চেতনার অগ্নিশিখা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম

শান্তা পত্রনবীশ
Published : 13 Feb 2012, 09:26 AM
Updated : 25 June 2021, 07:10 PM

জাহানারা ইমাম। সাধারণ দৃষ্টিতে খুব সামান্য একটা নাম। কিন্তু কি উজ্জ্বল দ্যুতি ওই একটা নামে- যার আলোকে উদ্ভাসিত সমগ্র বাঙালির অন্তর। প্রথমে 'একাত্তরের দিনগুলি', তারপর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলন তাকে কোটি মানুষের হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ক্ষমতার মোহ বা কোন পার্থিব প্রাপ্তি নয় নিছক দেশপ্রেম থেকে, দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকেই এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন তিনি। তিনি বলতেন,  'দেশের কাছ থেকে আমার পাবার কিছুই বাকি নেই। দেবার আছে অনেক কিছু। আমার স্বামী-সন্তান জীবন দিয়েছে  দেশের জন্য, আমার মৃত্যু যদি হয় দেশের জন্যে তাতে আমি গর্বিত।' নিজেকে মাটির প্রদীপের সাথে তুলনা করে  বলতেন, 'আমি মাটির প্রদীপ। আমার কর্তব্যটুকু সলতের শেষ তেল বিন্দুটি পর্যন্ত করে যাবার চেষ্টা করবো। তাতেই  আমার সার্থকতা।' তাই শহিদের রক্তেভেজা বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে  সর্বোতভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন তিনি।  

জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। তার আধুনিকমনস্ক পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ আবদুল আলী  এবং মাতা সৈয়দা হামিদা বেগমের স্নেহের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। পিতার বদলির চাকরির সুবাদে দেশের  নানাপ্রান্তে তার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে। সুন্দরপুরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে ঘুরে ঘুরে এক কিশোরীর বড় হয়ে উঠার কাহিনী তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তার স্মৃতিকথা অন্যজীবন-এ। ১৯৪২ সালে জাহানারা ইমাম ম্যাট্রিক পাস  করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। জাহানারা ইমাম যখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে  ভর্তি হন তখন তিনিসহ মোট তিনজন মুসলিম নারী ওই কলেজে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি রংপুর 

কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে বিএ তে ভর্তি  হন। ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন জাহানারা ইমাম। ১৯৬০ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে  বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ (প্রিলি) সম্পন্ন করেন।  পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথমস্থান অধিকার করেন। জাহানারা ইমাম ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে  যুক্তরাষ্ট্র যান। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ (পার্ট-টু) পাস করেন। 

রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন জাহানারা ইমামের পরিচয় হয় শরীফ ইমামের সাথে। পরিচয়  থেকে ঘনিষ্ঠতা। উভয় পরিবারে আলাপ আলোচনার পর তাদের সম্পর্ক পারিবারিক স্বীকৃতি পায়। জাহানারা ইমাম ১৯৪৮ সালের ৯ অগাস্ট পরিণয় সূত্রে বাঁধা পড়েন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমামের সাথে। বিয়েতে লাল বেনারসী এবং সোনার গয়নার পরিবর্তে সাদা সালওয়ার-কামিজ এবং রজনীগন্ধা ফুলের গহনা দিয়ে সেজেছিলেন তিনি। সাদা পোশাক ও অলংকারহীন এ বিয়ে যুগের তুলনায় তার অগ্রসর চিন্তার ইঙ্গিত বহন করে। ১৯৭১ সালে তার সুশঙ্খল, সুখী, গৃহী জীবনের ছন্দপতন ঘটে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমী মুক্তিযুদ্ধে একজন দুঃসাহসী গেরিলা হিসেবে ভূমিকা রাখেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে শহীদ হোন। 

স্বাধীনতার পর  শহিদ রুমী বীরবিক্রম (মরণোত্তর) উপাধিতে ভূষিত হন। জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফ ইমামকেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্যাতন করে আহত অবস্থায় মুক্তি দেয়। বিজয়ের মাত্র কিছুদিন আগে ১৩ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পুত্র এবং স্বামী হারানোর কষ্টকে বুকে ধারণ করে কনিষ্ঠ পুত্র জামীকে নিয়েই বেঁচেছিলেন তিনি। 

জাহানারা ইমামের কর্মজীবন মূলত শিক্ষকতার মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। স্বামী  শরীফ ইমামের কর্মস্থল ঢাকায় হওয়ায় তিনি চাকুরি ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে  ঢাকার সিদ্বেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। মাঝে কিছু দিন বাদ দিয়ে  ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জাহানারা ইমাম ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬২-১৯৬৪  সাল পর্যন্ত বুলবুল একাডেমী কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জাহানারা ইমাম। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ এ দু'বছর তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে ছিলেন। পরবর্তীসময়ে ১৯৮২ সালে স্বল্প  সময়ের জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

জাহানারা ইমামের সাহিত্যচর্চা ছিল বহুমাত্রিক। একজন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে লেখালেখির জগতে প্রবেশ জাহানারা ইমামের। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মূলত লেখক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় ডায়েরি আকারে লেখা 'একাত্তরের দিনগুলি'। জাহানারা ইমাম আত্মজ শহীদ রুমি ও মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা নিয়ে  স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ 'একাত্তরের দিনগুলি' প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাভাষী সর্বস্তরের পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেন। গ্রন্থে  বিধৃত নারকীয় ঘটনার বর্ণনায় মাতৃ-উৎকণ্ঠা প্রকাশের গভীরতায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গঠন ও বিস্তারে তার এই  গ্রন্থ সর্বমহলে সমাদৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জীবনায় এই দলিল আজ ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত। এ গ্রন্থটির কারণে দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন তিনি। তার সাহিত্য জীবন অনুবাদ, শিক্ষামূলক রচনা, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনী, গল্প-উপন্যাস, টিভি সমালোচনা, শিশু কিশোরদের উপযোগী ছোটগল্প  সমৃদ্ধ। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে তিনি মুসলিম সমাজের নানা বিবর্তন, সংঘাত, সংঘর্ষ, আশা -আকাঙক্ষা, আত্ম-প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং সমাজে নারী জাগরণ ও প্রগতির বহু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এছাড়াও দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা উত্থান-পতনের তিনি সাক্ষী ছিলেন। অর্জন করেছেন প্রচুর অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখা যায় তার রচনাবলীতে। জাহানারা ইমামের সমগ্র রচনায় প্রগতিশীল চিন্তা,  মানবতাবাদ, মুক্তবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত জীবনবোধ, দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রাধান্য পেয়েছে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সর্বান্তঃকরণে একাত্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের সচেতন পর্যবেক্ষক ও সমর্থক ছিলেন জাহানারা ইমাম। জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমী দু নম্বর সেক্টরে যোগ দেওয়ার ফলে এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এক নিবিড়  যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল তার। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সাহায্য করেছিলেন তিনি। ঢাকায় গেরিলা অপারেশনে আসা গেরিলাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, ক্লিনিকের ব্যবস্থা করা,ঔষধপত্র, কাপড় চোপড়  সর্বোপরি অর্থের সংস্থানের জন্য ব্যস্ত ছিলেন তিনি। যখন যেভাবে পেরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দিয়েছেন। 

নগদ অর্থ ছাড়াও ছোট ছোট প্যাকেট করে কাটা ছেঁড়া, টাইফয়েড, আমাশয়, জ্বর-মাথা ব্যথা, সর্দি- কাশির জন্য বিভিন্ন ঔষধও পাঠাতেন জাহানারা ইমাম। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে যাতে নিজেরাই প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারে তাই ছোট কাঁচি, ব্লেড, তুলা-গজ এসবও পাঠাতেন তিনি। যুদ্ধকালীন সময়ে জাহানারা ইমামের বাড়ি  ছিল গেরিলা যোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। জাহানারা ইমামের বাড়িতে ক্ষণিকের জন্যে হঠাৎ এসে পড়া  মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও সর্বক্ষণ সঞ্চিত থাকতো খাদ্য রসদ। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোন ধরনের সহযোগিতা  করতেও প্রস্তুত ছিলেন তিনি।  

জাহানারা ইমামের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় মূলত ১৯৮০ এর দশকে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি  'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির' আহ্বায়ক হন জাহানারা ইমাম। নির্মূল কমিটির প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই  উপস্থিত থাকতেন জাহানারা ইমাম। রাজধানী ঢাকায় আন্দোলনের পাশপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন  বিস্তারের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। আন্দোলন পরিচালনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেন জাহানারা ইমাম। তার বাজার খরচের টাকাও নিয়মিত খরচ হয়েছে আন্দোলনের খাতে। আন্দোলনের কর্মীদের বিশেষ করে যারা শিক্ষার্থী কিংবা বেকার তাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি। দুপুরে অভুক্ত মলিন চেহারা নিয়ে কোনও কাজে কেউ তার বাসায় গেলে ফ্রিজে কিছু না থাকলে শুধু ডিম ভাজি আর ডাল দিয়ে হলেও ভাত খেতে দিয়েছেন। বাসা থেকে  ফেরার সময় তার পকেটে পঞ্চাশ নয়তো একশ টাকার নোট গুঁজে দিতেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে কমিটির আহ্বায়ক  হিসেবেও যথাযথ দায়িত্বপালন করছিলেন। ১৯৯৪ সালের মার্চের শেষদিকে খুব দ্রুত জাহানারা ইমামের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আশির দশকের শুরুতে ১৯৮২ সালে জাহানারা ইমাম দুরারোগ্য ব্যাধি ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্রয়েট হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত অবস্থায়ও সুলিখিত চিঠিতে আন্দোলন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন জাহানারা ইমাম। মৃত্যুশয্যা  থেকেও দেশবাসীর প্রতি আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি। দেশবাসীর প্রতি  জাহানারা ইমামের শেষ আহ্বান ও নির্দেশে তিনি বলেন: 'সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ, আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতা বিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এ লড়াইয়ে  আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণ ব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথ  বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার  আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ  পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরীরা সোনার বাংলায় থাকবেন। এ আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন  রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ লড়াইয়ে আছে।  তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও  যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও '৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।' 

বাংলাদেশের জনগণের কাছে তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব অর্পণ করে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন জাহানারা ইমাম।  

জাহানারা ইমামের রচনা, বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার, জীবনাচারণ থেকে তার চিন্তাচর্চা বা জীবনদর্শনের কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। জাহানারা ইমামের সমগ্র রচনার মধ্যেই দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীল চিন্তা, মানবতাবাদ, মুক্তবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত জীবনবোধ স্থান পেয়েছে। তার জীবনবোধ ছিল অসাম্প্রদায়িক। জাহানারা ইমাম মনে  করতেন, ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম বিশ্বাসী, ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে ধর্মীয় গোড়ামী ছিল না। ধর্মের নামে শাসন ও শোষণ কোনোটাই তিনি পছন্দ করতেন না। রাষ্ট্র এবং ধর্মকে এক করে  দেখার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। জাহানারা ইমামের চিন্তাচর্চায় সবসময় প্রাধান্য পেয়েছে প্রগতিশীলতা। সময়ের তুলনায় অগ্রসর চিন্তার অধিকারী ছিলেন তিনি। ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। জাহানারা ইমাম ছিলেন  মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে তা শিক্ষার সর্বস্তরে চালু করার প্রয়োজনীয়তা  অনুভব করেছিলেন তিনি। তরুণ প্রজন্মের কাছে তার আহ্বান ছিল- তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত হয়। তিনি তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি একাত্তরের  ঘাতক-দালাল বিরোধী আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত রাখতে পারলে এদেশের কল্যাণের জন্য ত্যাগ স্বীকারে ইচ্ছুক মানুষের অভাব হবে না। তিনি বলতেন, এই প্রজন্মের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আগামী দশকগুলোর যোগ্য প্রতিনিধি। আর সে লক্ষ্যেই এ প্রজন্মকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,  'জেনো সাহসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।' 

জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে পুনর্জাগরিত  করেছিলেন। সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক, যিনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে  জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। জাহানারা ইমামের মৃত্যু নেই।