনায়কোচিত শাসনের ফল? তাই যদি হত জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর বাম দলের এই হাল হত না পাশের বঙ্গে। রাশিয়ার মতো দেশে লেনিনের মূর্তিভাঙ্গার উল্লাস দেখতাম না আমরা। বার্লিন দেয়াল ভেঙ্গে ইউরোপের সুখও দেখতে হত না। অথচ সব কিছুর পরও তাঁর দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন তিনি। তাঁকে উত্তর কোরিয়ার কিম দের মতো ভাবলেও ভুল হবে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় সেদেশের সব কিছু আরোপিত। কিন্তু কিউবা ও কাস্ত্রো যেন অন্য এক ভুবন। যা দূর থেকেও অনুভবে এক ধরনের শান্তি এনে দেয়।

ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর পরপরই ট্রাম্প বলেছেন, নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসকের মৃত্যু হয়েছে। যার মুখে যা মানায় ঠিক তাই যেন শুনলাম। এই দুনিয়ার কথিত মুরব্বি বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশ আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ভুলে গেছেন এখনও তিনি ভালো করে গদিনসীন হননি। তার আগেই ভয়াবহ হিংসার শিকার হয়েছে তাঁর দেশ। গণতন্ত্রের মুরব্বির দেশেই মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। এটা তো তাদের ভাষায় তৃতীয় বিশ্ব বা গরিবের দেশ নয় যে, মারামারি দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে থাকবে। এককালের পথপ্রদর্শক নামে পরিচিত গণতন্ত্র আর সভ্যতার দেশে মানুষ বিশেষত যুবশক্তি রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করছে আগুন জ্বালাচ্ছে- এসব দেখার পর আমরা বুঝেছি, ভেতরে ভেতরে সেখানেও কত বিপদ আর বেদনা লুকিয়ে।

এই আমেরিকা আজ যত কথাই বলুক না কেন, মূলত তার লেজের আগুনেই দুনিয়ার দেশে দেশে এত অশান্তি আর যুদ্ধের দাবানল। যারা ইতিহাস বিষয়ে অল্প-আধটু খবর রাখেন তারা জানেন, কোথাও তার বিজয় একচ্ছত্র কিছু নয়। মূলত তারা জেতেইনি কখনও। হেরে যাবার উদাহরণ হিসেবে জাপান, ভিয়েতনাম আর বাংলাদেশের কথা বলাই যথেষ্ট। এই তিন দেশে তারা বোমা ফেলে, যুদ্ধে জড়িয়ে বা মদদ দিয়েও কামিয়াব হতে পারেনি। বরং এই দেশগুলো আমেরিকার নীতিনির্ধারক ও সাম্রাজ্যবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজ সামনে ধাবমান। জাপানের কথা তো আলাদা। ভিয়েতনাম, বাংলাদেশও এখন আর তার তোয়াক্কা করে চলে না।

সেদেশের ট্রাম্প আমাদের লেখা পড়েন না। আমাদের কথা জানেনও না। জানলে বলতাম, "মাত্র ৯০ মাইল দূরের ওই দ্বীপদেশের ইতিহাস জানুন। নিজেদের অতীত ক্রিয়াকর্মের দিকে তাকান। ফিদেলের ৫০ বছরের শাসনামলে এগার জন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গদিতে বসেছিলেন। তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁকে সরানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁকে মারবার জন্য হেন কাজ নেই যা আপনারা করেননি। তাঁর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে জুতোয় বিষ ঢুকিয়ে গুলি করে ক্যু করে মানুষকে প্রলোভনে রাগিয়ে তুলে– যতভাবে সম্ভব সব ভাবেই আপনারা ট্রাই করেছিলেন, ট্রাম্প সাহেব!"

কাজ হয়নি। তিনি এমন এক মানুষ ছিলেন যাঁর বুকে বিপ্লবের আগুন, মেধায় শাণিত ধার। আমাদের দেশের নেতা জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আলাপের সময় তিনি তাঁকে সাবধান করে বলেছিলেন, বিপ্লবের পর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে কী করতে হয়। সেটা আমরা শুনিনি, শুনলে জাসদের জন্ম হত না। নভেম্বরে দেশ নেতাশূণ্য হত না কথিত বিপ্লব বা সংহতির নামে। দীর্ঘমেয়াদী বিভেদেরও জন্ম হত না।

ফিদেলের বর্ণাঢ্য জীবনের বন্ধু চে গুয়েভারা। আজ তারুণ্যে তাদের যে অসীম জনপ্রিয়তা, আমেরিকা কি ঠেকাতে পেরেছে? আমি কোনো দিন কোনো মার্কিন তরুণ বা তরুণীকে তাদের দেশের কোনো নেতা-নেত্রীর ছবি আঁকা টি শার্ট পরে ঘুরতে দেখিনি। ট্রাম্প সাহেব, তাকিয়ে দেখুন, সব বাড়িতে না হলেও অধিকাংশ ঘরেই যুবক-যুবতীদের টি শার্টে চে-কে দেখতে পাবেন। আমি হাওয়াইতেও দেখেছি এর কী কদর! আপনার যাদের ঠেকানোর জন্য জানবাজি রাখলেন তারাই ঢুকে আছে আপনাদের ঘরে।

আর আপনাদের কেউ কখনও কিউবার যুবক-যুবতীদের বুকে জায়গা করে নিয়েছেন এমন জানলে জানাবেন– আমরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে প্রায়শ্চিত্ত করে নিব।

ফিদেল তাঁর দেশকে আমেরিকা বানাতে পারেননি। দরকারও ছিল না। কারণ আপনারা যে স্বর্গ রচনা করেছেন বা করেন তার নাম আত্মসুখ। নিজে ভালো থাকার দাসত্বের স্বর্গ পুঁজিবাদের কামনা হতে পারে, সাম্যবাদের নয়। সবাই মিলে ভালো থাকতে গেলে ভাগে একটু কম পড়বেই। সেটা ছাড় দেবার নাম ত্যাগ।

ফিদেলের দেশের আদল সে রকমের। যে কারণে সেখানে আপনাদের দেশের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বন্যা ঝড় হলে একজন মানুষও মরে না। মরলেও তার সংখ্যা আপনাদের চাইতে কম। আপনাদেরকে তারা শিখিয়েছে কাকে বলে প্রতিরোধ ও প্রতিকার। আপনারা ভোগের আনন্দে এসব ভুলে যান বলেই ক্যাটারিনা এলে মানুষও খড়কুটোর মতো ভেসে যায়।

কিউবাতে অনেক কিছু এখনও পিছিয়ে। আমার পুত্রতুল্য রাহুল সে দেশ ভ্রমণে গিয়ে জানিয়েছে তার যোগাযোগ সমস্যার কথা। কিন্তু সে সঙ্গে এটা যোগ করেছিল যে, সে জন্য টেনশনের দরকার নেই।। সে জানে আমার ঘরের কেউ বাইরে থাকলে কুশল না জানা অব্দি আমি ঘুমাতে পারি না। কিউবায় রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগহীনতার কারণ সেখানকার স্লো ইন্টারনেট। ফোন করাও তেমন সস্তা নয়। তারপরও রাহুলের ভালো লেগেছে সেখানকার মানুষের আন্তরিকতা। আমার জন্য কাস্ত্রোর ছবিওয়ালা একটা ফ্রিজ ম্যাগনেট নিয়ে এসে বলেছিল, "সেখনকার মানুষের জীবনকে আমেরিকার চাইতে শান্তির সুখের করে দিয়ে গেছেন ফিদেল। কারণ তারা রাতদিন টাকার পেছনে দৌড়ায় না। প্রতিযোগিতার নামে আমাদের মতো জীবনভর জীবনকে চ্যালেঞ্জ করে ছুটতে হয় না তাদের "

এটার কী প্রশান্তি বা আনন্দ তা আপনি বুঝবেন না, ট্রাম্প।

সবচেয়ে বড় কথা, কিউবার নাম সারা দুনিয়ায় অন্যভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যে কারণে ম্যারাডোনাও ছুটে গিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে ধন্য হন। শক্তির বিপরীতে দাঁড়ানো এই গেরিলা আমার জন্মের বছর সে দেশে যে কাজ করেছিলেন তা আজও আমাদের স্বপ্ন দেখায়। এমন স্বাপ্নিক মানুষ আজকের দুনিয়ায় আর কোথায়?

ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লব বা আদর্শের দেশগুলোও এখন আর আগের জায়গায় নেই। পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী সব বদলায়। বদলাতে হয়। কিন্তু আমরা যারা মানি দুনিয়ার ইতিহাস মানে কিছু কীর্তিমান উজ্জ্বল মানুষের ইতিহাস, তা ফিদেলকে অবিনাশী চিরজ্ঞীব মনে করি। দেশে দেশে ফিদেল, গাঁধী, শেখ মুজিবর রহমান বা মান্দেলার মতো মানুষ খুব কমই জন্মায়। যারা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে আসেন।

এসব আপনার বোঝার কথা নয়, ট্রাম্প সাহেব। আপনি সিরিয়ার আইএস বা আফগানিস্তানের তালেবান বা আমাদের জঙ্গিরা দুনিয়ায় আছেন উল্টে দিতে। উল্টে দিলে চেটেপুটে খাবার মানুষদের সাধ্য নেই বিপ্লবীকে মূল্যায়ন করে। আজকের দুনিয়ায় কথা বলার মানুষ নেই। সত্যকে সত্য মিথ্যাকে মিথ্যা বলার বা চোখে আঙুল দিয়ে আসল দেখানোর কেউ নেই। থাকলেও তাদের কণ্ঠ রোধ করে দিয়েছেন আপনারা। জর্জ বুশের এই নীতির পর থেকে ক্রমাগত একঘরে হয়ে ওঠা আমেরিকা আয়নায় নিজের চেহারা দেখে না। দেখলেও ফিদেলের সমালোচনা করার আগে ভাবত, তাদের মানুষ কীভাবে মূল্যায়ন করে।

স্নায়ূযুদ্ধের নামে ষড়যন্ত্র করে সোভিয়েত ভেঙে গর্বাচেভের জন্ম দেওয়া যায়, কিন্তু টেকে না। পিজ্জার বিজ্ঞাপনের নায়ক বা মডেল বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া গর্বাচেভের খবর রাখে কেউ? কেউ জানে না টনি ব্লেয়ার কোথায়। অথচ আজও মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে লেনিন মাও বা হো চি মিনের কাছে যায়। কারণ একটাই, মানুষের অন্তরে জাগতিক সমতার আকাঙ্ক্ষা। তারা চায় সমাজতন্ত্র হোক আর যা-ই হোক, মানুষ যেন মানুষের মতো বাঁচতে পারে। তার জীবন থেকে অস্ত্র যুদ্ধ হিংসা ও অসাম্যের মতো ভয়াবহ শয়তানগুলো দূর করতে এককালে সে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখত।

আমেরিকা ও ইউরোপের পুঁজিবাদ তা ঠেকাতে মাঠে নিয়ে এসেছে উগ্র ধর্মীয়বাদ। দূরে যাবার দরকার নেই। এদের মদদে একদা পুষ্ট পাকিস্তানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কাকে বলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। আজ তাকে তারা নিজেরাই সামলাতে পারছে না। কিউবা দেশ হিসেবে যা-ই হোক, সে এমন এক বিপ্লবের সূতিকাগার যা মানুষের মনের ভেতর আশার ছোট এক প্রদীপ জ্বেলে রাখে। কোন দিকে কোথায় তাকাবে মানুষ? কোথায় তাকিবে দেখবে সমতা আর ভালোবাসায় অতি বিত্তশালী না হয়েও ভালো থাকা যায়? থাকা যায় নিজের মতো করে আপন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে?

ফিদেল ছিলেন তেমন একজন। যাঁকে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশের মানুষ ও নেতারা আপন ভাবতেন, যাঁর কাছ থেকে শক্তি নিতেন।

বিপ্লব এমন এক বিষয় যা নিয়ত ভাঙচুরে নাম বদলায়, অবয়ব পরিবর্তন করে, কিন্তু মরে না। ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তারই শেষ বিরল প্রতিনিধি। তাঁর মৃত্যু নেই।