ছোট্ট খোকার বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্প

লাভা মাহমুদা
Published : 9 Jan 2012, 08:00 AM
Updated : 22 March 2020, 03:21 PM

রাতের অন্ধকারে যেদিন হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে, সেদিনের কথা খুব আবছা মনে পড়ে। সবার মধ্যে ছিল কেমন যেন অস্থিরতা, কাউকে ডুকরে কাঁদতেও দেখেছি। কি নিদারুণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল চারিদিকে । খুব ছোট ছিলাম, কিন্তু গুরুতর কিছু একটা হয়েছে, তা ওই ছোট্ট বয়সেই বুঝেছি। স্মৃতির মানসপটে সেদিনের কথা উঁকি দিলে এখনো বিষণ্নতা ভর করে। কী অন্ধকার নেমে এসেছিল এ ভূখণ্ডে, গভীর অন্ধকার । যে অন্ধকার বাঙালি জাতিসত্তাকে দিশাহীন করেছে। দিনটি ছিল ১৫ই অগাস্ট ১৯৭৫; হত্যা করা হয় এ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠেছি মুজিবহীন বাংলায় এবং ইতিহাসের পাতা থেকে তার নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রের সময়। কিন্তু যিনি নিজেই ইতিহাসের স্রষ্টা তাকে অগ্রাহ্য করার সাধ্য কার?

১৯২০ সালের ১৭ এপ্রিল টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে বেড়ে ওঠা দুরন্ত কৈশোরের সেই 'খোকা' কালের পরিক্রমায় ইতিহাস সৃষ্টি করে নিজেই হয়ে ওঠেন ইতিহাসের বরপুত্র। তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে জানা যায় তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠার কথা। মানুষের অভাব, দরিদ্রতা তাঁকে ছুঁয়ে যেত, কষ্ট দিত। তাইতো মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আর ভালোবাসা থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন সেই স্কুল জীবনেই । ছাত্রাবস্থাতেই সাধারণের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। জেলও খেটেছেন সেই বালক বেলাতেই । রাজনীতি তাঁর মননেই ছিল । রাজনীতির জন্যই তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন, রাজনীতির কাছেই ছিল তাঁর আত্মসমর্পণ। সে সময়ের বড় দুই নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যও তাঁর রাজনীতিতে আগমনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। রাজনীতিতে তিনি গুরু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও শেখ মুজিবের মধ্যে 'ভবিষ্যৎ' দেখেছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করেছে সোহরাওয়ার্দী মানুষ চিনতে ভুল করেননি। তবে তিনি নিজের জীবন থেকেই পাঠ নিয়ে রাজনীতি করেছেন এবং কারো দেখানো পথে না হেঁটে নিজেই তাঁর রাজনীতির পথ নির্মাণ করেছেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে। তিনি উপলব্ধি করেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির স্বার্থ-বিরোধী। বাঙালির অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই হয়ে ওঠে তাঁর লক্ষ্য। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে এই ভূখণ্ডের সকল আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের কাতারে এবং ১৯৭১ এ তাঁর হাত ধরেই এ দেশ পায় স্বাধীনতার স্বাদ। তাঁর চলার পথ ছিল নিষ্কণ্টক ছিল না। জেল-জুলম ছিল নিত্য সঙ্গী। তের বছরের কারাজীবন, ফাঁসির হুমকি – কোনও  কিছুই তাঁকে হতোদ্যম করেনি। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে – এটা বিশ্বাস করে তিনি চলেছেন এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে মানুষ । তাঁর নেতৃত্বেই আমরা বাঁচতে শিখেছি, হাসতে শিখেছি, স্বাধীনতার কথা বলতে শিখেছি। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে বঙ্গবন্ধু শব্দটি সমার্থক হয়ে গেছে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল দুঃখী মানুষের পক্ষে তিনি সবসময় শোষিত, বঞ্চিত আর নিপীড়িতের কথা বলতেন । তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করে সরকারের যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাতে সমাজের শোষক শ্রেণি, এলিট শ্রেণির চক্ষুশূলে পরিণত হলেন। তিনি বলেছিলেন – 'পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত – আমি শোষিতের পক্ষে'। তাঁর দৃপ্তকণ্ঠের উচ্চারণ ছিল, 'আলেন্দের পরিণতি বরণ করবো, তবু সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করবো না'।   তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের এক নেতার আকাশ ফুঁড়ে মহাকাশ ছোঁয়াকে সাম্রাজ্যবাদী মোড়লরা সহজভাবে নিতে পারেনি । তাঁর খ্যাতি, জনপ্রিয়তা তাদের সহ্য হয়নি। তাইতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাঁকে হত্যায় সক্রিয় হয়ে উঠলো ঘাতক চক্র ।

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল দেশের মানুষের প্রতি প্রবল আবেগ। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে কঠোরভাবে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পরে এই আবেগের কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনায় কঠোর হতে পারেনি, শক্ত হাতে দমন করেননি ; এমনকি মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদেরও। আর ছিল মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তাইতো তাঁর জীবন শঙ্কার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেও বিষয়টি তিনি একেবারেই আমলে নেন নাই। সেই সুযোগেই ঘাপটি মেরে থাকা ঘাতকের দল হত্যা করলো স্বাধীন বাংলার স্থপতি, মহানায়ক, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে।

হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ একুশ বছর পর্যন্ত জানতেও দেওয়া হয়নি দেশ ও জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদানকে। শুধু জানতে না দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাঙালি জাতিস্বত্তা বিকাশে তাঁর ভূমিকাকেও অস্বীকার করা হয়েছে প্রবলভাবে। এমনকি সংবিধানকে ক্ষত বিক্ষত করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচারকে রহিত করা হয় । পৃথিবীর ইতিহাসে কে কোথায় দেখেছে, আইন তৈরি করে বিচার বন্ধ করা হয়, তাও আবার স্বাধীনতা এনে দেওয়া জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার হত্যাকাণ্ডের বিচার।

তবে সেই ঘাতকদের ক্ষমা করেনি জাতি, ক্ষমা করেনি ইতিহাস। মহান এ বাঙালির ঘাতকেরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষিপ্ত হয়েছে অনিবার্যভাবে।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং গণতান্ত্রিক আদর্শেই তিনি বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেও তা দেখা যায়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা তাঁর আদর্শ ধারণ করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক একটি দেশে রাজনৈতিক বিভাজন থাকবে। ভিন্নজনের চিন্তার বৈচিত্র্যই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে দল মতের উর্ধ্বে উঠে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনকে শ্রদ্ধার সাথে লালন করতে হবে। আলো ঝলমলে নিয়ন বাতি আর আনন্দোৎসবের ভেতর আটকে না থেকে তাঁর লালিত স্বপ্ন পূরণে তাঁর দেখানো পথেই হাঁটতে হবে। আর এ জন্য তাঁঁর রচিত গ্রন্থগুলো সবাইকে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারলেই তাঁর প্রতি সম্মান দেখানো হবে।বাঙালি জাতিকে আলোর দিশা দেখানো রাজনীতির কবি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্মশতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।