রাজধানীর মানুষ প্রতি বছর ২৪২ কার্য দিবসে যানবাহনে কাটায় ৭ শত ২৬ ঘন্টা! প্রতি বছর ১৯ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি!

ইমরুল কায়সার ইমন
Published : 25 July 2011, 05:03 AM
Updated : 25 July 2011, 05:03 AM

রাজধানীতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। জীবন সংগ্রামে অনেক পিছিয়ে পড়ছে মানুষ। সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, একজন সরকারি কর্মজীবী মানুষ প্রতি দিন ৩ ঘন্টা হারে প্রতি বছর ২৪২ কার্য দিবসে ৭ শত ২৬ ঘন্টা যানবাহনে বসে সময় কাটায়। যদি ২১ বছর বয়সে কর্ম ক্ষেত্রে যোগদান করে তাহলে ৬০ বছর পর্যন্ত মোট ৩৯ বছরে ৯ হাজার ৪ শত ৩৮ কার্যদিবসে মোট ২৮ হাজার ৩ শত ১৪ ঘন্টা যানবাহনে বসে কাটায়। রাস্তায় যানজটের কারণে নগরবাসীদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছাতে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীতে চলাচল কার বাস যাত্রীদের নষ্ট হচ্ছে দৈনিক ৮০ লাখ কর্মঘণ্টা। প্রতিবছর ব্যয় হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের তথ্য অনুযায়ী, যানজটের কারণে সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। যানজট নিরসনে সরকারের গৃহীত প্রায় সকল পদক্ষেপ ভেস্তে গেছে। দিনের পর দিন কেবল যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা বাংলাদেশের মত একটি স্বল্প আয়ের দেশের জন্য উন্নয়নের পথে হুমকি স্বরূপ।

রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে একটি জরিপ করে দেখা যায়, মিরপুর থেকে মতিঝিল আসতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট। অথচ রাস্তায় যানজট না থাকলে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। যাতায়াতে নগরবাসীদের প্রতিদিন ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট বেশি সময় যানবাহনে বসেই কাটাতে হচ্ছে। বিআরটিসি'র বাস চালক শফিকুল ইসলাম জানান, আমরা যাত্রীদের সঠিক সময়ে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চেষ্টা করি। পুরোপুরি ব্যর্থ হই। রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি গাড়ি চলাচল করছে। একারণে সঠিক সময়ে গন্তব্যে যাওয়া সম্ভব হয় না।

বিআরটিএ-এর তথ্যমতে, ২০০৩ সালে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কারের সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজার ৮'শ ৬৬টি এবং জিপ/মাইক্রোবাস ৩২ হাজার ৩'শ ৯১টি। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি এর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রাইভেট কার ১ লাখ ৪৭ হাজার ২'শ ৮৩টি এবং জিপ/মাইক্রোবাস ৫৮ হাজার ৬'শ ০৮টি। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধনকৃত যানবাহনের সংখ্যা ১৬ লাখেরও অধিক। প্রতিদিন দেড়শতের অধিক নতুন গাড়ি রাজধানীতে নামছে, যার শতকরা ৮০ ভাগই প্রাইভেট কার। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৮০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩২ লাখ। ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ (প্রায় দেড় কোটিও বলা হয়)। প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গায় বাস করছে ২৮ হাজার লোক। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীতে প্রবেশ করছে ৩৬ শত মানুষ। ঢাকায় রাস্তা আছে মোট আয়তনের ৭.৫ শতাংশ। ২০১৫ সালেএই নগরীতে লোক সংখ্যা হবে ১ কোটি ৭৯ লাখ। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ঢাকা শহরে এই বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ। ফলে লোক সংখ্যা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার জন্য এ ধরনের নগরীতে মোট আয়তনের ৩০ শতাংশ রাস্তা থাকা দরকার। তবে ঢাকা শহরে যে পরিমাণ বড় রাস্তা আছে তা অনেক ক্ষেত্রে লন্ডন শহরেও নেই বলে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা জানায়, জায়গার সমস্যার পাশাপাশি আমাদের দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থায়ও অনেক ত্রুটি রয়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তাদের অগ্রগতির কথা ভেবেই পরিকল্পিত নগরী নির্মান করেছে। যা আমরা করতে পারিনি। তবে ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে আমাদের এ সমস্যা থেকে কিছুটা উত্তোরণ সম্ভব।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স (বিআইপি)-সূত্রে জানা যায়, দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারের মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভিন্ন সংস্থার প্রধান কার্যালয়, এমনকি বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান ঢাকায় অবস্থিত। বিদেশী সব দূতাবাসও এই শহরের মধ্যে। আর আশপাশে গড়ে উঠা শিল্প-কলকারখানা ঢাকাকে দিয়েছে বাণিজ্যিক শহরের চেহারা। সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮২টির মধ্যে ৬০টি ঢাকায়। ৩৮টি বেসরকারি মেডিক্যালের মধ্যে ৩২টি ঢাকাতে অবস্থিত। দেশের ৬ বিভাগের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় প্রায় দুই কোটিরও অধিক ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা করছে। এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ লাখেরও অধিক। এছাড়াও পোশাক শিল্পের ২৫ লাখ শ্রমিক, ১৫ লাখ নির্মাণ শ্রমিক ও ৬ লাখ রিকশা চালক বাস করছে ঢাকায়। এই বিশাল জনসংখ্যার চাপে জানজট একটি বাস্তব চিত্র বলে উল্লেখ করেন একটি সচেতন মহল।

যানজটের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে শহরের ফুটপাত ও রাস্তার দুই ধারে গড়ে মার্কেট। বিভিন্ন তথ্যানুসারে দেখা যায় ঢাকায় হকার রয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজারের মতো। এদের বেশির ভাগ দখল করে রেখেছে রাস্তার দুই ধার। ফলে শহরের মানুষ সস্তায় পন্য কিনতে রাস্তার দুই পাশে গাড়ি পার্কিং করে খেয়াল খুশি মত কেনা কাটা করছে। অন্যদিকে একটি পার্কিং করা গাড়ির ফলে গতিবেগ কমাতে হচ্ছে পেছন দিক থেকে আসা সব গাড়ি গুলোকে। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়।

রাজধানীর বাসগুলো ভালো করে প্রত্যক্ষ করলে দেখা যায়, ৮৩% বাসে ১টি দরজা, বাকী ১৭% এ আছে ২টি দরজা। এসব বাসে ওঠা লাগে ২ ধাপের সিঁড়ি বেয়ে, যেগুলোর গড় উচ্চতা ২ ধাপ মিলিয়ে ১৭ ইঞ্চির মত। এই উচ্চতা উঠতে একজন যাত্রীর গড়ে সময় লাগে ১২ সেকেন্ড। হিসেব করে দেখা গেছে, একতলা বাসগুলোর স্টপেজ টাইম ২০ জন যাত্রীর জন্য গড়ে ৩ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড, দোতলা বাসগুলোর জন্য ৫ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড। এই সময় একটি বাসের জন্য পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে থাকে। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়।