সৈয়দ আশরাফ: মৃত্যুতেও অনিঃশেষ জয় বাংলার প্রতীক

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 14 Dec 2011, 11:29 AM
Updated : 8 Jan 2019, 12:00 PM

জানাজা নিয়ে জেনারেল জিয়ার সমর্থকদের একটা গর্ব ছিলো। আমার পরিচিত অনেকের ভেতরও তা  আমি দেখেছি। বঙ্গবন্ধু বা চার জাতীয় নেতার সাথে জিয়ার ইমেজ এঁটে উঠতে না পারলে তারা সে প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তাদের গর্বে তখন বুক টানটান। ঢাকায় জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামে কবর খুঁড়ে তুলে এনে দ্বিতীয় দাফনে লোকের ঢল কেন সেটা তারা কখনো বিবেচনায় আনেননি। তখনকার বাংলাদেশ এক অন্যধরনের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার করুণ মৃত্যুর পর দিশেহারা মানুষ কিছুই বুঝতে পারছিল না।

যারা এদেশের প্রগতিশীল মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধের বীর বা অনুগত যারা সাধারণ মানুষ, সবার মনে তখন আতংক।  তাদের তখন গৃহবন্দি অবস্থা। তার ওপর ছিলো ভয় ভীতি। আমরা তখন গোঁফ গজানো যুবক। ভুলিনি সেই সামরিক শাসনের নির্যাতন আর নিপীড়ণ। স্তব্ধ মানুষ তাদের অনুভূতি জানানোর সুযোগ পাবার আগেই তড়িঘড়ি করে বঙ্গবন্ধুকে দাফন করা হয়েছিল তার গ্রামের বাড়িতে। আপনারা যারা খবর রাখেন তাদের অজানা না সেদিন কি কষ্ট আর বেদনায় মানুষ তাদের বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল।

হত্যাকারিরা জাতির জনককে গোসল দিতেও চায় নি। সামান্য সাবানে গোসল করিয়ে যত তাড়তাড়ি সম্ভব তাদের পাপ মাটিচাপা দেয়ার সে ষড়যন্ত্রের সাথে সরকারী দলের অবৈধ শাসকের জানাজা এক হয় কী ভাবে? যদি নির্মোহ ভাবে লিখি বলবো সাথে ছিলো অপপ্রচার। মানুষ সত্যি তখন ভড়কে গিয়েছিল। একদিকে আমেরিকা চীনসহ পাকিস্তানের মরণ কামড় আরেকদিকে দেশে রাজাকার দালালদের আবার ফিরে আসা। মিডিয়া ও তখন ছিলো এক ভয়াবহ ভূমিকায়। গুজবের সমাজে বঙ্গবন্ধু যখন সামাল দিতে দিতে ক্লান্ত তখনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর মানুষকে কাঁদার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি:।

জানাজার তুলনাও অনৈতিক। কিন্তু বিষয়টা ভিন্ন। বিষয় এখানে রাজনীতি। তাদের ধারণা আওয়ামী লীগের নেতাদের কারও আসলে তেমন জনপ্রিয়তা নাই। পরপর তিনবার দেশ শাসনের অধিকার পাবার পরও তারা বলে, সবটাই হয় আনুকূল্য নয়তো জোর জবরদস্তি। এ যে কতবড় ভুল সে তাদের মগজে ঢোকেনা।  সেদিন ও এদেশের প্রশাসন সামরিক বাহিনী পুলিশ আমলাতন্ত্র সব ছিলো বিএনপির অধীনে। এমনকি তাদের মনোজগত ছিলো জাতীয়তাবাদী। খালেদা জিয়া তখন একক নেতা। তার ব্যক্তি ইমেজ আর বিউটি ইমেজ মিলে আনপ্যারালাল। কিন্তু সে সময়কালে তারা ইতিহাস অতীত আর গর্বের জায়গাগুলো থেকে একটু একটু করে দূরে সরার পাশাপাশি সবকিছু হত্যা ও বিকৃতির পথে পাগলের মতো দৌড়ে চলেছিল ভাবখানা এই কিছু বছরের মধ্যেই মানুষ সব ভুলে যাবে।

মেনে নেবে একাত্তরে কিছু গণ্ডগোল ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছিল এমনি এমনি। একজন মেজরের বাঁশির ফুঁতেই কেল্লাফতে। তার ওপর চলছিল বালখিল্য এক নেতার আগমনে 'সবকিছু উল্টে দে মা লুটে পুটে খাই' । এভাবেই  জনবিচ্ছিন্ন হবার পাশাপাশি নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনার পরও হুঁশ ফেরেনি তাদের। অন্যদিকে ইতিহাস ও সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার প্রতিশোধ গ্রহণের। কথাটা যতই ভাবাবেগের মনে হোক না কেন এদেশের মাটি ও রক্তের সাথে যারা বেঈমানি করে তাদের পরিণতি সবসময় ভয়াবহ। এটাই এ মাটির গুণ।

চার জাতীয় নেতার বিষয়ও মর্মান্তিক। তারা জনপ্রিয়তা হারাননি কোনওকালে। তাদের মারা হয়েছিল দেশকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য। আওয়ামী লীগ যেন আর কোনদিনও দেশ শাসনে আসতে না পারে সে জন্য। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারীদের হত্যার ভেতর ছিলো নির্মম প্রতিশোধস্পৃহা। তাদের পরিবারকে  কাঁদার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাদের বলা হয়েছিল শব্দ করে না কাঁদতে। সে পরিবেশে তাদের জানাজা কিভাবে হয়েছিল আর কারা তা করেছিল সবাই জানেন। সময় কখনো কাউকে ছেড়ে কথা বলেনা এদেশের ইতিহাস আর মুক্তিযুদ্ধ যে কতটা শক্তিশালী তা বারবার প্রমাণিত হবার পরও দুশমনেরা মানতে চায় না। এবার আমরা কী দেখলাম?

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ছিলেন বটে তবে তিনি কখনো প্রগলভ ছিলেননা। বরং তার ইমেজ ছিল পরিমিত কথাও সততার এক নিরীহ ইমেজ। এই মানুষটি চরম সংকটের সময়ও মাথা গরম করে চোখ রাঙিয়ে বা চোখ বড় বড় করে ধমক দেননি। ঠাণ্ডা মাথায় বলেছিলেন, এর পরেরবার দেশে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের ঘর থেকেও বেরুতে দেবেন না। সে দুর্যোগ সমাল দিয়েছিলেন পরম ধৈর্যে।

মানুষ তা পছন্দ না করলে তার মৃত্যুর পর স্মরণকালের বড় জানাজা করার জন্য ছুটে আসতো? যতদূর জানা যায় তিনি কারো তদ্বির নিতেন না। সে কারণে অফিসেও কম যেতেন। অথচ আমাদের সমাজের বৈশিষ্ট্যই হলো তদবীর আর ঘুষ। এই দুই আপদ বিপদ থেকে নিজেকে দূরে রাখার মানুষটিতো এক শ্রেণিতে গ্রহণযোগ্য হবার কথা না। বরং তাকে ঠেকাতে পারলেই তারা বেঁচে যেত। যে মানুষ ভরা মজলিসে বলতে পারেন তার রক্তে বেঈমানি নাই তিনি যদি সা্সী না হন তো সাহসী কে? চারদিকে গিজগিজ করা ছদ্মবেশি বেঈমানদের দেশ ও সমাজে  এমন বুকের পাটা কয় জনার আছে? দেশ ছেড়েই চলে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা একেক করে চার জাতীয় নেতার সন্তানদের ফিরিয়ে এনে দেশ ও জাতির ঋণ শোধ করেছেন। সে আগমনে তিনি যে এলেন সততা আর ভালোবাসাতেই জয় করলেন বাংলাদেশ।

মানুষ তাকে কেন ভালোবাসবে না? যে নেতা মন্ত্রী হবার পর ও স্ত্রীর অসুখে চিকিৎসার জন্য বাড়ি বিক্রি করে দেন তাকে মানুষ মাথায় রাখবে এটাইতো স্বাভাবিক। সবকিছুর ওপরে আছে তার পিতা ও দেশের রাজনৈতিক ইমেজ। সে ইমেজটা মুক্তিযুদ্ধের সে ভাবমূর্তিটা দেশপ্রেমের। আজ নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস খোলা বই।  আজ আর আগের মত মিথ্যা বলে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে ইতিহাস নির্মাণ করা যায় না। অসম্ভব ভিলেনকে হিরো বানানো। মাঝখানের ভ্রান্তি আর কিছু দলকানা পাকিপ্রেমি ধর্মান্ধ  সাথে কিছু সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত মানে বাংলাদেশ না। সেটাই দেখলাম আমরা। সৈয়দ নজরুল তাজউদ্দিন আহমেদ, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলীকে জাতি যে সম্মান বা শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি ৪৩ বছর পর সে সম্মান শতগুণে ফিরিয়ে দিলো সৈয়দ নজরুলের পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে।

পিতা পাননি। তাকে তার বন্ধুদের সাথে কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর নীরবে নিভৃতে অপমান করে বিদায় দেওয়া জল্লাদেরা ভেবেছিল, শেষ করে দিয়েছে সব। চোখ খুলে দেখো, এভাবেই জবাব দেয় ইতিহাস। এভাবেই জেগে ওঠে ইতিহাস। এভাবেই মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা। লাখো জনতা সৎ, নিষ্ঠাবান,  আদর্শিক সৈয়দ  আশরাফুল ইসলামকে চোখের পানিতে বিদায়  জানিয়েছে । যাদের চোখে এখনো ঠুলি, যারা এখনও বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধকে 'গণ্ডগোল' মনে করে, যাদের মনে 'জয় বাংলা' নিয়ে সংশয় আর দ্বিধা তাদের বলি চোখ মেলে দেখুন। মানুষের বুকে কেমন  চিরঞ্জীব এই সব । কিভাবে তারা পাগলের মতো ছুটে এসে জানিয়ে দিয়েছে জয় বাংলার মৃত্যু নাই। সৈয়দ আশরাফ তথা তার আদর্শই হয়ে উঠছিল এক টুকরো লাল সবুজ।।