রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আশীর্বাদ না অভিশাপ?

পাহলোয়ান এরশাদ
Published : 7 July 2017, 01:54 AM
Updated : 7 July 2017, 01:54 AM

পৃথিবীর একপ্রান্তে যখন দিনের আলো উদিত হয় তখন অন্য প্রান্তে অন্ধকার নেমে আসে। প্রকৃতির এই নিয়ম এর বাইরে আমরা কেন যেতে পারি না? প্রযুক্তি কি সেই একই পথে হাটে? এখন তাই দেখতে পাচ্ছি। যখন পৃথিবীর এক প্রান্তে নিউক্লিয়ার পাওয়ার জেনারেশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সেখানে আমাদের মত দেশ বিলিয়ন ডলার ব্যায় করে এই রকম উচ্চভিলাসী প্রযুক্তি ব্যাবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যে সব পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেবে আর ঠিক সেই সময় আমাদের দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবে। জার্মানি কেন তার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে চাইছে? অনেকে ভাববেন ভয় আর আশংকা থেকে হয়ত? না শুধু ভয় নয়, এর মধ্য রয়েছে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা। এই সময়ে জার্মানির ৮টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে আর ১৬ টি বন্ধের পথে।

জার্মানির এই সাইটগুলোকে বন্ধ করতে প্রয়োজন প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার বা তার অধিক আর একটি পারমাণবিক ওয়াস্ট ডিস্পোজাল সাইট নির্মাণ করতে লাগবে আরো ২ বিলিয়ন ডলার, সময় লাগবে প্রায় ১৫ বছর। জার্মানির সব পারমানবিক কেন্দ্রগুলোকে সরাতে সময় লাগবে ৪৮ বছর অর্থাৎ আগামি ২০৭০ সালে জার্মানি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অস্তিত্ব বিলীন হবে।

এই বিশাল ব্যয় সরকার নিজেদের কাঁধে নিতে চাইছে না, তারা এর ভার তুলে দিতে চান বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা কোম্পানির হাতে যাদেরকে ১০ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু কোম্পানির মূলধনও এই পরিমাণ হবে না। তাই তাদের নিজেদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া আর কিছু থাকবে না। তাহলে এই বিশাল ব্যয় কে বহন করবে? ইতিমধ্যে কোম্পানিগুলো আদালতে দ্বারস্থ হতে শুরু করেছে। ফলাফল যাই হোক আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে শেষমেষ জার্মান নাগরিকদেরকেই এই এর ব্যয় বহন করতে হবে।

.

আগামি ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় জার্মান সরকার। জার্মান সৌর শক্তি এবং বায়ু বিদ্যুৎ এই দুটি উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায়। জার্মানির কোম্পানিগুলো কাতারি ব্যাবসায়িদের রাজী করিয়েছে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে। এই প্রকল্পে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে তার প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কয়লা বা গ্যাস থেকে উৎপাদিত খরচ থেকে অনেক কম হবে। অপরদিকে জার্মানির নাগরিকদের চাপে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে রাজনীতিবিদরা পারমাণবিক চুল্লি বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন।


.আমাদের দেশে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে তা হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর নিরাপত্তাগত ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই দেশের নাগরিকদের চাপে এই কেন্দ্র কে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে, তখন এই বিশাল ব্যয়ে স্থাপিত কেন্দ্রটিকে সরাতে আবার বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হবে। সেই ব্যয় মেটাতে হবে তখনকার নাগরিকদের।

অপরদিকে যে দ্রুতগতিতে সোলার প্যানেল প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে তাতে সোলার থেকে উৎপাদিত বিদুতের দাম পারমাণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত বিদুতের চেয়ে কম হলে তখন এই দামে বিদ্যুৎ কে কিনেব? তখন এই পারমাণবিক কেন্দ্রগুলকে সরকারের ভুর্তকি দিতে হবে?

আর সবচেয়ে বড় যে সমস্যা হবে সেটি হচ্ছে এই কেন্দ্রের আয়ু ফুরিয়ে গেলে তখন এটিকে সরিয়ে ফেলতে আরোও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। সেই টাকা তখন জনগণের পকেট থেকে যাবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ সস্তা বললেও সস্তা নয়, উৎপাদন সময়কালে সস্তা কিন্তু স্থাপন আর অপসারণ ব্যয় অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে এই পারমাণবিক বর্জ্য অপসারণ ও সংরক্ষণ।


আমি গতকাল জার্মানির একটি পুরাতন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখতে গিয়েছিলাম। সেটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি ও পরিচালনা করেছিল। এখানে যে প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হয়েছিল বাংলাদেশেও সেই প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হবে কিন্ত এটার চেয়ে আপগ্রেডেট। এই কেন্দ্রটি জার্মানির সরকার ১৯৯০ সালে বন্ধ করে দেয়, তখন থেকে এটির অপসারণ শুরু হয় এবং এটিকে সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে আর ১৫ বছর লাগবে। সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গিয়ে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ভবিষ্যত দেখতে পেলাম।

গ্রেইসবাল্ট
জার্মানি ৬/৭/২০১৭